সাদাকালো-বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে এগিয়ে আসুন by আহমদ রফিক

'নর্মদা বাঁচাও' এবং ওই ঘোষণার আহ্বায়ক এখন ইতিহাস, এই অর্থে যে দীর্ঘ সময় শেষে বিষয়টি নিয়ে আর উচ্চবাচ্য নেই। তা সত্ত্বেও ওই আন্দোলন যেমন সাড়া ফেলেছিল, প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল অকুস্থল থেকে দূর পশ্চিমবঙ্গে- সে সব কিছু মিলে ওই আন্দোলন শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, রীতিমতো ঐতিহাসিক।
আজ সময় এসেছে বাংলাদেশে তথা ঢাকায় 'বুড়িগঙ্গা বাঁচাও' আন্দোলন শুরু করার। বুড়িগঙ্গা মরে গেলে এক অর্থে ঢাকা মরবে।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক, কথাটা শুধু বইয়ের লেখা নয়, বাস্তবের সত্য। এ সত্য দীর্ঘদিনের। কিন্তু গত কয়েক দশকে আমাদের এতটাই চরিত্র দূষণ ঘটেছে যে দেশের অস্তিত্ব রক্ষার উৎসেও আমাদের লোভের থাবা নদী দখলের জবরদস্তিতে গিয়ে পৌঁছেছে। তা নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের তৈরি বা তার অগভীর অংশ ভরাট করে ব্যবসা-বাণিজ্য বা বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া যা-ই হোক, উদ্দেশ্য নদী দখল।
বছর কয়েক আগে ঢাকার অদূরে, ঐতিহাসিক শীতলক্ষ্যা নিয়ে একই কাণ্ড- অবৈধ দখল, আদালতের নির্দেশে দখলদারি উচ্ছেদ, কিছুদিন পর আবারও দখল- এ পালা কাগজে পড়েছি। তখন মৃদু আওয়াজ উঠেছিল 'শীতলক্ষ্যা বাঁচাও' এবং তা রাজপথে নয়, কাগজের পাতায়। লিখেছিলেন কয়েকজন। কিন্তু তা আমাদের রাজনীতিসচেতন নাগরিকদের, বুদ্ধিজীবীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। এমনকি সক্রিয় হননি পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের কুশীলবরা। কাগুজে প্রতিবাদ সময়ের ডানায় চড়ে হাওয়ায় উড়ে গেছে। সরকার ও প্রশাসন নীরব।
বুড়িগঙ্গার কাহিনী আরো জটিল, আরো দীর্ঘ। ঢাকার প্রাণ এ নদী নিয়েও অনেক লেখা গত কয়েক বছর ধরে, এমনকি তার আগেও কাগজ ছাপা হয়েছে। অবৈধ দখল, অবৈধ বসতি থেকে আবর্জনা স্তূপে নদীর ধার ঢেকে ফেলার অনাচারে অতিষ্ঠ বুড়িগঙ্গা ক্ষমতা থাকলে চিৎকার করে উঠত 'বাঁচাও, বাঁচাও'। এ নিয়ে ঢাকায় পরিবেশবাদীদের এক সময় কিছুটা সরব হতে দেখেছি। কিন্তু যাদের সচল হওয়া দরকার তারা নীরব, স্তব্ধ, নিষ্ক্রিয়।
চোখের সামনে অত্যাচারে অনাচার, লোভের-লাভের চাপে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে দেখেও আমরা ঢাকার নাগরিকসমাজ প্রতিবাদে সচল হচ্ছি না, আশ্চর্য মনে হচ্ছে। ব্যক্তি বা সংগঠন কেউ নামছে না ঢাকার রাজপথে প্রতিবাদী আন্দোলন সংগঠিত করতে। কেউ ভাবছেন না বুড়িগঙ্গার দূষণ, বুড়িগঙ্গার মৃত্য কী পরিণতি ডেকে আনতে পারে! ইতিমধ্যে সে আলামত তো দেখা দিতে শুরু করেছে ঐতিহাসিক করতোয়ার মৃত্যতে, তিস্তার বিপর্যয়ে।
দেশের কোনো অঞ্চলই জল স্রোতের এ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথের সাধের ইছামতি থেকে মধ্যবঙ্গের নবগঙ্গা বা মধুকবির কপোতাক্ষ- সবাই কম-বেশি নানা কারণে বিপর্যয়ের মুখে। মানুষের সীমাহীন লোভ, রাজনৈতিক অনাচার (যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ), প্রাকৃতিক বিপর্যয়- সব কিছু যেন নদীর জলস্রোতের ওপর আছড়ে পড়ছে। নির্বিকার দেশের বিশেষজ্ঞ বা বুদ্ধিজীবীসমাজ, ততোধিক শাসক শ্রেণী বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
তবে আজকের লেখা মূলত বুড়িগঙ্গা নিয়ে, এর দূষণ ও অবৈধ দখলদারি নিয়ে এবং এ বিষয় সবাইকে প্রতিবাদী হওয়ার আবেদন নিয়ে। এ দায় আমার, আপনার, সবার। পরিবেশবাদীরা অনুগ্রহ করে এগিয়ে আসুন। তাঁদের সর্বশক্তি দিয়ে আওয়াজ তুলুন : 'বুড়িগঙ্গা বাঁচাও'। প্রয়োজনে আসুন রাজপথে নামি, আন্দোলন গড়ে তুলি। বুড়িগঙ্গার পানি শুদ্ধ করার দায়িত্ব নিই। এ পানি তো আমরা নানাভাবে ব্যবহার করেছি, এখনো করছি। অথচ বুড়িগঙ্গার পানি আর ব্যবহারযোগ্য নয়।
শুধু তাই নয়, এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছুকাল পর এ জলপথে নৌকাও চলবে না, জাহাজ-লঞ্চ দূরে থাক। কী হবে তখন ঢাকার? ভেবে দেখেছেন ঢাকার নাগরিকরা? বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বুড়িগঙ্গার পানির ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ও লেখালেখির পরিপ্রেক্ষিতে ট্যানারি বিষাক্ত বর্জ্য নিষ্কাশন বুড়িগঙ্গা দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। বুড়িগঙ্গার দূষণ বাঁচাতে তখন পরামর্শ ছিল হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের।
শুধু পরামর্শ নয়, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যত্র দ্রুত সম্ভব ট্যানারি কারখানাগুলোকে বুড়িগঙ্গাসংলগ্ন এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার। কারো কারো পরামর্শ ছিল এগুলোকে ঢাকা শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া এবং ট্যানারির বর্জ্য আধুনিক পদ্ধতিতে পরিশোধিত করে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু স্থান নির্ধারণ, জমি অধিগ্রহণ ইত্যাদি নানা টালবাহানায় একটি সঠিক সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকে এবং তা ঝুলে আছে দীর্ঘ সময় ধরে। কোনো ব্যবস্থা যে নেওয়া হয়নি, তা বলাই বাহুল্য।
এমনকি বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েও মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করেননি প্রশাসনের কেউ। বিশেষজ্ঞরাও এ বিষয়ে কোনো চাপ সৃষ্টি করেননি। স্বভাবতই নির্বিবাদে চলছে বুড়িগঙ্গায় ট্যানারি দূষণ। এমনকি বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থাও আকাশে উধাও। ফলে ওসব বিষাক্ত বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে বুড়িগঙ্গার পানি। এ ছাড়া রযেছে নানা ধরনের শিল্প বর্জ্য। এত ভার বুড়িগঙ্গা আর বহন করতে পারছে না।
এর পরও গোদের ওপর বিষফোঁড়া। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ট্যানারি ছাড়াও বুড়িগঙ্গা দূষণের আরো একটি প্রধান কারণ ওয়াসার অপরিশোধিত পয়োবর্জ্য, যা কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানেই শেষ নয়। মিটফোর্ড হাসপাতালের জীবাণু দূষিত বর্জ্য থেকে শুরু করে নদীর তীরে বা কাছাকাছি অবস্থিত বাড়িঘর, দোকানপাট, বাজার প্রভৃতি স্থান থেকে টন কে টন আবর্জনা নদীতে ফেলা হচ্ছে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
কাহাতক এসব সহ্য করা যায়! লক্ষ করার বিষয় যে ওয়াসার পয়োবর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় নদীতে ফেলা হচ্ছে। পরিমাণ হিসাব করে কী হবে? তবু ওয়াসার বরাতে দেখা যায়, প্রতিদিন ১২ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার পয়োবর্জ্য বুড়িগঙ্গায় নামছে তাদের কল্যাণে। আর হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো থেকে নামছে প্রতিদিন ২১ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য। এগুলো সবচেয়ে মারাত্মক, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতির কারণে। এবার পাঠক বুঝে দেখুন, বুড়িগঙ্গা কী দারুণ দূষণের আক্রমণে বিপর্যস্ত।
স্বভাবত বিশেষজ্ঞদের হিসাবে বুড়িগঙ্গার পানিতে প্রয়োজনীয় অঙ্েিজন মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে, যা জলজ উদ্ভিদ ও জীবের প্রাণ সংহারের কারণ। সেই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ভয়াবহ মাত্রায় জীবাণুর উপস্থিতি, যা রোগ সংক্রমণের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে। নদী হাতের কাছে থাকলে মানুষ অভ্যাসবশত এর পানি ব্যবহার করে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, বুড়িগঙ্গার পানি এখন সাধারণ ব্যবহারেরও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তা স্পর্শ করাও বিপজ্জনক।
সচেতন নাগরিকসহ সরকার ও প্রশাসনের উদ্দেশে আমাদের আহ্বান, বুড়িগঙ্গা মরে যাওয়ার আগে ঢাকা শহরের (যা এখন মহানগর) কথা ভেবে সত্বর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন বুড়িগঙ্গা রক্ষার। আপাতত ট্যানারিগুলোর যথেচ্ছাচার বন্ধ করা দরকার। তার চেয়েও ট্যানারি কারখানাগুলোর স্থানান্তর ও সেগুলোর বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করায় মালিকদের বাধ্য করা। ওয়াসা বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা নেওয়া এবং নদীকে অবৈধ দখলদারি থেকে মুক্ত করা, অবৈধ স্থাপনা অপসারণ ও নদীতে আবর্জনা ফেলা বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়াও অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক : কবি, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী

No comments

Powered by Blogger.