চতুর্থ দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক সম্মেলনে দ্রুত মাশুল নির্ধারণের তাগিদঃ প্রস্তুতি ছাড়া ট্রানজিট নয়

বকাঠামোর অভাব এবং প্রস্তুতি না থাকায় ভারতকে এখনই নিয়মিত ট্রানজিট দেওয়াটা ঠিক হবে না। আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতকে কেবল পরীক্ষামূলকভাবে ট্রানজিট দেওয়া যেতে পারে। এই ট্রানজিটের জন্য ভারত থেকে যে মাশুল নেওয়া হবে, সেটিও দ্রুত নির্ধারণ করাটা জরুরি। গতকাল রোববার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে চতুর্থ দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে দক্ষিণ এশিয়ার সড়ক যোগাযোগবিষয়ক অধিবেশনে এসব কথা বলা হয়েছে।

অধিবেশনে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যোগাযোগ অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় কার্যকর যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তযোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘মন্দা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি, নতুন ঝুঁকি এবং টেকসই উন্নয়ন: দক্ষিণ এশীয় অবস্থান পুনর্বিবেচনা’। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য ২০০৮ সালে গঠিত এসএইএসের প্রথম সম্মেলন ওই বছরই কলম্বোতে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০০৯ সালে দিল্লি, ২০১০ সালে কাঠমান্ডু এবং এবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে চতুর্থ সম্মেলন। দক্ষিণ এশিয়ার আট সদস্য দেশের ৬২ জন এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার ২১ জন প্রতিনিধি এবারের সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন।
ট্রানজিট প্রসঙ্গ: অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এম রহমতউল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারত এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পণ্য পরিবহন করলে সময় ও অর্থের সাশ্রয় হবে। এই সাশ্রয়ের একটি অংশ অবশ্যই বাংলাদেশের পাওয়া উচিত।
মুক্ত আলোচনা পর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, বলা হয়েছিল যে ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের বিপুল আয় হবে। এখন তো সেই আয় ৫০ লাখ হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি বলেন, ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের যে সাশ্রয় হবে, ন্যায্যতার ভিত্তিতে তা বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করা উচিত।
ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিপক্ষে মত দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ট্রানজিট চালুর জন্য ছয় লেনের সড়ক প্রয়োজন। আমাদের তো তা নেই। তা ছাড়া ভারত যে ট্রানজিটের কথা বলছে, তাতে চীন কিংবা মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নেই। ভারত আসলে করিডর চায়। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অস্ত্র ও সৈন্য পরিবহনের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের জনগণকে দাবিয়ে রাখতে চায়। কাজেই ভারতকে এটা দেওয়া যায় না।
প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা: অধিবেশনে দক্ষিণ এশিয়ার যোগাযোগব্যবস্থা বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে নেপালের হিমাল পত্রিকার সম্পাদক কনক মনি দীক্ষিত বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় পণ্য ও মানুষের চলাচল অবাধ করতে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। এ জন্য চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সালমান জহির বলেন, অনেক সম্ভাবনা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্য ও যোগাযোগ বিস্তৃত না হওয়ার মূল কারণ দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। আর দৃষ্টিভঙ্গির এই সমস্যা দূর করতে হলে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে হবে।
এম রহমতউল্লাহ বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থাকলে যত চেষ্টাই করা হোক, দক্ষিণ এশিয়ায় কার্যকর যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা সফল হবে না। তিনি ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত তাদের দুই দেশের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে ট্রানজিট চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে এ বিষয়ে সম্প্রতি অগ্রগতি হয়েছে। অথচ পাকিস্তান ও ভারতের যোগাযোগব্যবস্থার বিষয়ে প্রচুর সম্ভাবনা সত্ত্বেও এ নিয়ে অগ্রগতি হচ্ছে না।
অধিবেশনে তিনটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান কে এল থাপার, জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অমিতা বাত্রা, পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসের জ্যেষ্ঠ গবেষক গোলাম সামাদ এবং শ্রীলঙ্কার ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজের গবেষক আনুশকা বিজয়াসিংহা।
বিষয়টি নিয়ে অধিবেশনে আলোচনায় আরও অংশ নেন সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আনিসুল হক, সাবেক বাণিজ্যসচিব সোহেল আহমেদ চৌধুরী, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের প্রধান মহিউদ্দিন আহমেদ, পোশাক রপ্তানিকারক রুবানা হক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ আশরাফুল আলম সরকার।
সুপারিশ: অধিবেশনের সবার আলোচনার ভিত্তিতে সুপারিশগুলো উপস্থাপন করেন এম রহমতউল্লাহ। সুপারিশে বলা হয়েছে, যোগাযোগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত যেসব সমস্যা রয়েছে, তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দূর করতে হবে। এ ছাড়া চার ও ছয় লেনের সড়ক তৈরির আগে শুরুতে দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রানজিট চালুর ক্ষেত্রে রেলওয়ে ও অভ্যন্তরীণ নৌপথকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে।
অধিবেশনে ট্রানজিটের আগে ট্রানশিপমেন্ট চালুর সুপারিশ করে বলা হয়, যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করার বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। তবে সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার সময় মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়াতে ভিসার প্রক্রিয়া সহজতর করার বিষয়টিকে নজর দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি যোগাযোগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাণিজ্য বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
অধিবেশন থেকে উঠে আসা সুপারিশ আগামী ৯-১১ নভেম্বর মালদ্বীপে অনুষ্ঠেয় সার্ক সম্মেলনে বিবেচনার জন্য পাঠানো হবে।

No comments

Powered by Blogger.