জনসংখ্যা ও মানবসম্পদ by একেএম নূর-উন-নবী

বাংলাদেশ ২০১৫ সালে টোটাল ফার্টিলিটি রেট ২.১ শতাংশে নামিয়ে আনবে, এমনটিই নির্ধারিত ছিল। কিন্তু তার আগেই এটা অর্জিত হয়েছে। জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হারেও রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়েছে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পরিবার পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণকারী মোট জনসংখ্যার ৬১ শতাংশ। বাংলাদেশ গণ্য হচ্ছে লো ফার্টিলিটি রেটের দেশে। এ বাস্তবতায় বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, অনেকেরই মনে হতে পারে যে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশের বিশেষ কিছু করার দরকার নেই। এখন আপনাআপনিই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
আরও কিছু চিত্রও উৎসাহব্যঞ্জক। গড় আয়ু বাড়ছে। মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখা নয়, বরং তা বাস্তবেরই কাছাকাছি। নারী শিক্ষা বাড়ছে এবং বিপুল সংখ্যা নারী এখন শিল্প-কৃষিতে উৎপাদনমূলক কাজে নিয়োজিত।
কিন্তু গড় চিত্র দেখে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে সমূহ শঙ্কা। আমাদের দেশের লোকসংখ্যা অনেক। প্রতি বছর ১৮ থেকে ২০ লাখ লোক বাড়ছে। আমাদের জনসংখ্যার বয়স বিন্যাসে দেখা যাবে ১৫ থেকে ৫৯ বছরের লোকসংখ্যা ৬০ শতাংশের মতো। তারা অর্থনীতিতে বিপুল অবদান রাখছে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে, সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নারীর স্বাভাবিক বয়স হচ্ছে ১৫ থেকে ৪৯ বছর পর্যন্ত। আমরা টোটাল ফার্টিলিটি রেট নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি; কিন্তু বছরে ১৮-২০ লাখ জনসংখ্যা বৃদ্ধি তাতে রোধ করা যাচ্ছে না।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আমাদের মনে রাখতে হবে_ বাল্যবিয়ে এবং কম বয়সে মা হওয়া। আইনে আছে, ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে নয়। কিন্তু গড়ে ১৫.৬ বছরেই বিয়ে হচ্ছে মেয়েদের। তবে এটাও হচ্ছে গড়। চর এলাকা কিংবা বস্তি এবং এ ধরনের আরও কিছু এলাকায় আরও কম বয়সে বিয়ে হচ্ছে। এমনকি ১২ বছরে বিয়ের ঘটনাও সংবাদপত্রে নিয়মিত থাকছে। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই সন্তান জন্ম দিচ্ছে কিশোরী বয়সের মেয়েরা। সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি সাংস্কৃতিক নানা কারণে এটা ঘটছে। ১১ জুলাই বিশ্বজনসংখ্যা দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বাছাই তাই সঙ্গত_ 'কৈশোরে গর্ভধারণ, মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ।' জাতিসংঘ বলছে, এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়। প্রতি বছর ১৮ বছরের কম বয়সী এক কোটি ৬০ কিশোরী মা হয়। ৩২ লাখ মেয়ের অনিরাপদ গর্ভপাত ঘটে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি ১০০ মেয়ের মধ্যে ১৯ জন ১৮ বছরের মধ্যেই সন্তান জন্ম দেয়। এদের মধ্যে ৩ জনের বয়স থাকে ১৫ বছর কিংবা তারও কম।
বাংলাদেশকে এ পরিস্থিতির প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদান করতেই হবে। অন্যথায় ২০৫০ সালে লোকসংখ্যা দাঁড়াবে ২২ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০৬০ সালে ২৪ কোটি। তাদের কোথায় থাকার স্থান দেওয়া হবে? কে জোগাবে তাদের মুখের গ্রাস? শিক্ষা-চিকিৎসা এবং এ ধরনের সুবিধা সৃষ্টি করা সহজ নয়।
আমাদের আইন রয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কেবল পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সামাজিক আন্দোলনও জরুরি হয়ে পড়েছে। বর্তমান অবস্থায় মেয়েদের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় স্লোগান হচ্ছে_ ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়, ২১ বছরের আগে মা নয়। সব রাজনৈতিক শক্তি, সামাজিক সংগঠন_ সবাইকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। ক্ষমতা কোন দলে রয়েছে, সেটা বড় কথা নয়। লোকসংখ্যা বাড়ছে এবং তার অনেক মন্দ পরিণতির শঙ্কা রয়েছে।
আমাদের সমাজে নানা ধরনের বৈষম্য রয়েছে। যেমন, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য। শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য। শহরেও দেখি উন্নত ও বস্তি এলাকা। এখন শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রচার চালানোর দরকার পড়ে না। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পরিবার ছোট রাখছে। কিন্তু এরা তো সংখ্যালঘু। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবার এখনও বড়। গ্রাম ও বস্তিতে দেখা যায় হতাশাব্যঞ্জক চিত্র। এক সময়ে পৌরসভার ওপর শহরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ন্যস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে পরিবার পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু তখন ২-৩ শতাংশ লোক ছিল শহরবাসী। এখন তা ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। এদের উল্লেখযোগ্য অংশ বসবাস করে বস্তিতে। তাদের পুষ্টির অভাব। মা পুষ্টিকর ও সুষম খাবার না পেলে সন্তানের স্বাস্থ্য ভালো হয় না। মেধার বিকাশে এ অবস্থা ক্ষতিকর। আমাদের জনসংখ্যা মূলত বাড়ে এই দরিদ্র পরিবারগুলোতে। মা দুর্বল হলে তারা যখন শ্রমশক্তিতে পরিণত হবে, তখন তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত উৎপাদনশীলতা পাওয়া যাবে না, এটাই বাস্তবতা।
জনসংখ্যা সীমিত রাখতে আমাদের অনেক সাফল্য। বিশ্বসমাজে এটা স্বীকৃত। এখন সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ এবং তাতে জয়ী হতে পারলে বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে প্রকৃত মানবসম্পদে পরিণত করার চেষ্টা সফল হবেই।

স অধ্যাপক ড. একেএম নূর-উন-নবী
উপাচার্য, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.