স্বাধীনতার ৪০ বছর-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৭০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। এ কে এম ইসহাক, বীর প্রতীক নিপুণ এক প্রতিরোধযোদ্ধা প্রকৌশলী এ কে এম ইসহাক ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন রাঙামাটি জেলার চন্দ্রঘোনায়। কর্ণফুলী পেপার মিলে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা ও চট্টগ্রামে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা চন্দ্রঘোনায়ও সে খবর ২৬ মার্চ পৌঁছে যায়। ২৫ মার্চের আগেই সেখানে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল সংগ্রাম


কমিটি ও ছাত্র-যুবকদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী পেপার মিল ও রেয়ন মিলের নিরাপত্তা বিভাগে ছিল দেড় শতাধিক থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও বন্দুক। এ কে এম ইসহাক ২৬ মার্চ সেসব অস্ত্র প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে বিতরণ করেন। তারপর ২৭ মার্চ কাপ্তাইয়ের মদনা ঘাটে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা লেফটেন্যান্ট মাহফুজুর রহমানের (বীর বিক্রম, পরে মেজর, ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত) সঙ্গে দেখা করে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিরোধ যুদ্ধে। ইসহাক তাঁর স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়ে অবস্থান নেন মদনা ঘাট-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যবর্তী স্থানে। এপ্রিল মাসে তিনি বেশ কয়েকটি যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। ১৩ এপ্রিল কালুরঘাটের পতন হলে তিনি তাঁর দল নিয়ে সমবেত হন খাগড়াছড়িতে। সেখানে আলোচনায় স্থির হয়, মেজর মীর শওকত আলীর (বীর উত্তম, পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল) সার্বিক কমান্ডে মুক্তিযোদ্ধারা মহালছড়িতে অবস্থান নিয়ে রাঙামাটি-বরকল ও রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করবেন। এ কে এম ইসহাকের ওপর দায়িত্ব পড়ে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করার। তিনি তাঁর দল নিয়ে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে বেশ কয়েকবার অ্যামবুশ করেন। এই অ্যামবুশে হতাহত হয় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা। ২৭ এপ্রিল মহালছড়িতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল ও তাদের সহযোগী সশস্ত্র মিজোদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ভয়াবহ এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের (বীর উত্তম)সহ কয়েকজন শহীদ হন। এ দিন যুদ্ধে এ কে এম ইসহাক ও তাঁর দলের মুক্তিযোদ্ধারা বেশ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী সশস্ত্র মিজোদের অনেককে হতাহত করতে সক্ষম হন। তা সত্ত্বেও তাঁরা সেখানে টিকতে পারেননি। কারণ, পাকিস্তানি সেনা ও সশস্ত্র মিজো মিলে সংখ্যায় ছিল অনেক। পরে তাঁরা অবস্থান নেন রামগড়ে। সেখানে ২ মে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ চেষ্টা করেও রামগড় ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। রামগড় পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় তাঁর মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব।
এ কে এম ইসহাক এরপর সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যান ভারতে। সাবরুম থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে হরিণা নামক পাহাড়ি এলাকায় তাঁরা ক্যাম্প স্থাপন করেন। পরে সেই ক্যাম্পই ১ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে রূপ নেয়। সেখানে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম। জুলাই মাসে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে এ কে এম ইসহাককে ১ নম্বর সেক্টরের কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এই দায়িত্ব পেয়ে তিনি মুক্তিবাহিনীর জন্য যোদ্ধা সংগ্রহ, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি কাজ যথেষ্ট সীমাবদ্ধতার মধ্যেও নিপুণভাবে সম্পন্ন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত প্রতিরোধ যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য এ কে এম ইসহাককে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২৯৯।
এ কে এম ইসহাক ২০১০ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি যশোর জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার ধল গ্রামে। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তাঁর বাবার নাম মুজিবুর রহমান, মা মাহমুদা খাতুন। স্ত্রী লুৎফুন্নেছা ইসহাক। তাঁর স্ত্রী এখনো বেঁচে আছেন। তিনি বর্তমানে ঢাকায় বড় ছেলের সঙ্গে থাকেন। তাঁদের ছয় ছেলে। ধল গ্রামে বীর প্রতীক এ কে এম ইসহাকের নামে একটি কলেজ ও স্কুল আছে। এ দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সূত্র: জাহিদ রহমান, প্রধান নির্বাহী, মুক্তিযুদ্ধে মাগুরা গবেষণা কেন্দ্র এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.