ঢাকাভঙ্গ by এ কে এম জাকারিয়া

পনি কোন ঢাকায়? উত্তর না দক্ষিণ? যদি আপনি ঢাকাবাসী হন, গেল মাস দুয়েকে নিশ্চয়ই এমন প্রশ্নের মুখে পড়েছেন! কোন ঢাকার ভাগে গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থাপনা পড়ল, এ নিয়েও বাহাস চলছে। মোটামুটি অলিখিত এক প্রতিযোগিতাও দাঁড়িয়ে গেছে। বঙ্গভবন বা সংসদ ভবন দক্ষিণ ঢাকায় পড়েছে তো কী হয়েছে, বিমানবন্দরের মতো স্থাপনা বা গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকা তো উত্তরেই! হাসিঠাট্টা, রসিকতা কম হচ্ছে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ৪০০


বছরের পুরোনো ঢাকা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। সংসদে আইন পাস করে সরকার কাজটি করেছে, সময় নিয়েছে মাত্র পাঁচ মিনিট! বছরের শেষ দিকে বিতর্ক আর আলোচনায় সবার ওপরে ছিল ঢাকার বিভক্তি।
সরকার ঢাকা ভাগের কাজটি করেছে একক সিদ্ধান্তে। এ নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা বা পরামর্শ করা জরুরি মনে করেনি। যে যুক্তি দিয়ে সরকার ঢাকাকে ভাগ করেছে, তার জোর বিরোধিতা করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা। সরকার বলেছে, নাগরিক সেবার মান বাড়াতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভাগ করা জরুরি। একটি সিটি করপোরেশন দিয়ে ঢাকার মতো এত বড় শহরে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞদের মত, এতে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। বিশ্বের কোথাও কোনো শহরের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। ঢাকাবাসীর নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য যেখানে বিভিন্ন সেবা সংস্থার কাজের সমন্বয় ও ঢাকা সিটি করপোরেশনকে (ডিসিসি) আরও শক্তিশালী ও এককেন্দ্রিক করার সুপারিশ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মহল থেকে করা হয়েছে, সেখানে এই বিভক্তি তাই অনেকের কাছেই অগ্রহণযোগ্য। শেষ পর্যন্ত এসব বিরোধিতা অবশ্য সরকারের কাছে গুরুত্ব পায়নি। ২৯ নভেম্বর সংসদে ঢাকা সিটি করপোরেশন ভাগ করে বিল পাস হওয়ার পর দীর্ঘদিনের ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বিদায় নিয়েছেন। এখন দুজন প্রশাসকের নেতৃত্বে চলছে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন।
সরকার ঢাকাকে ভাগ করার পক্ষে যে যুক্তিই দিক না কেন, অনেকে এর পেছনে দেখছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। সরকারি দলের কোনো প্রার্থী এককভাবে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে জিততে পারবে না—এই ভয় থেকেই ঢাকা ভাগ করেছে সরকার। তাঁরা মনে করেন, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা সিটি করপোরেশন সরকারি দলের হাতছাড়া হয়ে যাক, তা কোনোভাবেই চায়নি সরকার, তাই এই বিভক্তি। আবার অনেকের মতে, বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকাকে মেয়র পদ থেকে সরানোর কোনো পথ না পেয়ে ঢাকাকে ভাগ করার পথ বেছে নেয় সরকার। বিরোধী দল তাদের আন্দোলনে মেয়রকে কাজে লাগাচ্ছে—এসব কারণে তাঁকে সরানো জরুরি হয়ে পড়েছিল সরকারের কাছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ঢাকা ভাগের বিরোধিতা করেছে। ক্ষমতায় এলে ঢাকা আবার এক হবে—এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে দলটি।
ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তির বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। ঢাকা ভাগের বিরুদ্ধে ঢাকার সাবেক মেয়রের করা রুলের নিষ্পত্তি হয়নি এখনো। তবে সংসদে যে আইন পাস হয়েছে, সে অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু সে রকম কিছু হচ্ছে না বলেই ধরে নিতে হচ্ছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে, তাদের হাতে এই নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করে তা শেষ করার সময় নেই। তাই তারা নির্বাচন না করার কথা জানিয়ে দিয়েছে। পুরো পরিস্থিতি অনিশ্চিতই বলতে হবে। ঢাকা বিভক্তির কাজটি পাঁচ মিনিটে সারা হলেও ঢাকায় দুজন নির্বাচিত মেয়র পাওয়ার জন্য আরও বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। আর বিভক্তির ‘সুফল’ মানে নাগরিক সেবার মান কতটুকু বাড়ে, সেটা দেখার জন্য কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে।

No comments

Powered by Blogger.