সাঙ্গ হলো রবীন্দ্র-উৎসব by আশীষ-উর-রহমান

র্জুন এসেছেন মণিপুর রাজ্যে তাঁর দ্বাদশ বছরের প্রব্রজ্যার এক পর্যায়ে। মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে যখন তাঁর সাক্ষাৎ, তখন চিত্রাঙ্গদার যোদ্ধার বেশ। বরাবর তিনি এই বেশেই অভ্যস্ত। তির-ধনুক নিয়ে যুদ্ধ তাঁর বড়ই পছন্দের বিষয়। দুষ্টের দমনে পুত্রহীন রাজার পুত্রবৎ ভূমিকা রাখছেন যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী কন্যা। অর্জুনকে দেখার পর যোদ্ধাবেশী চিত্রাঙ্গদার ভেতরে সুপ্ত নারী-হূদয়ের জাগরণ ঘটল। মনে হলো তাঁর ‘কোন আলো লাগল চোখে’।


সখীদের কাছে ব্যাকুল হূদয়ের আর্তি প্রকাশ করলেন। তাদের পরামর্শে হূদয়ের অর্জুনের কাছে প্রকাশ করলেন হূদয়ানুরাগ। কিন্তু এই যোদ্ধাবেশী তরুণীকে মোটেই আমল দিলেন না অর্জুন। প্রত্যাখ্যাত চিত্রাঙ্গদা প্রেমদেব মদনের বরে অনিন্দ্যসুন্দর রূপ লাভ করে দাঁড়ালেন অর্জুন সম্মুখে। সেই রূপলাবণ্য উপেক্ষার সাধ্য কোথায় পার্থসারথির। মজে গেলেন প্রণয়ে।
মনোরথ তো পুরল চিত্রাঙ্গদার। কিন্তু সেই সঙ্গে মনঃকষ্টেরও সূত্রপাত হলো। কৃত্রিম রূপ দিয়ে অর্জুনকে ভোলানোর বিষয়টি ভেতরে ভেতরে কাতর করে তুলছিল তাঁকে। এসব নিয়েই চিত্রাঙ্গদার কাহিনি, এসব প্রায় সবারই জানা। সুরের ধারার রবীন্দ্র-উৎসবের সমাপনী দিনে গতকাল শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেমে সমাপনী অনুষ্ঠানের আগে চিত্রাঙ্গদা ছিল শেষ পরিবেশনা। প্রথম আলো ও চ্যানেল আইয়ের সহযোগিতায় তিন দিনের এই উৎসব শুরু হয়েছিল গত বৃহস্পতিবার।
বিশ্বভারতীর সংগীত ভবন চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যটি পরিবেশন করে। এতে অর্জুনের চরিত্রে ছিলেন সৌরভ চট্টোপাধ্যায়, চিত্রাঙ্গদা কুরূপা তমালিকা দে, সুরূপা কে সুজাতা দেবী এবং মদনের ভূমিকায় ছিলেন সীসাম বসুসা।
এর আগে মিল্কিওয়ের মঞ্চে ছিল একটি ব্যতিক্রমী আয়োজন; লন্ডনের শিল্পীরা নৃত্য, সংগীত, পাঠ ও আবৃত্তির সমন্বয়ে পরিবেশন করেন ‘বিলেতে রবীন্দ্রনাথ’। এতে কবি ইউরোপ ভ্রমণকালে যেসব গান রচনা করেছেন, তার মধ্যে বেশ কিছু গান শুনিয়েছেন শিল্পীরা; কোনো কোনো গানের সঙ্গে ছিল নৃত্য। প্রজেক্টরে দেখানো হয় কবির ইউরোপ ভ্রমণের বেশ কিছু ছবি। পাঠ করা হয় সে সময়ে বিভিন্ন জনের কাছে লেখা চিঠির অংশবিশেষ।
শ্রুতি গীতবিতান প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানটি ছিল অনেকটাই পুরো আয়োজনের সারসংক্ষেপের মতো। সুরের ধারার শিল্পীরা কবির ছয়টি গান পরিবেশন করেন। এই ছয়টি গান এমন করে বাছাই করা হয়েছিল, যাতে গীতবিতান-এর সব গানের বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়। কোনো গানের সঙ্গে পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রা, কোনো গানে বাজানো হয় প্রাচ্য রীতির যন্ত্র; আবার কোনো গানে ছিল লোকবাদ্যযন্ত্রের সংযোজন। অর্থাৎ যে আঙ্গিকের গান, তার সঙ্গে তদনুরূপ যন্ত্রানুষঙ্গ; সঙ্গে নৃত্য।
সমাপনী অনুষ্ঠানটি ছিল মিল্কিওয়েতে। মূল মঞ্চ ছাড়াও শ্রোতাদের মাঝখানে প্রথম পাঁচটি গান সম্মেলক কণ্ঠে। শুরু হয়েছিল ‘বাজে বাজে রম্যবীণা’ দিয়ে। অন্য গানগুলোর মধ্যে ছিল ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’, ‘সজনি সজনি রাধিকা লো’, ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’ প্রভৃতি। সংগীত পরিচালনা করেছেন আজিজুর রহমান এবং নৃত্যে ছিলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, তামান্না রহমান ও তাঁদের সঙ্গীরা। অনুষ্ঠানের শেষ গানটি গেয়েছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’। এই দেশের জন্য বহু আত্মত্যাগ করেছেন বহুজন। কবিগুরু দেশটিকে ভালোবাসার যে কথা বলেছিলেন তাঁর গানে, তা আজ এ দেশের জাতীয় সংগীত। কবিকে নিয়ে উৎসব তাই দেশকে ভালোবাসার উৎসবেও পরিণত হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.