নৈতিকতা শিখিয়ে দুর্নীতি রোধ!সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল by আবুল কাশেম ও ওমর ফারুক

আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি রোধের নানা চেষ্টা হয়েছে। তার সবই গেছে বিফলে। এবার তাই সব সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের নৈতিকতা শেখানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার।
এরই অংশ হিসেবে 'সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় : জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল' শিরোনামে একটি কর্মপরিকল্পনা অনুমোদন করেছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত এ-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে মন্ত্রী, বিচারক এবং সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের আয় ও সম্পদের হিসাব বছরে একবার জমা নেওয়া, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মেধার মূল্যায়ন, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর ভ্যাট ও কর পরিশোধের ওপর নজরদারি বাড়ানো এবং আয়কর ও শুল্ক পরিশোধে ফাঁকি বন্ধ করতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সুপারিশ এসেছে। এ ছাড়া দুর্নীতিগ্রস্তদের প্রকাশ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ারও কথা বলা আছে এতে। একই সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সৎ কর্মকর্তাদের প্রতিবছর পুরস্কার দেওয়ার উদ্যোগও থাকছে।
রাষ্ট্র ও সমাজে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা, নৈতিকতার মানোন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে গত ৯ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আয়োজিত এক কর্মশালায় এসব সুপারিশ এসেছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের সার্বিক বিষয় দেখভালের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় শুদ্ধাচার উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞার সরাসরি তত্ত্বাবধানে ওই বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে 'জাতীয় শুদ্ধাচার বাস্তবায়ন ইউনিট' গঠন করা হয়েছে। শুদ্ধাচার কৌশল জাতীয় পাঠ্য পুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত করা হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব ড. আবু শাহীন মো. আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, "রাষ্ট্র ও সমাজে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা, নৈতিকতার মানোন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার 'সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় : জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল' (এনআইএস) অনুমোদন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গত ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় শুদ্ধাচার উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিকতা কমিটি গঠন করা হয়েছে।"
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে গত ৯ ও ১৬ জুন জাইকার সহযোগিতায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দুটি কর্মশালার আয়োজন করে। প্রথম দিনের কর্মশালায় উদ্বোধনী বক্তব্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা বলেন, প্রথমে জনপ্রশাসনে দুর্নীতি ঠেকিয়ে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা হবে। জনপ্রশাসনে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হলে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য জায়গাতেও উন্নতি হবে। ওই কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী সরকারি কর্মকর্তাদের তিনটি গ্রুপে বিভক্ত করে তাঁদের কাছ থেকে পরামর্শ চাওয়া হয়। এর মধ্যে গ্রুপ 'বি'-এর সুপারিশে বলা হয়েছে- আর্থিক আইনগুলো কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং সব সরকারি কর্মকর্তাকে বছরে একবার তাঁদের সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে। তবে 'সি'-এর সুপারিশে আরো এক ধাপ এগিয়ে বলা হয়েছে, সব সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, বিচারক ও মন্ত্রীকে বছরে একবার তাঁর সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএ, এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ী সংগঠনের দুর্নীতি, শুল্ককর ফাঁকি রোধে মোবাইল কোর্ট চালুর সুপারিশও করে 'সি' গ্রুপ।
গত ১৬ জুন এ বিষয়ে আরেকটি কর্মশালা করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভঁূইঞা এ কর্মশালায়ও প্রধান অতিথি ছিলেন। মূলত বিভিন্ন পরিকল্পনা কত দিন মেয়াদে ও কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তা নির্ধারণ করতে ওই কর্মশালার আয়োজন করা হয়। ওই কর্মশালায় সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও জাইকা মিশনের সিনিয়র ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট আলী ইমাম মজুমদার বলেন, দুর্নীতি কমিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো অনেক বেশি হতো। ভারতের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজ্য বিহারের জিডিপির প্রবৃদ্ধি অন্য সব রাজ্যের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু ২০০৬ সালে নীতিশ কুমার মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বড় ধরনের সংস্কার করে তাঁর রাজ্যে দুর্নীতি কমিয়ে আনেন। ফলে স্বল্প সময়ে রাজ্যটির প্রবৃদ্ধিও অনেক বেড়েছে।
দ্বিতীয় কর্মশালায় এক মাসের মধ্যে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নৈতিকতা কমিটি গঠন করার কথা উল্লেখ করে তাদের জন্য ২৭টি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে, এই কমিটি তিন মাস অন্তর বৈঠক করে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ ও সময়ভিত্তিক বাস্তবায়ন পরিকল্পনা তৈরি করবে। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হবে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কেউ কোনো অভিযোগ করলে তা দ্রুততর সময়ের (এক মাস) মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। জনগণ ও সরকারি কর্মকর্তাদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ থাকবে। অসম্পূর্ণ, অপ্রয়োজনীয় ও ত্রুটিপূর্ণ আইন চিহ্নিত করে এক বছরের মধ্যে তা হালনাগাদ করা হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বেশির ভাগ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নৈতিকতা কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমদকে প্রধান করে ওই মন্ত্রণালয় এ কমিটি গঠন করেছে। মহাপুলিশ পরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক আজিজ আহমেদ, আনসার ও ভিডিপি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও রয়েছেন কমিটিতে। এ ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংসদ সচিবালয়, পরিকল্পনা বিভাগও নৈতিকতা কমিটি গঠন করেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

No comments

Powered by Blogger.