লিবিয়ার 'মুক্তি' ঘোষণা আজ-গাদ্দাফির দাফন হয়নি ঘটনার তদন্ত হবে

লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির মরদেহ এখনো পড়ে আছে মিসরাতার পুরনো মাংস-বিপণির সেই ফ্রিজে। নতুন ক্ষমতাধারী ব্যক্তিরা এখনো তাঁর ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারেননি। এরই মধ্যে নতুন যুগের শুরু হতে যাচ্ছে লিবিয়ায়। আজ রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির 'মুক্তি' ঘোষণা করবে ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এনটিসি)।এদিকে গাদ্দাফি জীবিত ধরা পড়ার পর কিভাবে নিহত হলেন, সে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য চাপ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। জাতিসংঘ ও গাদ্দাফির পরিবার মৃত্যুর ঘটনার পূর্ণ তদন্ত দাবি করেছে। এনটিসির যোদ্ধারা শুরু থেকেই গাদ্দাফির লাশের ময়নাতদন্ত না করার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেয়।


তবে শেষ পর্যন্ত লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে বলে এনটিসির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। কিন্তু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি। মৃত্যুর ঘটনার তদন্তও করা হবে বলে তিনি জানান।
অন্যদিকে গাদ্দাফির অনুসারীদের সঙ্গে এনটিসি যোদ্ধাদের সর্বশেষ প্রবল লড়াই হয়েছিল সাবেক এই শাসকের জন্মশহর
সার্তে। গাদ্দাফি নিহত হওয়ার পর তাঁর সমর্থক যোদ্ধারা নীরবে ঘরে ফিরে গেছে। শান্ত হয়ে এসেছে সার্ত। অন্য অঞ্চলেও লড়াইয়ের খবর পাওয়া যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার গাদ্দাফি এনটিসি যোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ার মুহূর্তে আসলে কী ঘটেছিল তা নিয়ে এরই মধ্যে নানা সংশয় ও প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত দুটি ভিডিওচিত্রে দুই ধরনের পরিস্থিতি প্রকাশ পেয়েছে। একটিতে গাদ্দাফিকে জীবিত এবং অন্যটিকে মৃত দেখা গেছে। মাঝখানে কী ঘটেছিল তা রহস্যাবৃত। এ কারণে রাশিয়া, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও গাদ্দাফির বিধবা স্ত্রী ওই ঘটনার তদন্ত দাবি করেছেন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতা মুস্তফা আবদেল জলিল বলেন, গাদ্দাফি নিহত হওয়ার সময়কার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে মিসরাতার সামরিক নেতারা বলছেন, ওই তদন্তের মধ্যে গাদ্দাফির লাশের ময়নাতদন্ত থাকবে না। মিসরাতা মিলিটারি কাউন্সিলের মুখপাত্র ফাথি আল-বাশাঘা বলেন, 'আজ বা অন্য কোনো দিন ময়নাতদন্ত হবে না। কেউ তাঁর (গাদ্দাফি) লাশ কাটতে পারবে না।' মিসরাতার অন্য দুই সামরিক প্রধানও বাশাঘার বক্তব্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে গাদ্দাফিকে হত্যার মধ্য দিয়ে এনটিসির অভিযান শেষ হয়েছে। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে গাদ্দাফিমুক্ত লিবিয়া ঘোষণা করা হবে। এ ব্যাপারে এনটিসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'আজ বিকেল ৫টায় (স্থানীয় সময়) বেনগাজি থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হবে।' প্রসঙ্গত, গত ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়ার দ্বিতীয় বড় শহর বেনগাজি থেকেই গাদ্দাফি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে এনটিসি যোদ্ধারা। এখনো তাদের ঘাঁটি ওই শহরেই।
এনটিসির অন্যতম মুখপাত্র আবদেল রাহমান বাসিন বলেন, বেনগাজির ওই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে। আজকের ঘোষণার মধ্য দিয়ে লিবিয়া গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করবে।
তবে দেশটির নতুন ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে শিগগিরই বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে কামড়াকামড়ি শুরু হবে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। মিসরাতায় এনটিসির এক ফিল্ড কমান্ডার বলেন, গাদ্দাফির মৃত্যুতে প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। তবে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে নতুন সমস্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কমান্ডার বলেন, 'ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটিই এখন শঙ্কার বিষয়। এখন গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে লড়াই শুরু হবে। একদিকে জিনতান ও মিসরাতা; অন্যদিকে বেনগাজি ও পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা। এ ছাড়া যোদ্ধাদের অভ্যন্তরীণ সংঘাতও রয়েছে।' তাঁর মতে, 'এখন সবাই পিঠার (ক্ষমতা) অন্তত একটা টুকরা পেতে চাইবে।'
আট মাসের মধ্যে নির্বাচন : আট মাসের মধ্যে লিবীয়দের ভোটে একটি জাতীয় পরিষদ নির্বাচিত হওয়া উচিত। ওই পরিষদ একটি নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করবে। লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল গতকাল শনিবার এ কথা বলেন। এ ছাড়া লিবিয়া পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
জর্ডানে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে জিবরিল বলেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুর পর প্রধান কাজ ছিল লিবিয়ার সড়কগুলো থেকে অস্ত্র উঠিয়ে নেওয়া। পাশাপাশি স্থিরতা ফিরিয়ে এনে জাতীয় ঐক্য গঠনের চেষ্টা করা। মাহমুদ জিবরিল আরো বলেন, 'পার্লামেন্টের মতো করে লিবিয়ার জাতীয় একটি কংগ্রেস গঠনের লক্ষ্যে প্রথম নির্বাচন সর্বোচ্চ আট মাসের মধ্যে সম্পন্ন হওয়া উচিত। এ কংগ্রেসের কাজ হবে দুটি_একটি খসড়া সংবিধান তৈরি করা এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা, যা প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।'
প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিল বলেন, গোটা ব্যাপারটি এখন দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। একটি হলো_সামনের দিনগুলোতে এনটিসি (ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল বা অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় পরিষদ) কী সমাধান দিতে পারে; অন্যটি নির্ভর করছে লিবীয় জনগণের ওপর_তারা অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে আদৌ পার্থক্য করতে চায় কি না। পাশাপাশি জিবরিল বলেন, 'আমরা ৪২ বছর ধরে যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পার হয়ে এসেছি, জনগণ সেটি মাথায় রেখেই সব কিছু বিবেচনা করবে বলে আমার প্রত্যাশা।'
সার্তে কোনো বাংলাদেশি অবরুদ্ধ নেই : লিবিয়ার সার্তে কোনো বাংলাদেশি আর আশঙ্কাজনক বা অবরুদ্ধ অবস্থায় নেই। গতকাল শনিবার রাতে ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর মোহাম্মদ আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে এ কথা জানান। তিনি আরো জানান, লিবিয়ায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন। তাঁদের অবস্থা স্বাভাবিক বলে দূতাবাস বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছে। উল্লেখ্য, সার্ত অভিযানের সময় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের সর্বশেষ অবস্থা জানতে গতকাল রাতে কালের কণ্ঠ থেকে টেলিফোনে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে শ্রম কাউন্সিলর মোহাম্মদ আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকী বলেন, সার্ত এখন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সেখানে বাংলাদেশি ১১টি পরিবার ছিল। এর মধ্যে ৯টি আগেই সার্ত থেকে বের হয়ে পড়েছিল। বাকি দুটি পরিবারকে লিবিয়ার সরকারি বাহিনী গত সোমবার উদ্ধার করে। বাংলাদেশিদের সঙ্গে দূতাবাসের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে এবং তাঁরা সবাই ভালো আছেন।
লিবিয়া থেকে বাংলাদেশিরা ফিরতে চাইছেন কি না জানতে চাইলে আহসান কিবরিয়া জানান, গতকালও (শনিবার) তিনি ত্রিপোলিতে কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে কাজ করছেন এবং ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি।
আহসান কিবরিয়া আরো জানান, যাঁরা আগ্রহী ছিলেন তাঁরা আগেই লিবিয়া ছেড়েছেন। তা ছাড়া এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘাত শুরুর সময় লিবিয়ায় ৬০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এরপর ৩৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশি লিবিয়া ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাসহ (আইওএম) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ওই বাংলাদেশিদের প্রত্যাবাসন করেছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে লিবিয়ার নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সূত্র : এএফপি, বিসিসি, সিএনএন, টেলিগ্রাফ ও জিনিউজ অনলাইন।

No comments

Powered by Blogger.