ফিরে দেখা ২০১১: আ ন্ত র্জা তি ক-আরব বসন্তের ঢেউ by নাইর ইকবাল

০১০ সালের ডিসেম্বরে ব্যাপারটির শুরু। গায়ে দাহ্য পদার্থ ঢেলে আত্মহত্যা করলেন তিউনিসিয়ার একজন সবজি বিক্রেতা। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। মোহাম্মদ বুয়াজিজি নামের সেই সবজি বিক্রেতা হয়ে উঠলেন সব অন্যায়, অবিচার আর রাষ্ট্রীয় কুশাসনের বিরুদ্ধে এক অনল প্রতিবাদের প্রতিরূপ। গণজাগরণ ছড়িয়ে পড়ল তিউনিসিয়ায়। বুয়াজিজির আত্মাহুতির ক্রোধে উন্মত্ত সাধারণ তিউনিসিয়ানদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে এর ঠিক এক মাস পরেই ২৩


বছরের মসনদ ছেড়ে দিয়ে সৌদি আরবে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন তিউনিসীয় লৌহমানব জয়নাল আবেদিন বেন আলী। সবজি বিক্রেতা এক তরুণ হয়ে উঠলেন বেন আলীর স্বৈরশাসন আর রাষ্ট্রীয় অসাম্যের বিরুদ্ধে এক মূর্ত প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদ গণজাগরণ এনে দিল গোটা আরব বিশ্বে। যে অঞ্চলের মানুষ রাজনৈতিকভাবে এত দিন জবরদস্তির শাসনব্যবস্থা মেনে নিয়েছিল, সেই অঞ্চলের মানুষের এই রাজনৈতিকভাবে জেগে ওঠার নামই ‘আরব বসন্ত’। যে বসন্ত ২০১১ সালজুড়েই প্রতিবাদ আর পরিবর্তনের ফুল ফুটিয়েছে তিউনিসিয়া থেকে মিসর, মিসর থেকে ইয়েমেন, বাহরাইন, সিরিয়া, জর্ডান, আলজেরিয়া আর লিবিয়ায়। যে গণজাগরণ পতন ঘটিয়েছে তিনটি দেশের স্বৈরাচারী সরকারের। যে জাগরণ বাকি অঞ্চলের স্বৈরাচারদের চোখে আঙুল দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, জবরদস্তির শাসনের দিন শেষ। তিউনিসিয়ার এই গণজাগরণের শুরু। বেন আলী পালিয়ে গেলেন জনতার তীব্র রোষানলে পড়ে। বুয়াজিজির মতোই আরেক চরিত্র খালেদ সাইদ মিসরে জ্বালিয়ে দিলেন বিক্ষোভ আর পরিবর্তনের আগুন। মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত যুবক খালেদ সাইদ এক দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তার মুঠোফোন হ্যাক করে জেনে গেলেন তাঁর অপরাধের চিত্র। সেই পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন অবৈধ মাদক ব্যবসায়। পুলিশ সেই কর্মকর্তার অপরাধ তদন্ত না করে সাইদকে গ্রেপ্তার করে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। রাষ্ট্রের এই অনির্বচনীয় কাণ্ডে প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে মিসরের জনগণ। সাইদের মৃত্যুর ক্ষোভের সঙ্গে ছিল স্বৈরাচার হোসনি মোবারকের শাসনের বিরুদ্ধে দেশটির মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ। সব ক্ষোভ একসঙ্গে মিলে বিক্ষোভের বারুদ হয়ে জ্বালিয়ে দেয় মোবারকের ক্ষমতার সিংহাসন। প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ অভূতপূর্ব বিক্ষোভে মিলিত হয় কায়রোর তাহরির স্কয়ারে।
‘আরব বসন্ত’ তিউনিসিয়া ও মিসর ছাড়িয়ে ঝড় তুলেছে লিবিয়া, ইয়েমেনেও। আরব বসন্তের ঝড়ে ধসে পড়েছে লৌহমানব মুয়াম্মার গাদ্দাফির তখ্ত তাউস। শেষ অবধি এই স্বৈরশাসককে বরণ করে নিতে হয়েছে এক দুঃখজনক মৃত্যু। ইয়েমেনের নারী তাওয়াক্কুল কারমান ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দেশে বিক্ষোভের বাতাবরণ। সানার চেঞ্জ স্কয়ারে তাঁবু গেড়ে বসে তিনি দাবি জানিয়েছিলেন আবদুল্লাহ সালেহর ৩৩ বছরের দুঃশাসনের অবসানের। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ইয়েমেনের লাখো সাধারণ মানুষ। জনতার তীব্র রোষে ভীত আবদুল্লাহ সালেহ শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করে সরে দাঁড়িয়েছেন। কারমানের প্রতিবাদ তাঁকে এনে দিয়েছে ২০১১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার।
আরব বসন্ত কেবল মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার কয়েকটি দেশেই পরিবর্তনের সূচনা করেনি, এর ঢেউ লেগেছে বিশ্বের অন্যত্রও। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ, যারা অপশাসনে জর্জরিত, তারাও প্রতিবাদের অনুপ্রেরণা খুঁজে নিচ্ছে এই আরব জাগরণ থেকে। সিরিয়ায় এই আরব বসন্ত সূচনা করেছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবাদ-বিক্ষোভের। আরব বসন্তে অনুপ্রাণিত মানুষ প্রতিবাদ শুরু করেছে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত এই রাজনৈতিক ঘটনা হয়তো আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের মানুষকে শেখাবে সব অন্যায়ের প্রতিবাদ।

No comments

Powered by Blogger.