শনিবারের সুসংবাদ-ফেলনা জিনিসে বিদেশি মুদ্রা by রফিকুল ইসলাম ও মিঠুন পাল

আমাদের অতি পরিচিত ফল নারিকেল। সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফলটি নানা উপাদেয় খাবার তৈরির প্রধান উপকরণ। সে সুবাদে দেশজুড়ে এর কদরও যথেষ্ট। অবশ্য নারিকেলটুকু ব্যবহার হয়ে গেলে বাকিটা কেবলই আবর্জনা। এর মধ্যে ছোবড়ার মোটামুটি ব্যবহার থাকলেও মালা (আইচা) একেবারেই ফেলনা জিনিস।


তবে মালার ক্ষেত্রে 'ফেলনা' শব্দটি অতীত হয়ে গেছে। এই মালায় তৈরি হচ্ছে বাহারি পণ্য। দেশ ছাড়িয়ে তা রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।
বরিশাল মেট্রোপলিটন শহরের অধিবাসী আনোয়ার হোসেন ফেলনা মালার আলাদা কদর এনেছেন। মালা দিয়ে তিনি তৈরি করছেন নানা ধরনের লোভনীয় শো-পিস। এসব বাহারি পণ্য দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি সৌখিনও। পণ্যগুলো ঘরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে কয়েক গুণ। এ জন্য অতি সহজেই তা জায়গা করে নিয়েছে সমাজের মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে ধনীদের ড্রয়িং রুমে। শুধু তাই নয়, আনোয়ার হোসেনের তৈরি 'মালা-পণ্য' কয়েকটি দেশে রপ্তানিও হচ্ছে।
আনোয়ার হোসেনের উদ্যোগে নারিকেলের মালা থেকে আকর্ষণীয় ডিজাইনের যেসব সামগ্রী তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে- ল্যাম্পশেড, ওয়ালমেট, কোস্টার, ফলের ঝুড়ি, টিস্যু বক্স, পেনসিল বক্স, ডাইনিংমেট, ক্যারিংব্যাগ, লেডিস পার্স, অ্যালবাম, মোবাইল ফোন সেটের কভার, পাউডারদানি, চশমাদানি, অলঙ্কারদানি, আগরদানি, বিভিন্ন ধরনের চাবির রিং, মোবাইল স্ট্যান্ড, শো-পিসসহ তিন শতাধিক সৌখিন ও বাহারি পণ্য। এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, ইতালি, নিউজিল্যান্ড ও কানাডায় রপ্তানি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন মার্কেটে এসবের বিক্রি তো আছেই।
যেভাবে শুরু : ১৯৬৮ সালের কথা। মো. আনোয়ার তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। বাবা মফিজ উদ্দিন রংমিস্ত্রির পাশাপাশি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। অভাব-অনটনের সংসার। অতীত রোমন্থন করতে গিয়ে কালের কণ্ঠকে আনোয়ার হোসেন বলেন, 'একদিন বিকেলে নগরীর বিবির পুকুরপার দিয়ে হাঁটছি। প্যান্ট-শার্ট পরা এক লোক ডেকে নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। পরে পকেট থেকে নৌকার মাঝির মতো একটা আকৃতি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, এই কাজ করবা? ছোটবেলা থেকে এসব কাজে আগ্রহ থাকায় রাজি হয়ে যাই। তখন দুইবেলা নাশতা আর একবেলা খাওয়া এবং মাসে ৩০ টাকা মাইনেতে চাকরি নিই। দেড় মাস পর তিনি আমাকে ঢাকায় নিয়ে যান।'
আনোয়ার বলেন, "ঠিকমতো মাইনে না দেওয়ায় চাকরি ছেড়ে নিজেই বাসায় বসে কাঠি গোল করে স্পক দিয়ে ড্রিল মেশিন তৈরি করে কাজ শুরু করি। সে সময় প্রথম আইচা দিয়ে তৈরি করি নৌকা, ফুলের তোরাসহ সাত-আট ধরনের শো-পিস। ঢাকায় থাকতাম এক আত্মীয়ের বাসায়। কিছুদিন পর জানতে পারি, বাসার অদূরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকেন। দেরি না করে একদিন সকালে নিজের হাতে তৈরি শো-পিস নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে কেবল মুক্তি পেয়েছেন তিনি। তাই একটু কড়াকড়ি। প্রবেশ পথেই নিরাপত্তাকর্মীদের তল্লাশি। ভাগ্যক্রমে পরিচয় হয় আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে। তিনিই একটি ট্রেতে করে শো-পিসগুলো বঙ্গবন্ধুর সামনে হাজির করার ব্যবস্থা করেন। পরে আমি ডাক পেয়ে ভেতরে যাই। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করেন, 'এই ছেলে, এগুলো তুমি বানিয়েছ? যদি বলি এখানে বসে তৈরি করতে, পারবে?' ভয়ে ভয়ে বললাম, 'এগুলো আমিই বানিয়েছি, এখানে বসেও বানাতে পারব।' শুনে তিনি খুব খুশি হলেন। জানতে চাইলেন, 'কী চাই তোমার'? বললাম 'বানানোর জন্য যন্ত্রপাতি কিনতে ৩০ টাকা দরকার।' তিনি অবাক হয়ে বললেন, 'মাত্র ৩০ টাকা!' এরপর টাকা নিয়ে বরিশালে চলে আসি। নগরীর শেরেবাংলা সড়কে একটি খুপরি ঘরে কাজ শুরু করি।"
আনোয়ার হোসেন জানান, সাফল্য পেতে তাঁকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। ১৯৮২ সালে আড়ং কম্পানির সঙ্গে তাঁর চুক্তি হয়। এরপর আরো কয়েকটি কম্পানির কাছ থেকে পণ্য সরবরাহের অর্ডার পেয়ে জীবনে সাফল্যের মুখ দেখেন।
কুটিরশিল্পী আনোয়ার জানান, আইচা শিল্প গড়তে তেমন একটা পুঁজির দরকার হয় না। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা হলেই শুরু করা যায়। তবে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আইচা বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা যায়। সাধারণত উপকূলীয় এলাকা স্বরূপকাঠি, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আইচা সংগ্রহ করা হয়। ফেরিওলাদের কাছ থেকেও নেওয়া যায়। আস্ত আইচা সাড়ে সাত টাকা আর অর্ধেক আইচা গড়ে ৬০ পয়সা খরচ পড়ে। আইচাগুলোকে প্রথমে ভালোভাবে পরিষ্কার করে শুকানো হয়। পরে যন্ত্রপাতি আর হাতের কারুকাজে এগুলোকে দৃষ্টিনন্দন নানা রূপ দেওয়া হয়। কিছু কিছু শো-পিসে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ফলের বিচি। তিনি আরো জানান, দুইটি কক্ষ কারখানা হিসেবে ব্যবহার হয়। এখানে প্রায় ১২ জন শ্রমিক কাজ করেন।
এখানে কর্মরত শ্রমিক মোমেনা বেগম বলেন, 'প্রায় ১২ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। মাসে আড়াই হাজার টাকা বেতন পাই। ওভার টাইমের সুযোগও আছে। এখানে কাজ করে বড় মেয়েকে মাস্টার্স পাস করিয়েছি। ছোট মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।'
যাচ্ছে দেশে-বিদেশে : এই কারখানায় তৈরি পণ্য সারা দেশের ব্যবসায়ীরা নগদ অর্থে কিনে নিয়ে যান। আড়ং, নাগরদোলা, আইডিয়া ক্রাফটের মাধ্যমে বিদেশে যাচ্ছে এসব শো-পিস। এ ছাড়া এমএস কম্পানির মাধ্যমে ফেলনা জিনিসের তৈরি পণ্য হিসেবে এগুলো রপ্তানিও হচ্ছে।
এমএস কম্পানির মার্কেটিং ব্যবস্থাপক মামুনুর রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, আইচা দিয়ে তৈরি দৃষ্টিনন্দন পণ্যের বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী সরবরাহ মেলে না। গত মে মাসে প্রায় তিন লাখ টাকা মূল্যের পণ্যের চালান আমেরিকা ও ইল্যান্ডে পাঠানো হয়েছে।
হস্তশিল্পী আনোয়ারের স্বপ্ন কারখানাটি আরো বড় করার। তিনি চান শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলতে। কিন্তু অর্থ সংকটে তা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, সরকারি-বেসরকারি অনেক ব্যাংকে ঋণের জন্য গিয়ে তিনি বিফল হয়েছেন। সবাই পার্সেন্টেজ চায়। শেষ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক কয়েক লাখ টাকার ঋণ দিয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি নানা সময়ে কম-বেশি অনুদান দিয়েছেন। আইচার শিল্পটি সৃজনশীল।
বরিশাল শিল্প নগরীর (বিসিক) উপমহাব্যবস্থাপক মনির আহমেদ বলেন, দেশে হস্তশিল্পের উদ্যোক্তারা পর্যাপ্ত অর্থ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান না। অথচ এই সেক্টরে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.