আধঘণ্টা বৃষ্টিতেই কেন পুরো দিনের খেলা বাতিল হবে! by নোমান মোহাম্মদ,

স্টেডিয়ামের আকাশটা ওরা দখল করে ছিল দিন কয়েক ধরেই। অঝোর কান্নায় ঝরেনি, প্রচ্ছন্ন একটা হুমকি হয়ে উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল কেবল। মেঘলা ওই আকাশের নিচে মঞ্চস্থ হলো বাংলাদেশ ক্রিকেটের ওই ৬১-মহাকাব্য। মাঝের দুই দিন পেরিয়ে টেস্টের প্রথম দিনও কাটল নির্বিঘ্নে। আর কত! বুকে জমানো কান্না পরশু রাতে ঝরিয়ে দিল মেঘদল। হেমন্তকালের নিশুতিতে বর্ষা মনে করিয়ে দেওয়া ঝুম বৃষ্টিতে। ব্যস, তাতেই কম্ম সারা! কাল সাতসকালে, সকাল সোয়া ১১টায়ই বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্টের দ্বিতীয় দিনের খেলা পরিত্যক্ত ঘোষিত।


ক্রিকেটের সঙ্গে বৃষ্টির যোগসূত্র চিরকালীন। খেলাটি যেহেতু দীর্ঘ সময়ের আর সেখানে বল-উইকেট অক্ষত রাখার ব্যাপার-স্যাপারও আছে, তাই বৃষ্টি সব সময়ই ক্রিকেটের বৈমাত্রেয় ভাই। তার পরও কিন্তু বিশ্বের সব স্টেডিয়ামেই বৃষ্টি পাত্তা না দিয়ে ক্রিকেট হচ্ছে। হচ্ছে মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেও। হয় না খালি এই চট্টগ্রামের জহুর আহেমদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। কারণ এখানকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। সেটি এমনই মান্ধাতা আমলের যে কাল চাইলে কোনো কৃষক গিয়ে মাঠে ফসলের বীজ বুনে আসতে পারতেন! গৃহস্থ এটিকে পুকুর ভেবে ছেড়ে দিতে পারতেন মাছের পোনা!
এমন নয় যে সমস্যাটি নতুন। অর্ধযুগ আগে সাগরিকায় এই খেলার নন্দনকাননের পথচলা শুরু হওয়ার সময় থেকেই গলার কাঁটা হয়ে আছে এই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। সমুদ্র তীরবর্তী শহর বলে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত হয় প্রচুর। এখানে আন্তর্জাতিক সিরিজের আয়োজন মানেই তাই আয়োজকদের আকাশের পানে তাকিয়ে থাকা। সেখানে মেঘ গুড়গুড় করে তো সমান্তরালে তাঁদের বুকেও পড়ে ঢোলের বাড়ি। এমন এক-দুদিন বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া এখন প্রায় নিয়মে পরিণত।
কিন্তু এমন কেন হবে? বিশ্বকাপের আগে অনেক সময় থাকা সত্ত্বেও ঠিক করা যায়নি ড্রেনেজ ব্যবস্থা। দোষটা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) নাকি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের, সেটি বিতর্কের। কিন্তু ক্রিকেটের অভিভাবক হিসেবে এটির দায় কিভাবে এড়াবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড? বিসিবির পরিচালক ও গ্রাউন্ডস কমিটির প্রধান শফিকুর রহমান মুন্না অবশ্য দিব্যি দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন এনএসসির ঘাড়ে, 'স্টেডিয়ামের মালিক তো এনএসসি। তারা কাজ না করালে আমাদের কী করার আছে। তারা বিশ্বকাপের পর বাজেট অনুমোদন করেছিল, সেটা যথেষ্ট ছিল না। এখন বলছে, আগামী বাজেটে টাকা দেবে। প্রেসিডেন্ট (আ হ ম মোস্তফা কামাল) অবশ্য বলেছেন, এনএসসি না দিলে এবার আমরা নিজেরা কাজ করব।' এই যে প্রাগৈতিহাসিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে দিনের খেলা ভেস্তে গেল, এটি নিয়েও বিব্রত হতে দেখা গেল না তাঁকে, 'না এটা তো ঠিক বিব্রতকর ব্যাপার নয়। আমরা তো সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কাভার দিয়ে পুরো মাঠ ঢেকে ফেলা হয়েছে। তার পরও কিভাবে যেন পানি ঢুকে পড়ল! আসলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই তো। আশা করছি, খুব দ্রুত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা হয়ে যাবে।'
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিরাজুদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর অবশ্য ভীষণ বিব্রত। আর সেটি স্বীকারে অকপটও তিনি, 'আমাদের জন্য এর চেয়ে অস্বস্তিকর আর কিছু নেই। বিশ্বাস করুন, আন্তর্জাতিক সিরিজের সময় আকাশে মেঘ থাকলেই রাতে ঘুম হয় না।' কিন্তু শুধু নিজের ঘুম হারাম করে লাভ কী? আলমগীর তাই এবার কাজে নেমে পড়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন, 'আমি এটি লিখিত আকারে বোর্ডকে জানাব। আগামী মিটিংয়ে যেন এজেন্ডা আকারে ওঠে, সে জন্য নোটিশ দেব। আমরা চাই মাঠের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক না করে আর যেন এখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না হয়। কী হবে তখন? এমন তো নয় যে দেশে বিকল্প ভেন্যুর অভাব আছে। ফতুল্লায় স্টেডিয়াম আছে, বগুড়া-খুলনায় আছে। আমরা চাই চট্টগ্রামে আবার যখন খেলা হবে, যেন সব পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক হয়েই হয়। আমাদের যেন বারবার অস্বস্তিতে না পড়তে হয়।'
বিশ্বকাপের আগে এই মাঠের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা আধুনিক করার জন্য আর্থিক বরাদ্দ ঠিকই ছিল এনএসসির। কিন্তু প্রায় তিন কোটি টাকা আবার ফেরতও চলে গেছে। সময় স্বল্পতার কারণে নাকি এখানে তা করা যায়নি। শফিকুরের এমন দাবির সঙ্গে খানিক ভিন্নতা আছে আলমগীরের, 'ব্যাপারটা যত না সময়ের দোহাই, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি। তাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক নানা কথায় আমাদের তা-ই মনে হয়েছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে বোঝালে তারা ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বুঝবে। ৩০-৪০ লাখ টাকা বাড়িয়েও হলেও এই কাজটি করে ফেলা প্রয়োজন। তিন শ-সাড়ে তিন শ কোটি টাকার স্টেডিয়াম তো আর তিন-সাড়ে তিন কোটি টাকার জন্য এভাবে জলে ভেসে যেতে পারে না।'
অর্ধযুগ ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কত উজ্জ্বল দিনের সাক্ষী এই ক্রীড়া স্থাপনা। অথচ জন্মলগ্ন থেকে সেটি আক্ষরিক অর্থেই ভেসে চলেছে জলে! জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের এই বুকভরা কান্না মুছবে কবে?

No comments

Powered by Blogger.