সেঁজুতির আত্মহনন-ধর্ষকদের বিচার দাবিতে ধর্মঘট ছাত্রছাত্রীদের by রফিকুল ইসলাম,

সেঁজুতির মা বলছেন, 'আমার মেয়েকে ওরা ধর্ষণ করেছিল। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের বিষয়টি চেপে গিয়ে অপহরণ চেষ্টার মামলা করেছিলাম। কিন্তু এরপর শুরু হয় মামলা ওঠানোর জন্য ধর্ষকদের পরিবারগুলোর হুমকি-ধমকি, কটুকাটব্য।' পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জ উপজেলার চৈতা মাধমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী সেঁজুতি সব সহ্য করে স্কুল পরীক্ষায়ও অংশ নিয়েছিল। কিন্তু তার প্রবাসী বাবার কাছেও নানা রকম মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পাঠাতে থাকে আসামিপক্ষ। 'মামলা করার অপরাধে' আয়োজন করা হয় সালিস বৈঠকের। সেঁজুতি আর সহ্য করতে পারেনি। গত শুক্রবার রাতে ফাঁস লাগিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে সে।


সেঁজুতি আক্তারের (১৪) আত্মহত্যার জন্য দায়ীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। শনিবার সকাল থেকে স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ সমাবেশ এবং কাঁঠালতলী পুলিশ তদন্তকেন্দ্র ঘেরাও করে। দুপুরের দিকে বাকেরগঞ্জ থানার ওসি রঘুনাথপুর বাজারে গিয়ে আন্দোলনকারীদের শান্ত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার পাদ্রিশিবপুর ইউনিয়নের বড় রঘুনাথপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করে সেঁজুতি। তার বাবা মো. সাদেকুর রহমান প্রবাসী। বাকেরগঞ্জ থানার পুলিশ শুক্রবার গভীর রাতে ঘটনাস্থলে পেঁৗছে লাশ নিয়ে আসে। তার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের কাউকে পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
মামলা হয় অপহরণ চেষ্টার
লোকলজ্জার ভয়ে সেঁজুতির মা যে অপহরণ চেষ্টার মামলা করেন এর এজাহারে বলা হয়, স্কুলে যাওয়া-আসার পথে সেঁজুতিকে প্রতিবেশী মতলেব প্যাদার ছেলে সাইফুল ইসলাম আপত্তিকর কথাবার্তা বলত। এ নিয়ে অভিযোগের পর সালিস-মীমাংসাও হয়। এ ঘটনায় সাইফুল ক্ষিপ্ত হয়ে সেঁজুতিকে অপহরণের হুমকি দেয়। গত ১৩ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে সেঁজুতি এশার নামাজ আদায়ের জন্য উঠানের নলকূপে অজু করতে যায়। তখন তাদের আরেক প্রতিবেশী ও চৈতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র নয়ন মৃধার সহযোগিতায় সাইফুল গামছা দিয়ে সেঁজুতির মুখ বেঁধে ফেলে। সেঁজুতি কৌশলে মুখের গামছা খুলে চিৎকার দেয়। তখন বাড়ির লোকজন ঘটনাস্থলে গেলে সাইফুলসহ অপহরণ চেষ্টার সঙ্গে সম্পৃক্ত একই গ্রামের সবুজ খান, মো. নাসির, রাজীব, নেছার উদ্দীন ও শামীম পালিয়ে যায়। নলকূপের পাশ থেকে অজ্ঞান অবস্থায় সেঁজুতিকে উদ্ধার করা হয়।
সেঁজুতির আত্মহত্যার পর গতকাল তার মা হাফিজা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ওই রাতে সেঁজুতিকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে মেয়ে ধর্ষিত হওয়ার বিষয়টি চেপে যাই। কারণ মেয়েটিকে তো বিয়ে দিতে হবে।'
হাফিজা বেগম জানান, নয়ন মৃধাসহ অভিযুক্ত তিনজনের বাড়িই তাঁদের বাড়ির লাগোয়া। থানায় অভিযোগ দেওয়ার পর তাদের বাড়ির লোকজন ঘটনাটি মীমাংসার জন্য চাপ দেয়। ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য সেঁজুতির বাবাকে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও চৈতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য আ. বারেক হাওলাদার বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন, হুমকি দেন। তিনি বলেন, 'মামলা তুলে না নিলে আমি স্বামীর সংসার করতে পারব না_এমন কথাও বলে সে। বিষয়টি আমার মেয়ে জানতে পারে।'
হাফিজা বেগম জানান, ১৩ অক্টোবর রাতের ঘটনার পরদিন তিনি সেঁজুতিকে নিয়ে বাকেরগঞ্জ থানায় যান। ওসি সৈয়দ রবিউল ইসলামকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানান। অভিযোগটি মামলা হিসেবে না নিয়ে পরদিন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আফজাল হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি অভিযোগের সত্যতা পান। পুলিশ বিষয়টি মীমাংসার জন্য রঘুনাথপুর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আজিজ মৃধাকে দায়িত্ব দেয়। তিনি উভয় পক্ষকে নিয়ে সমঝোতায় ব্যর্থ হন। ফলে ১৭ অক্টোবর হাফিজা বেগম থানায় গিয়ে সাত আসামির বিরুদ্ধে অপহরণ চেষ্টার মামলা করেন।
মামলার পরে লাগাতার হুমকি
মামলার এজাহারভুক্ত আসামি নয়ন মৃধার ঘর সেঁজুতির ঘরের সামনে। অন্য দুই আসামি নেছার উদ্দিন ও রাজীবের ঘর খুব কাছাকাছি। রাজীব রঘুনাথপুর ইউনাইটেড মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। অন্যদিকে নেছার উদ্দিন বড় রঘুনাথপুর সালেহীয়া দাখিল মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। থানায় মামলা করার পর নয়নের মা আশ্রু বেগম ও রাজীবের মা রুশিয়া বেগম মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দেয়। প্রতিদিন তারা সেঁজুতির ঘরে এসে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করত। বাড়িতে শুধু সেঁজুতি, তার মা আর ছোট বোন একই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী লাইজু আক্তার থাকে। এমনকি তারা সেঁজুতির প্রবাসী বাবা মো. সাদেকুর রহমানের মুঠোফোনে ঘটনার বিকৃতি ঘটিয়ে বিভিন্ন তথ্য দেয়। এতে বিভ্রান্ত হয়ে সেঁজুতির বাবা মামলা করা নিয়ে স্ত্রীর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এতে রাগে-দুঃখে শুক্রবার সকালে মা সেঁজুতিকে বকাঝকা করেন।
হাফিজা বেগম বলেন, আসামিদের অভিভাবকরা বিষয়টি মীমাংসা করার জন্য বলেছিল। ধর্ষণের বিষয়টি সালিস বৈঠকে উঠে আসতে পারে, তাই শুরু থেকে সালিসে আপত্তি করি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, 'আমি সন্তান হারিয়েছি, এখন ধর্ষণের বিষয়টি চেপে যেতে চাই না, যারা আমার নিষ্পাপ মেয়েটিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল তাদের ফাঁসি চাই। প্রশাসনের কাছে আমার অনুরোধ, আমি জীবিত অবস্থায় যেন আসামিদের শাস্তি দেখে যেতে পারি।'
সেঁজুতির বড় বোন, ঢাকার কবি নজরুল কলেজের ছাত্রী শিল্পী আক্তার বলেন, 'ঘরে মা আর ছোট দুটি বোন থাকে। প্রায় রাতেই বখাটেরা ঘরের চালায় ঢিল ছুড়ত। বিষয়টি স্থানীয় লোকজন জানে। কিন্তু তারা বখাটেদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ব্যবস্থা নিলে অকালে আমার বোনটিকে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যেতে হতো না।' নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রতিবেশী বলেন, নয়ন বখাটে। তার বাবা-মা বেশির ভাগ সময় তাকে একা রেখে চট্টগ্রামে অবস্থান করে। এই ফাঁকে সে ঘরে মাদকের আখড়া বসায়।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
সেঁজুতির মৃত্যুর সংবাদ শনিবার সকালে তার স্কুলে পেঁৗছালে সহপাঠীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। একপর্যায়ে কয়েক শ শিক্ষার্থী চৈতা স্কুল থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কাঁঠালতলী পুলিশকেন্দ্র ঘেরাও করে। পরে কাঁঠালতলী-চৈতা সড়ক অবরোধ করে। বিক্ষোভ সমাবেশে সহপাঠী ইসরাত জাহান স্বর্ণা, রুবি আক্তার, কুলসুম আক্তার, রাকিব হোসেন, সোহাগ রহমান বক্তব্য দেয়। তারা বলে, সেঁজুতি হত্যার সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসি দিতে হবে। যত দিন পর্যন্ত আসামিরা গ্রেপ্তার না হয়, তত দিন পর্যন্ত ক্লাস বর্জন কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মো. জাফর ইকবাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বাচনিক পরীক্ষা ১৯ অক্টোবর শেষ হয়েছে। ১৮ অক্টোবর সেঁজুতি ভূগোল পরীক্ষা দিয়েছে। ওই দিন তার মুখে বিমর্ষ ভাব লক্ষ করেছি। কিন্তু ভাবিনি এভাবে ও চলে যাবে।'
বিক্ষোভ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন মাধবখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, 'অভিযুক্তরা বখাটে। তাদের কোনো দল নেই।' তবে এলাকাবাসী জানিয়েছে, তারা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের মিছিল-সমাবেশে অংশ নিত। পাদ্রিশিবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল বাশার হারুন বলেন, 'আসামিরা বখাটে। ওদের বিরুদ্ধে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্তদের শাস্তি কামনা করছি।'
চৈতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সদস্য আ. বারেক হাওলাদার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সাদেকুর রহমানের অনুপস্থিতিতে ওর পরিবারের দেখাশোনা আমি করতাম। মামলার বিষয়টি ওর পরিবার আমাকে না জানিয়ে করেছে। সেটি সাদেকুর রহমানকে আমি জানিয়েছি। এ ঘটনার জের ধরে হয়তো বা তাদের পরিবারে বিরোধের ঘটনা ঘটেছে।'
পুলিশ প্রশাসনের বক্তব্য
ঘটনার চার দিন পর মামলা গ্রহণ প্রসঙ্গে বাকেরগঞ্জ থানার ওসি সৈয়দ রবিউল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঘটনার পর পুলিশ পাঠিয়েছিলাম। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সেঁজুতির মাকে অভিযোগ দিতে বলি। প্রথম অভিযোগটি অসম্পন্ন থাকায় মামলাটি নিতে দেরি হয়। এজাহারে বাদীই ধর্ষণের অভিযোগ তোলেননি, তাই ওই ধারায় মামলা করা হয়নি। তবে ময়নাতদন্তে বিষয়টি এলে ধর্ষণের ধারা যুক্ত করা হবে।'
পুলিশ সুপার দেবদাস ভট্টাচার্য কালের কণ্ঠকে বলেন, স্কুলছাত্রীর আত্মহননের নেপথ্যে পুলিশ প্রশাসনের গাফিলতি রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। তিনি পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। সেখানে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনার পর দেরিতে মামলা নেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.