বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-টিআইর প্রতিবেদন : প্রত্যাখ্যানের গতানুগতিক ধারা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

পুলিশ যেকোনো রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রমাণ মেলে, প্রচার কিংবা সাফাই গাওয়ার সব রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ দেশে পুলিশ সংস্থাটি ব্যাপক প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। 'পুলিশ জনগণের বন্ধু'_এই আপ্তবাক্যের অসারতাও চোখে পড়ে প্রায় পদে পদেই। পুলিশ এ দেশে এখন পর্যন্ত জনগণের বন্ধু হতে পারেনি_এটা দুঃখজনক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য। পুলিশ যদি কোনো দেশে জন-আতঙ্কের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়,


তাহলে সে দেশে এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা যত রকম ইতিবাচক কথা বলারই চেষ্টা করুন না কেন, তা ধোপে টেকে না। আমরা বিশ্বাস করি কিংবা এই বিশ্বাস লালনও করতে চাই, পুলিশ বাহিনীতে নীতিনিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অধিকারী, দক্ষ, দূরদর্শী কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি এ প্রশ্নও দাঁড়ায়, সে সংখ্যা কত? উত্তর সন্ধানের আগেই মাথা হেঁট হয়ে যায়, লজ্জার ছায়ায় মুখ ঢেকে যায়।
কয়েক মাস আগে প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের কিঞ্চিৎ অগ্রগতির খবর মিললেও এর রেশ কাটতে না কাটতেই সম্প্রতি টিআইর 'ডেইলি লাইভস অ্যান্ড করাপশন : পাবলিক অপিনিয়ন ইন সাউথ এশিয়া' জরিপভিত্তিক প্রতিবেদনটি আবার আমাদের পেছনের দিকে নিয়ে গেছে। তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ ছয়টি দেশে রাজনৈতিক দল ও পুলিশ বিভাগকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ছয়টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামটি ওপরের দিকেই রয়েছে। মাঠপর্যায়ে পরিচালিত জরিপ চালানোর পর যে গবেষণা প্রতিবেদন পাওয়া গেল, তাতে দেখা গেল, ঘুষেও আমরা এক নম্বরে! জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রতি তিনজনের একজন বলেছেন, সরকারি সেবা পেতে তাঁদের ঘুষ দিতে হয়েছে এবং পুলিশ বিভাগ এ ক্ষেত্রে রয়েছে শীর্ষে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ প্রতিবেদন সঠিক নয় বলে দাবি করলেও সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পায় থানা-পুলিশ তাদের জন্য কতটা বৈরী। একটি জিডি করতে গেলেও বিনা উৎকোচে কার্য সম্পাদনের দৃষ্টান্ত হয়তো বিরলই। সরকারের নীতিনির্ধারকরা টিআইর প্রতিবেদনে মনঃক্ষুণ্ন হলেও জরিপ প্রতিবেদনটি জনমানুষের তিক্ত অভিজ্ঞতারই ফল। এ দেশে দায়িত্বশীলদের মনমতো কিছু না হলে তা প্রত্যাখ্যান করার রেওয়াজ পুরনো এবং গতানুগতিক। এবারও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অবস্থান এর ব্যতিক্রম নয়। এর ফলে সমাজচিত্র ক্রমবিবর্ণ হচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধাকরা দায় এড়িয়েই যেন খালাস পেতে চান! কিন্তু তাঁরা এটা মানতে নারাজ, দায় এড়ালে কিংবা অস্বীকার করলে সমস্যার দানা আরো পুষ্ট হয়। ঘুষ-দুর্নীতির ছোবলে মানুষ অতিষ্ঠ_এটা সরকারের নীতিনির্ধারকরা অস্বীকার করলেও সাধারণ মানুষ এর নির্মমতা পদে পদে টের পাচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নাম থাকলেও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, প্রতিকারের অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্তও স্থাপন করতে সক্ষম হচ্ছে। ঘুষ-দুর্নীতির দায়ে ভারতে সম্প্রতি ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট কয়েকজন ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান এরই দৃষ্টান্ত। কিন্তু বাংলাদেশে? এ দেশে এর উল্টো চিত্রই পরিলক্ষিত হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন নিয়ে চলছে কানামাছি খেলা। এ অবস্থায় চিত্র উৎকট হবে না তো কি উজ্জ্বল হবে?
গত চার দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, প্রতিটি রাজনৈতিক সরকার পুলিশকে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। অভিযোগ আছে, নিয়োগ থেকে শুরু করে পোস্টিং পর্যন্ত এর অপছায়া পড়েছে এবং বিপুল অঙ্কের বিনিময়ে কিংবা দলের একান্ত অনুগতরাই চাকরি নিয়েছে। ফলে এ দেশে পুলিশ বাহিনী দক্ষ, গতিশীল, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, পেশাদারি বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠেনি। দুর্নীতি-অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা জেঁকে বসেছে এবং যখন যে বা যাঁরা যেভাবে পারছেন সেভাবেই আখের গোছাতে মরিয়া হয়ে উঠছেন। এখন কথা হলো, এ থেকে পরিত্রাণের কি পথ নেই? পুলিশ বিভাগে ঘুষ, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা নির্মূলের বড় উপায় হলো তাদের সত্যিকার পেশাদার বাহিনীরূপে তৈরি করা এবং সে জন্য দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থের ব্যবহার বন্ধ করা। পাশাপাশি পুলিশের নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা এবং জবাবদিহিমূলক দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার দাবির পূর্ণ বাস্তবায়ন। এই গড়ে তোলার অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি এযাবৎ প্রতিটি সরকারই কমবেশি ব্যক্ত করেছে বটে; কিন্তু তা উচ্চারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। যেকোনো ক্ষেত্রে আইনি সুযোগ-সুবিধা যত নিশ্চিত হবে, বেআইনি তৎপরতা ততই হ্রাস পাবে_এটাই খুব স্বাভাবিক। শুধু পুলিশ কেন, প্রতিটি বিভাগের ক্ষেত্রেই তা নির্মোহ সত্য। ইউএনডিপির সহায়তায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা কেন ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে_এরও সদুত্তর মিলছে না। একদিকে সরকারের নীতিনির্ধারক কিংবা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাস্তবতা অস্বীকার করবেন, অন্যদিকে এরই মাঝে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করবেন_এই স্ববিরোধিতা জিইয়ে রাখলে সুফল তো নয়ই; বরং বক্রপথই প্রশস্ত হবে এবং তা জনকল্যাণের বিপরীতে অকল্যাণের প্রাচীর দাঁড়াবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অনেকেই ইতিমধ্যে খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, জালিয়াতিসহ বহু ধরনের দুষ্কর্মে নিজেদের জড়িয়েছেন। কোনো পোশাকধারী বাহিনী কিংবা সংস্থার কোনো সদস্য যদি অপকর্মে লিপ্ত হন, সমাজবিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত হন, তাহলে এর দায় গিয়ে পড়ে সমগ্র সংস্থা কিংবা বাহিনীটির ওপর। এ দেশের পুলিশের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। বাংলাদেশে পুলিশ জনবান্ধব না হয়ে সরকারবান্ধব হয়েছে। সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা হাসিলে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে, জনপ্রত্যাশা কিংবা মানবাধিকারের সব রকম সূত্র পদপিষ্ট করে অত্যন্ত বেপরোয়াভাবে। এ ধারা এক দিনে সৃষ্ট নয়। কিন্তু উদ্বেগজনক হলো, ক্রমেই এই অপধারা বেগবান হচ্ছে এবং এ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পথও যেন রুদ্ধ হয়ে পড়ছে।
একটি দক্ষ, স্বচ্ছ, গতিশীল, আধুনিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার দীর্ঘদিনের জনদাবিটি কেন উপেক্ষিত থাকছে, এরও সদুত্তর মিলছে না। নিকট-অতীতে প্রধানমন্ত্রী ১৮টি প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছিলেন, যেখানে প্রতিটি পুলিশ ইউনিটের মান বৃদ্ধির কথা ছিল। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা তাদের নির্বিঘ্ন শাসনকার্যের সহায়ক উপাদান হিসেবে এ দেশে পুলিশ বাহিনীর যে পত্তন ঘটিয়েছিল, সেই ছকেই চলছে স্বাধীন দেশের পুলিশ। ব্রিটিশদের বিধিবিধান ও নিয়মকানুনের বৃত্ত বলয়ে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে আমাদের পুলিশ বাহিনী। এ অবস্থায় তাদের কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করাও দুরাশা। এ দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংখ্যা বৃদ্ধিসহ অপরাধের ধরন এবং মাত্রায়ও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিগুলো সময়োচিত ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন পরও বিষয়টি আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জটাজাল মুক্ত হতে পারেনি। সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে কাউকে রেখে তার কাছে জবাবদিহিতা-দায়বদ্ধতার পাঠ আশা করাও অমূলক। দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশের সমাজ-বাস্তবতায় একটি চিত্র বড় বেশি অশুভ চিহ্ন বহন করছে। এখানে সৎ, কর্তব্য ও দায়িত্বনিষ্ঠরা হতাশ আর অসাধুদের যেন পোয়াবারো। একটি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের জন্য এই পরিস্থিতি চরম সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। সবার অনুভূতি ও চাহিদাকে আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনার বিষয়টি যেকোনো সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে অত্যন্ত জরুরি। চারদিকে নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র ক্রমেই যেভাবে প্রকট হচ্ছে, তা অবশ্যই উদ্বেগের বড় কারণ। বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকসহ নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল অন্যদেরও পরিত্রাণের আশু পথ বাতলানো ভিন্ন গত্যন্তর নেই। ঘুষ দুর্নীতির একটি অংশ। দুর্নীতিমূলক কাজের যদি মান নির্ণয় করা হয়, তবে ঘুষই হবে সম্ভবত সবচেয়ে নিম্নমানের। বাংলাদেশে ঘুষের প্রচলন ব্যাপক ও সর্বব্যাপী হলেও ঘুষ শব্দটি এখনো সিংহভাগ মানুষের কাছে ঘৃণ্য। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এটি অত্যন্ত আশাপ্রদ একটি ব্যাপার। আইনের শাসনের পাশাপাশি নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ চাঙ্গা করা ভিন্ন এ সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া দুরূহ।
সুশাসন ও নৈতিক শিক্ষার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এ দেশে দুই-ই উপেক্ষিত। ঘুষের ক্ষেত্রে যে আমরা প্রথম স্থানেই রয়েছি তা-ই নয়, ঘুষের রকমফেরেও আমরা শীর্ষে। বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘুষ অনেক ক্ষেত্রে খোলামেলাভাবেই বাধ্যতামূলক হয়ে উঠছে। ঘুষ ছাড়া এ দেশে সেবা পাওয়া দুষ্কর। এর পাশাপাশি সব কিছুতেই দায়িত্বশীলদের দায় এড়ানো কিংবা অস্বীকারের অপপ্রবণতা নেতিবাচকতাকেই পুষ্ট করছে, অশুভ শক্তিকে প্রকারান্তরে উৎসাহ জোগাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে ঝটপট টিআইর প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন, তিনি যদি তা না করে বিষয়টি আমলে নিয়ে নির্মোহ অবস্থান থেকে খতিয়ে দেখে পুলিশ বিভাগের দুর্নীতিবাজদের প্রত্যাখ্যানে দৃঢ় হতেন, তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও ইতিবাচক ফল মিলত। কিন্তু এ দেশের দায়িত্বশীলদের বরাবরই সে পথ মাড়াতে বড় অনীহা পরিলক্ষিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কেন? এই 'কেন' শব্দটি সব সরকারের আমলেই জিইয়ে আছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এর অবসানেই সমস্যার সমাধান।

লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.