ওয়াল স্ট্রিট দখল করো! by মনিরুল ইসলাম

র্থনীতিতে সাম্য প্রতিষ্ঠা ও সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনই ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীদের মূল স্লোগান। দাবি আদায়ে শুধু নিউইয়র্ক নয়, বিশ্বের আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়েছে বঞ্চিত মানুষের অসংগঠিত, নেতৃত্বহীন কিন্তু জ্বালাময়ী এ আন্দোলন।পুঁজিপতি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাহীন অর্থলোভ, দুর্নীতি, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধনিক শ্রেণী ও তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যায় প্রভাব, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনায় সারা বিশ্বের মানুষ আজ পিষ্ট।


যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরুন না, মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে সে দেশের জাতীয় সম্পদের সিংহ ভাগ। তাদেরই নিয়ন্ত্রণে বাজারব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, তথ্যব্যবস্থা; এমনকি সেনা ও পুলিশ বাহিনীও সদা প্রস্তুত তাদের রক্ষায়। রাজনৈতিক ক্ষমতাও তাদেরই নিয়ন্ত্রণে। তাদের তোয়াজ না করে চললে কি রিপাবলিক, কি ডেমোক্র্যাট—সবারই নাকানিচুবানি নিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বাড়ছে। এতে বাড়ছে অভাবী মানুষ। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অভাবী ও ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা এখন বেশি।
একই চিত্র পৃথিবীর অন্যত্র, বিশেষ করে ইউরোপে। ওয়েলথ-এক্স নামের একটি সংগঠনের তথ্যমতে, পৃথিবীতে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা তার চেয়ে বেশি মূল্যমানের সম্পদের মালিক, এমন লোকের সংখ্যা এক লাখ ৮৫ হাজার ৭৯৫। এদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ কমবেশি ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে কখনো এত কম মানুষ এত বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক ছিল না। এত অল্প লোক এমন বিপুল ক্ষমতাও আগে কখনো ভোগ করেনি।
অন্যদিকে সাধারণ নাগরিক, যারা এই সংকটের শিকার, তাদের উদ্ধারে কোনো কার্যকর চেষ্টা নেই; উল্টো সামাজিক খাতে ব্যয় সংকোচনের চেষ্টা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে প্রতি ১০ জনের একজন বেকার। প্রায় পাঁচ কোটি লোকের বাস দারিদ্র্যসীমার নিচে। কোনো স্বাস্থ্যবিমা নেই, এমন মানুষের সংখ্যা ছয় কোটির ওপর। সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছাঁটাই করা হচ্ছে পুলিশ ও দমকলকর্মীদের।
ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীদের দাবি, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আর চলবে না, পুরোনো সব বদলে ফেলতে হবে। যে ব্যবস্থায় দেশের সিংহ ভাগ মানুষ বৈষম্য আর বঞ্চনার শিকার, তা আর মেনে নেওয়া যায় না। উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন গোষ্ঠী উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ওপর ঢালাওভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হতে হবে। গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে না; রাষ্ট্র পরিচালনায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তথাকথিত গণতন্ত্র বাদ দিয়ে অর্থনীতি, রাজনীতিতে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তাই বলে ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীরা সমাজতন্ত্রের কথা বলছে না। তারা চাইছে না, গণতন্ত্রের জায়গাটা সমাজতন্ত্র এসে দখল করুক। পক্ষান্তরে, তাদের দাবিগুলো যেন সমাজতন্ত্রেরই জয়গান। তাই তো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আন্দোলনকারীরা কী জন্য রাস্তায় নেমেছে, তা তাদের জানা নেই। সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য আছে বলে মনে হয় না। বোঝার কোনো উপায় নেই, তারা ডান না বাম।
তবে সম্পদশালী ১ শতাংশের বিরুদ্ধে বিত্তহীন ৯৯ শতাংশের এই জাগরণ অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের এত বছর পর সেই সুরে কথা বলা কিংবা অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরাসরি রাজপথে নেমে আসার বিষয়টি আর বোধ হয় উপেক্ষা করার উপায় নেই।
ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলন—প্রতিটি আলোকোজ্জ্বল এ ঘটনার মূল দাবি ছিল, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, সম্পদের সুষম বণ্টন, নাগরিক অধিকারের সম্প্রসারণ। ওয়াল স্ট্রিট দখলকারীদের দাবিও তাই, যদিও তা অসংগঠিত-অগোছালো। তবু এ আন্দোলনের আলোকচ্ছটা কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.