মাহে রমজান- ত্যাগ ও সংযমে উদ্ভাসিত হোক

আবার এসেছে মাহে রমজান। শাবানের শেষ দিবস শেষের সন্ধ্যার আকাশে বাংলার কৃষকের কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ ঘোষণা করেছে ত্যাগ ও সংযমের মাসের আবাহনী। ধর্মপ্রাণ মুসলমান শবেবরাতের মহিমান্বিত রজনী থেকেই অপেক্ষা করেন রমজানের।
পশ্চিমাকাশে উদিত সরু চাঁদ তাদের আত্মশুদ্ধির প্রশস্ত রাস্তা প্রদর্শন করে। রমজানের অবশ্যকর্তব্যগুলো পালনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী বিশ্বের অন্যান্য মুসলমানের সঙ্গে যোগসূত্র নবায়ন করে নেয়। আমরা জানি, পুরো মাস রোজার মাধ্যমে শুধু পান, আহার ও জৈবিক চাহিদা বর্জনই নয়, আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য অন্তরের লোভ-লালসা ও নেতিবাচক চিন্তাতেও লাগাম টেনে ধরা হয়। রোজা অনুভব করায় ক্ষুধার্ত ও বঞ্চিত মানুষের কষ্ট। ফরজ ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে নানা ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে মাসব্যাপী ধর্মপ্রাণ মানুষ আল্লাহকে স্মরণ করে। রমজান শিক্ষা দেয় ত্যাগের, মিতব্যয়িতার, ভোগ না করে বিলিয়ে দেওয়ার আদর্শ। শেখায় বিত্তবৈভবের গরিমার বদলে স্রষ্টার দরবারে আনুগত্য প্রকাশের মহিমা। দেখিয়ে দেয় সারাদিন পানাহারসহ সব উপভোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ইবাদতের মধ্যে মগ্ন থাকার সৌন্দর্য। দুুঃখজনক হলেও সত্য, রমজানের ত্যাগ ও সংযমের এই শিক্ষা অনেকের জীবনে প্রতিভাত হয় না। ত্যাগের বদলে ভোগ, কৃচ্ছ্রর বদলে অপচয়, অল্প আহারের বদলে ভূরিভোজ, মিতব্যয়িতার বদলে অপব্যয়িতার দেখানেপনা রমজানের সৌন্দর্যকে ম্লান করে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহনশীলতা ও সৌহার্দ্যের বদলে অসহিষুষ্ণ প্রবণতাও দেখা যায়। অতীতে আমরা দেখেছি, এ মাস এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যায়। অতি মুনাফালোভীরা রমজানকেই বেছে নেয় অতি মুনাফা অর্জনের উপায় হিসেবে। এবার অবশ্য বাজারে সেই পুরনো চিত্র নেই। দু'চারটি পণ্যের দাম কিছু বাড়লেও হুজুগ নেই। মঙ্গলবারের সমকালেই প্রতিবেদন রয়েছে যে, রাষ্ট্রায়ত্ত ট্রেডিং করপোরেশন (টিসিবি) তাদের মজুদ নিয়ে বিপাকে পড়েছে। কারণ বাজারে দাম একই থাকায় ডিলাররা মাল খালাসে আগ্রহী হচ্ছেন না। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যের জন্য এই প্রবণতা নেতিবাচক হলেও বৃহত্তর ক্রেতাসাধারণের স্বার্থ বিবেচনায় আমরা স্বাগত জানাতে চাই। আমরা চাই রোজার মাসে বাজার স্বাভাবিক থাকুক। ধর্মপ্রাণ মুসলমানসহ কোনো নাগরিকের জন্যই এই মাসে বাড়তি চাপ তৈরি না হোক। আমরা দেখেছি, বিশ্বের অন্যান্য মুসলিমপ্রধান দেশে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য অনেক ক্ষেত্রে রোজাদারদের প্রতি সম্মানার্থে কমে যায়। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও এমন চিত্র দেখার প্রত্যাশা থাকল। বস্তুত কৃচ্ছ্রর আদর্শ অনুসরণ করলে এ মাসে কেনাকাটার পরিমাণ অনেক কমে যেত এবং ন্যায়ের আদর্শ অনুসরণ করলে এ মাসে অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটার কথাই নয়। শুধু দ্রব্যমূল্যই নয়, শহরজীবনের দৈনন্দিন দুর্ঘটনাগুলোয় বাড়তি মাত্রা যুক্ত হয় এ মাসে। তাই দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি যানজট, যানবাহন স্বল্পতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রেখে রমজানে বিশেষ সরকারি উদ্যোগে ভাটা দেওয়া উচিত হবে না। সিয়াম সাধনার মধ্যেই বিপণি বিতানগুলোয় শুরু হবে ঈদের প্রস্তুতিমূলক কেনাকাটা। মানুষ যাতে সুষ্ঠুভাবে কেনাকাটা করতে পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার কথা এখনই ভাবতে হবে। তবে বাহ্যিক এই আয়োজনগুলোর বাইরে রমজান যদি প্রত্যেক মুসলিমের মনে নতুন আলো জ্বালাতে পারে, সৎ মানুষ হিসেবে সবাইকে নতুন করে উজ্জীবিত করতে পারে, সেটি হবে প্রকৃত চাওয়া। রমজান যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, সহনশীলতা, পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও শ্রদ্ধাবোধের বাণী বয়ে আনে, তার চর্চাই সর্বাগ্রে হওয়া উচিত। স্বাগতম মাহে রমজান।

No comments

Powered by Blogger.