বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ by ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের বছরগুলোতে এই উপমহাদেশে প্রায়ই দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। ফলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়। এ লক্ষ্যে গঠিত খাদ্য ও কৃষি কমিশন কৃষি শিক্ষা এবং গবেষণা সম্প্রসারণ ও জোরদারকরণের সুপারিশ করে। সেই সঙ্গে তৎকালীন শিক্ষা কমিশনেরও অনুরূপ সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (পরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হয়।


এ বিশ্ববিদ্যালয়টির লক্ষ্য ছিল কৃষির আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষা এবং গবেষণা করা। এসব বিষয়ে দক্ষ কৃষি গ্র্যাজুয়েট বা কৃষিবিদ তৈরি করা, যাঁরা কৃষকদের মধ্যে প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিয়ে দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করবে। খাদ্যশস্য উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ভেটেরিনারি, পশুপালন ও মৎস্য অনুষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদ থেকে মোট সাত ধরনের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা হচ্ছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ৫০ বছর পূর্ণ হলো। এযাবৎ ২৩ হাজার স্নাতক, ১৩ হাজার মাস্টার্স এবং ৪০০ পিএইচডি এ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে। দেশের প্রয়োজনের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকার কৃষিবিষয়ক আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। বিজ্ঞান চর্চা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কৃষি শিক্ষাকে কেন্দ্র করে। তাই ওই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ও অনেকটা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলেই গড়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং সেই সঙ্গে এ দেশের খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে বড় দুটি চ্যালেঞ্জ। তার পরও প্রায়োগিক জ্ঞান ব্যবহার করে দেশ এই ১৬ কোটি মানুষের জন্য বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন করছে, তার পেছনে রয়েছে কৃষিবিদদেরই অবদান। শুধু চাল নয়, সত্তরের দশকে এ দেশে দুধ উৎপাদন ছিল মাত্র পাঁচ লাখ টনের মতো, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ টনে। ওই সময় ডিম উৎপাদন ছিল মাত্র ১৩ লাখের মতো, যা এখন ৫০০ কোটি ছাড়িয়েছে। দেশে আজ ডিম ও ব্রয়লার উৎপাদনে যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তার পেছনে রয়েছে পশুপালন অনুষদ থেকে উত্তীর্ণ অ্যানিমেল হাজব্যান্ড্রি গ্র্যাজুয়েটদের অবদান। সাম্প্রতিককালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রস্তাবিত জনবল অবকাঠামোতে উৎপাদন কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে শুধু বিএসসি, এএইচ (BSc. in Animal Husbandry) গ্র্যাজুয়েটদের জন্য প্রতি উপজেলায় একটিসহ অ্যান্ট্রি লেভেলে মোট ৫৮১টি পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। আমরা মনে করি, এ দেশের জনগণের আমিষ-জাতীয় খাদ্যের ঘাটতি মোকাবিলার স্বার্থে এবং বর্তমান সরকারের ঘোষিত 'ভিশন-২০২১' বাস্তবায়নে Animal Husbandry গ্র্যাজুয়েটদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সে লক্ষ্যে দেশে ব্যাপকসংখ্যক Animal Husbandry গ্র্যাজুয়েটের প্রয়োজন। বর্তমানে এ বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে প্রতিবছর ১৫০ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। প্রায়ই বিভিন্ন বাণিজ্যিক খামার বিজ্ঞাপন দিয়েও Animal Husbandry গ্র্যাজুয়েটদের অপ্রতুলতার কারণে নিয়োগ দিতে পারে না। এ ধারা বেশিদিন অব্যাহত থাকলে দেশের পোলট্রি, ডেইরি ও অন্যান্য প্রাণিসম্পদ শিল্পে স্থবিরতা দেখা দেবে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এ অবস্থায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অবিলম্বে অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি গ্র্যাজুয়েট তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে BSc. in Animal Husbandry ডিগ্রির প্রবর্তন একটি সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রয়োজনে যেকোনো ডিগ্রি চালু করার অধিকার ও ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। ১৭ জুলাই, ২০১১ বাংলাদেশ ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে Animal Husbandry ডিগ্রি প্রদানের বিরোধিতা করে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যসংবলিত একটি পত্র প্রেরণ করে। ওই পত্রের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন Animal Husbandry ডিগ্রি খোলার ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে দেশের সব পাবলিক বিশ্বদ্যিালয়ে পত্র প্রেরণ করে। পরে ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কর্তৃক প্রেরিত পত্রের তথ্য মিথ্যা ও অযৌক্তিক প্রমাণিত হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে Animal Husbandry ডিগ্রি প্রদানের অনুমোদন দেয়। অতঃপর ওই বিশ্ববিদ্যালয় ওই বিষয়ে ছাত্র ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। প্রতিহিংসাবশত কতিপয় ভেটেরিনারি ও ভেটেরিনারি শিক্ষার্থী অযৌক্তিক এবং অনৈতিক আন্দোলনের নামে অযাচিতভাবে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে Animal Husbandry ডিগ্রি খোলার বিরোধিতা করে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ বিষয়টি সুরাহার উদ্দেশ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনদের নিয়ে একটি বৈঠক করে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি ভর্তি প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদীয় কমিটি, একাডেমিক কাউন্সিল এবং সর্বোপরি রিজেন্ট বোর্ড সর্বসম্মতিক্রমে Animal Husbandry কোর্সে ছাত্রছাত্রী ভর্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত হতে না দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ওপর একটি নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে প্রতীয়মান হয়। সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান ক্রমে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে নিতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব যৌক্তিক সিদ্ধান্তের ওপর এ হস্তক্ষেপ বন্ধ করা প্রয়োজন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, পশু বিজ্ঞান বিভাগ,
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

No comments

Powered by Blogger.