সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়: জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের অভিমত দিনবদলের অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থতাই কারণ by রোজিনা ইসলাম

জাতীয় রাজনৈতিক বিষয় এবং দিনবদলের সনদ বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণেই পাঁচ সিটি করপোরেশনে হেরেছে সরকারি দল। এ মন্তব্য জনপ্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের।
কর্মকর্তাদের মতে, মহাজোট সরকার দিনবদলের যে অঙ্গীকার করেছিল, তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে দিনবদলের সনদে যেসব বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, তা পূরণ করতে পারেনি তারা। এ ছাড়া চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পরও সরকার জনমতকে উপেক্ষা করেছে। নিজেদের ভুল না শুধরে গাজীপুরে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছে।
অন্যদিকে এসব নির্বাচনে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের তেমন তৎপরতাও দেখা যায়নি। এমনকি বিরোধী দলের পক্ষ থেকে ধর্মীয় যে অপপ্রচার চালানো হয়েছে, তার কোনো সদুত্তর তারা দিতে পারেনি। ফলে প্রার্থীর নিজস্ব যে গুণ বা সুনাম ছিল, তা কাজে লাগেনি এই নির্বাচনে। ফলে দলীয় নেতা-কর্মীদের সব কৌশলই ব্যর্থ হয়েছে। প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় ২৫ জন সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব মন্তব্য জানা গেছে। তাঁরা নাম প্রকাশ করতে সম্মত হননি। জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে সরকারি দলের এই পরাজয়ের জন্য পদ্মা সেতু, হল-মার্ক ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের নীতিকে দায়ী করেন তাঁরা। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি বলেও মনে করেন আমলারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুরুত্বপূর্ণ একজন সচিব বলেন, যখন কোনো দল ক্ষমতায় আসে, তখন অনেকাংশে সাংগঠনিকভাবে অকার্যকর হয়ে যায়। প্রশাসনযন্ত্রের ওপর ভর করে সব কাজ সম্পাদন করতে চায়। কিন্তু সরকারকে বুঝতে হবে, প্রশাসন বা পুলিশ নির্বাচনে জয় এনে দিতে পারবে না।
পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ জানতে চাইলে ঊর্ধ্বতন এই সচিব বলেন, প্রতিটি জায়গায় বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা যোগ্য ও ভালো ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ভোটারদের কাছে সেভাবে পৌঁছাতে পারেননি। পরাজয়ের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, দলের মধ্যে শৃঙ্খলা নেই। আর বেশির ভাগ জেলায় মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, সাংসদ, দলীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, প্রশাসন ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। নানা ভোগান্তির শিকার ভোটাররা প্রতিকার না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বক্তব্যর সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জনগণ একতরফাভাবে মহাজোট সরকারকে ভোট দিয়েছিলেন। আর এখন সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে বিকল্প হিসেবে বিএনপিকে ভোট দিয়েছেন জনগণ।
জনাব মজুমদার আরও বলেন, আওয়ামী লীগ মানুষের অনুভূতির মূল্যায়ন করেনি। জাতীয় রাজনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি পদ্মা সেতু ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে অবস্থান ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের বাড়াবাড়ির কারণে মানুষ এমনিতেই ক্ষুব্ধ। তা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনে তেমন কার্যকর ভূমিকাও রাখতে পারেনি সরকার। ফলে ভোটাররা তাঁদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন ব্যালটের মাধ্যমে। তিনি বলেন, সরকার লিমনের মামলা প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা দুই সপ্তাহ আগে নিলেও অন্তত কয়েক হাজার ভোট বাড়ত। এ রকম আরও অনেক বিষয় রয়েছে, এসব ক্ষেত্রে সরকার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের শুধরে নিতে পারে। সর্বোপরি এই নির্বাচনের ফলাফল বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
জনপ্রশাসন বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক নানা বিষয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিষয়ও স্থানীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। এই ফলাফল আগামী জাতীয় নির্বাচনকেও প্রভাবিত করবে। অর্থনৈতিক কোন বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই শেয়ারবাজারের প্রাইমারি শেয়ার কিনেছিলেন। এমনকি অনেক মন্ত্রণালয় থেকে কম মূল্যে তাঁদের প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনতে উৎসাহী করা হয়েছিল। যুগ্ম সচিব পর্যায় থেকে ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাও এই শেয়ার কিনেছিলেন। কিন্তু আজ তাঁদের একটি টাকাও শেয়ারবাজারে নেই, উল্টো তাঁরা ঋণগ্রস্ত। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনি কি মনে করেন, ওই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আর আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন?
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রিসভায় যে রদবদলের দরকার ছিল, তা যেমন করা হয়নি, তেমনি সাংসদেরা কী করছেন, তারও খোঁজখবর রাখেননি প্রধানমন্ত্রী। সাংসদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে বা পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে গত সাড়ে চার বছরে অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে উপজেলা চেয়ারম্যান ও সাংসদের বিরুদ্ধে যেসব খবরদারির অভিযোগ উঠেছে, তা-ও খোঁজ করে দেখা হয়নি। সবাই ব্যস্ত ছিলেন বাণিজ্য আর বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো জোরদার করার বিষয়টি তাঁদের চিন্তায় আসেনি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে রক্ষার জন্য সরকার যা করেছে, তা মানুষের মনে গেঁথে গেছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যেমন এ বিষয়টি অনেক বড় প্রভাব ফেলেছে, তেমনি জাতীয় নির্বাচনেও এর প্রভাব থাকবে। মানুষ এখন আর বোকা নেই। টেলিভিশনে ঘণ্টায় ঘণ্টায় সব জানতে পারেন। এ ছাড়া অনুপার্জিত আয়, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালোটাকা এবং পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের যে অঙ্গীকার সরকার করেছিল, তা বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগ ছিল না। এসব কারণে প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা বা স্থানীয় বিষয় ভোটাররা বিবেচনায় নেননি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার তেমন কোনো উদ্যোগই নেয়নি। স্থানীয় পর্যায়ে টিআর, কাবিখা বরাদ্দ পেতে স্থানীয় জনগণকে ক্ষমতাসীনদের ঘুষ দিতে হয়েছে। সরাসরি এ ঘুষ নিয়েছেন দলীয় নেতা-কর্মীরাও। প্রশাসনিকভাবে এমন অনেক অভিযোগ এলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চাকরি দেওয়ার নামে জনপ্রতিনিধিরা স্থানীয় গরিব মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন কিন্তু চাকরি হয়নি। আবার টাকাও ফেরত দেওয়া হয়নি। এমন অনেক ঘটনা ঘটলেও সাধারণ মানুষ কোনো প্রতিকার পাননি। এসব বিষয় নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও সাংসদদের মধ্যে অনেক সময় বাগিবতণ্ডা হয়েছে। পত্রিকায় এ ধরনের খবর ছাপাও হয়েছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত ধর্ম নিয়ে যেভাবে অপপ্রচার-মিথ্যাচার করেছে, তার কোনো জবাব দিতে পারেনি আওয়ামী লীগ। ফলে এসব অপপ্রচার বিশ্বাস করেছেন ভোটাররা।
আইন বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ দেশের মানুষকে প্রতারিত করা সহজ, ভুল বোঝানো সহজ। বিএনপি স্থানীয় নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের অবয়ব দিয়ে আওয়ামী লীগের জন্য জাল ফেলেছে। আওয়ামী লীগ সেই জালে পা দিয়ে নিজেরাই জর্জরিত হয়েছে। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি গত সাড়ে চার বছরে সরকারের কাছ থেকে কিছুই পায়নি। হঠাৎ নির্বাচনের শেষ সময়ে এসে এরশাদ মহাজোটের সঙ্গে আছেন ঘোষণা করলেই তো স্থানীয় নেতা-কর্মীরা তাঁদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলেননি; বরং এসব করে ভোট আরও কমেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তা বলেন, সামান্য ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা, সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যানরা পুলিশকে নির্দেশ দিচ্ছেন মামলা করতে। পুলিশ অজ্ঞাতনামা এক থেকে দেড় শ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করে দিচ্ছে। এরপর যাকে খুশি তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীকে এভাবে হেনস্থা করার ফল কখনোই ভালো হয় না। আর মেয়াদের শুরু থেকেই ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ও বাড়াবাড়ি মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় নয়, এ নির্বাচনে জাতীয় বিষয় কাজ করেছে। মূলত জনগণ সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.