কালের পুরাণ-সর্বাত্মক আন্দোলন, কার জন্য, কবে? by সোহরাব হাসান

প্রথা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এবারও ঈদের দিন শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। আমাদের নেতা-নেত্রীদের শুভেচ্ছা বিনিময় হলো, তাঁরা সপারিষদ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবেন এবং আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা লাইন ধরে তাঁদের সালাম দিয়ে যাবেন। রাজা-বাদশাহ-নবাবদের আমলে দরবারে গিয়ে সাধারণ মানুষের কুর্নিশ করার যে রেওয়াজ ছিল, বলা যায় এটি তারই আধুনিক সংস্করণ।


এ ধরনের কুর্নিশ অথবা শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি খুশি হন পারিষদেরা। তাঁরা নেতা-নেত্রীকে অত্যন্ত কাছে পান, সালামের সুযোগে নিজের তদবিরের কথাটি জানিয়ে দেন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী, সরকারি দলের অনুষ্ঠানে লাইন দীর্ঘ ও ভিড় বেশি হয়। আর যাঁরা অতিশয় বুদ্ধিমান, তাঁরা বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের লাইনটিও ঠিক রাখেন। এ কারণে নির্বাচন কাছাকাছি এলে বিরোধী দলের লাইনটি বড় হতে থাকে। নির্বাচনের এখনো তিন বছর বাকি। অতএব ইস্কাটনের লাইন বড় হবে, সে কথা কেউ মনে করেন না।
আবার এ ধরনের সভায় অনেকে বাধ্য হয়ে যান। না গেলে পারিষদেরা নানা রং চড়িয়ে প্রচার করবেন, নেত্রী, অমুক অমুক আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই উর্বর দোআঁশ মাটির দেশে সর্বাধিক ফলবান হচ্ছে ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতার আগে থেকেই ষড়যন্ত্রের শুরু। অতি বাম ও অতি ডানপন্থীরা তো মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধই ছিল আওয়ামী লীগ ও ভারতের ষড়যন্ত্রের ফল। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এখন সর্বত্র। দেশ বেচার ষড়যন্ত্র, স্বাধীনতা বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। ইসলামকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। এত ষঢ়যন্ত্রের মধ্যে বাংলাদেশ টিকে আছে, সেটাই অবাক হওয়ার মতো ঘটনা।

২.
সরকার ও বিরোধী দলের এসব সংবর্ধনায় দলীয় নেতা-কর্মী, অনুগত পেশাজীবী ছাড়াও সৌজন্য রক্ষার জন্য যাঁরা আসেন, তাঁরা হলেন বিদেশি কূটনীতিক। দলীয় নেতা-কর্মীদের সুবিধা, তাঁরা এক নেত্রীর কথা শোনেন। কিন্তু বিদেশি কূটনীতিকদের সমস্যা হলো, দুই পক্ষের আমন্ত্রণেই তাঁদের সাড়া দিতে হয়, যেতে হয় এবং ক্যারিকেচার দেখতে হয়। ইদানীং বিদেশি কূটনীতিকেরা বাংলা ভাষাটাও নাকি রপ্ত করেছেন। ফলে দেশের অসুস্থ রাজনীতি সম্পর্কে তাঁদের জানা-বোঝা আরও সহজ হয়েছে। দোভাষীর মাধ্যমে কানাকে আর হাতি দেখানোর সুযোগ নেই।
এবার কূটনীতিকেরা দুই মজলিসে গিয়ে কী দেখলেন, কী শুনলেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘এবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব ভালো। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে আছে। ফলে সবাই আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ করতে পারছে।’
অন্যদিকে ইস্কাটনের মজলিসে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘দেশের মানুষ ভালো নেই, তারা শান্তিতে নেই। দেশের মানুষ কষ্ট ও দুঃখের মধ্যে এবার ঈদ উদ্যাপন করছে। তাদের কাছে ঈদের আনন্দ নেই। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে। বর্তমান সরকার আর বেশি দিন ক্ষমতায় থাকলে দেশ ৪০ বছর পিছিয়ে যাবে। এ কারণে ভবিষ্যতে কোনো সরকারের পক্ষে দেশ চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।’ (বিডি নিউজ ১৬, ১১, ১০)
এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘তারা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) দেশকে ২০ বছর পিছিয়ে দিয়েছে।’ ২০+৪০=৬০!
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৩৯ বছর। মাত্র চার বছরে দুই সরকার মিলে যদি দেশকে ৬০ বছর পিছিয়ে থাকে, তাহলে পূর্ববর্তী সরকারগুলো কত বছর পিছিয়েছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এর মধ্যে আবার বেশি সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। দেশ এগিয়ে থাকলে তার কৃতিত্ব যেমন বিএনপি বেশি দাবি করতে পারে, তেমনি পিছিয়ে গেলে তার দায়ও বিএনপিকে বহন করতে হবে। আমাদের নেতা-নেত্রীদের চোখ সব সময় পেছনে। সামনে দেখতে পান না। না হলে একটি বাড়ি নিয়ে এ রকম বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড কেন ঘটবে? খালেদা জিয়ার বাড়ির বরাদ্দ যত বেআইনীই হোক এভাবে কাউকে বাড়ি থেকে তাড়ানো যায়না। সরকার ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত। করেনি, তাতে জেদ বজায় থাকেনা। খালেদা জিয়াও মামলা না করে বাড়িটি আগেভাগে ছেড়ে দিতে পারতেন। দেননি। তাতে আপসহীন থাকা হয়না।
প্রতিটি দল ক্ষমতায় এসে সর্বাগ্রে দুটি কাজ করে—নিজের নামে বাড়ি বরাদ্দ এবং উত্তর প্রজন্মকে নেতৃত্বের আসনে বসানো—তার যোগ্যতা, লেখাপড়া, দেশ ও দেশের মানুষ সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকুক আর না-ই থাকুক। তারেক রহমান বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান) হয়েছিলেন কি যোগ্যতায়, অভিজ্ঞতায়? একটাই যোগ্যতা—জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়ার পুত্র। এই পুত্র পরিচয়ে আরও কেউ কেউ রাজনীতিতে আসতে চাইছেন। রাজতন্ত্র পাকাপোক্ত করতে চাইছেন।
এসব নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলেই চামচা নেতারা ভারতের উদাহরণ টানেন, আমেরিকার উদাহরন দেন। কিন্তু সেসব দেশে নেতৃত্ব তৈরির জন্য যে অনুশীলন ও পড়াশোনা করতে হয়, এখানে তার বালাই নেই। একুশ শতকে বসবাস করেও তারা উনিশ শতকের মনমানসিকতা পোষণ করেন। মুখে না বললেও রাজতন্ত্র তাদের মনে আছে। পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করেন না।
গণভবন থেকে ইস্কাটনের দূরত্ব তিন কিলোমিটারের বেশি নয়। এর মধ্যে কি দেশটা ওলটপালট হয়ে গেল?
প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে মনে হবে, দেশে এই প্রথম মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ঈদ পালন করতে পারছে। এর আগে কেউ আনন্দমুখর পরিবেশে ঈদ করেনি। আবার বিরোধী দলের নেত্রীর কথা শুনলে মনে হবে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই মানুষের দুর্গতি শুরু হয়েছে। বিএনপির আমলে ঘরে ঘরে সুখের পায়রা উড়ত।
পায়রা না উড়লেও বোমা যে পড়ত, তাতে সন্দেহ নেই।
রাজনীতির পাল্টাপাল্টি থেকে ঈদের এই দুটি দিন কি বাদ দেওয়া যায় না? আপনারা ৩৬৩ দিন রাজনীতি করুন। ঝগড়া-ফ্যাসাদ করুন। অন্তত দুটি দিন মানুষকে এর বাইরে রাখুন। তাদের ঈদ করতে দিন। শুভেচ্ছা বিনিময়কালে খালেদা জিয়া আরেকটি কথা বলেছেন, ‘ তিনি এখন গৃহহারা।’
গৃহহারা বলতে বুঝি নিজের বা ভাড়ায় কোনো বাড়িতে থাকার যার সামর্থ্য নেই। খালেদা জিয়া গৃহহীন হলে, সোনারগাঁও-শেরাটনের আবাসিকেরাও বলতে পারেন, তাঁরাও গৃহহীন। বিরোধীদলীয় নেতা, দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির সভানেত্রী ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা, দু-দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি গৃহহারা—এই দাবি কি সঠিক? একজন মানুষের কয়টি বাড়ি দরকার? এই ঢাকা শহরে কি তাঁর কোনো বাড়ি নেই? তাহলে তিনি গৃহহারা হলেন কী করে?
গুলশানে সরকারের দেওয়া তাঁর একটি বাড়ি আছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে তাঁর নামে ২৯ মিন্টো রোডে আরেকটি বাড়ি বরাদ্দ আছে। ‘গৃহহীন খালেদা’র ছেলেরা মাসের পর মাস লন্ডনে, ব্যাংককে থেকে চিকিৎসা করাতে পারেন কীভাবে?
চাইলে দলের নেতা-কর্মীরাও তাঁর বিকল্প বাড়ির ব্যবস্থাও করতে পারতেন। কিন্তু করবেন না। করলে রাজনীতি থাকে না। এখন খালেদা জিয়া নিজেকে গৃহহীন দাবি করলে তা দেশের কোটি কোটি গৃহহীন মানুষের সঙ্গে ঠাট্টা ছাড়া আর কিছু নয়। রাজনীতির নামে আর যা-ই করুন, অন্তত গরিব ও গৃহহারা মানুষের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করবেন না।

৩.
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় যা-ই থাকুক না কেন, আমাদের সরকারি ও বিরোধী দলের রাজনীতিকেরা নিজেদের সুবিধামতো রাজনীতির সংজ্ঞা করে নিয়েছেন। সেই সংজ্ঞাটি হলো, যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে হবে এবং সে জন্য প্রয়োজনে দেশ ও জনগণকে জিম্মি করতেও তাঁরা দ্বিধা করবেন না।
ঈদের পরদিন বিএনপির নেতারা কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনে নামবেন। এর আগে জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাদের সঙ্গে খালেদা জিয়া বৈঠক করেছেন। তাহলে সর্বাত্মক আন্দোলনের পরিকল্পনাটি কি সেই বৈঠক থেকেই এসেছে? কেন সর্বাত্মক আন্দোলন? একটি বাড়ি উদ্ধারের জন্য? সেই বাড়িটি কি তাঁরা ন্যায়সংগতভাবে নিয়েছিলেন? ঢাকায় আরেকটি বাড়ি থাকতে কি একজন নাগরিক সরকারের কাছ থেকে আরেকটি বাড়ি বিনা মূল্যে নিতে পারেন?
বিএনপির নেতারা হয়তো বলবেন, এ রকম সরকারি বাড়ি নানা ফন্দিফিকির করে আওয়ামী লীগের নেতারাও নিয়েছেন। নিয়েছেন অন্য দলের নেতারাও। নিয়েছেন সামরিক-বেসামরিক আমলারা। তাঁদের অভিযোগ সত্য হলেও খালেদা জিয়ার নামে বাড়ি নেওয়া যুক্তিসংগত হতে পারে না।
বরং বিএনপি নেতারা বলতে পারতেন, স্বাধীনতার আগে ঢাকা শহরে কার কয়টি বাড়ি ছিল, এখন কে কয়টি বাড়ির মালিক, তা নিয়ে তদন্ত হোক। তদন্ত কমিশন হোক। ঢাকা শহরে এক বা একাধিক বাড়ি থাকা সত্ত্বেও যাঁরা সরকারি বাড়ি লিজ নিয়েছেন, যাঁরা প্লট বা ফ্ল্যাট নিয়েছেন, যাঁরা পৈতৃক বা নিজের সম্পত্তির কথা গোপন করে কোনো না-কোনো সরকারের আমলে একটি-দুটি পরিত্যক্ত বাড়ি বাগিয়ে নিয়েছেন, অথবা আগে দখল করে পরে সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন, সেসব খুঁজে বের করুন। ‘সব বিষয়ে শতভাগ স্বচ্ছ ও জবাবদিহি’র দাবিদার বর্তমান সরকার কি পারবে এ ব্যাপারে একটি কমিশন গঠন করতে? করলে দেখা যাবে, কেবল খালেদা জিয়া একা নন, আরও অনেক রাজনীতিক, নেতাদের পোষ্য, সামরিক-বেসামরিক আমলা অন্যায়ভাবে সরকারের (সরকার কোনো বায়বীয় বস্তু নয়, জনগণই এসব সম্পত্তির মালিক) সম্পত্তি দখল করেছেন।

৪.
বিএনপির নেতারা ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এবং ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে ওয়াজেদ মিয়ার বাড়ি সুধাসদন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হয়ে কীভাবে তাঁরা এই বাড়ি করলেন, সেটি দেশবাসী জানতে চায়। নিম্নমধ্যবিত্তের সন্তান একটি দেশ স্বাধীন করতে পারলে নিজের আয়ে বাড়ি করা কি খুব অসম্ভব কাজ? ৩২ নম্বর বাড়ি সম্পর্কে পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালেই তদন্ত-তল্লাশি করেছে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ট্রাজিক ঘটনার পর তথাকথিত ‘সূর্যসন্তানেরা’ও করেছিল। যদি নতুন করে তদন্ত প্রয়োজন হয়, বিএনপি করে দেখতে পারে। আরেকটি কথা, বিএনপির নেতারা এত বছর পর কেন সে প্রশ্ন তুলেছেন? আগে তোলেননি কেন? স্বাধীনতার পর সামরিক-বেসামরিক আমল মিলে বিএনপি অন্তত ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল। তখন এ নিয়ে তদন্ত করেনি কেন?
খালেদা জিয়া সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ না হলে কি তাঁরা বিষয়টি চেপে যেতেন? বিএনপির নেতাদের জানা আছে নিশ্চয়ই, ৩২ নম্বর ও সুধাসদন কিন্তু সরকার থেকে লিজ নেওয়া কোনো বাড়ি নয়, ব্যক্তিমালিকানাধীন । এর মধ্যে ৩২ নম্বরের বাড়িটি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টকে দেওয়া হয়েছে। এটি এখন জাদুঘর। বিএনপির নেতারা সেনানিবাসের বাড়িতে এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান করার কথাও ভাবেননি। তাঁরা চেয়েছেন বাড়ি। সেই বাড়ি হাতছাড়া হওয়ায় দুঃখ পেয়েছেন। কিন্তু দেশবাসী দুঃখ পায়নি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.