আমদানি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ-প্রবেশপথ সুরক্ষিত করতে হবে

যে পণ্যটি আমরা ব্যবহার করছি তা কি নিরাপদ? যে খাবারটি পুষ্টিকর বলে গ্রহণ করছি তা কি ভেজালমুক্ত? যে পানীয় পান করছি তা কি দূষণমুক্ত? এসব প্রশ্ন অহরহই ওঠে ভোক্তা ও ক্রেতাদের তরফে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এসব প্রশ্নের উত্তরে অধিকাংশ সময়েই নেতিবাচক তথ্যের মুখোমুখি হতে হয়।


গত কয়েক বছরে শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে খাদ্য ও ব্যবহার্য পণ্যে ভেজাল, দূষণ ও রাসায়নিক মিশ্রণের যে তথ্য মিলেছে তাতে অনেক পণ্যই সন্দেহ তালিকায় পড়বে। বাজারে গিয়ে দূষণমুক্ত, নিরাপদ পণ্য কিনতে গিয়ে যে কোনো ক্রেতাই ধন্দ ও বিভ্রান্তিতে পড়ে যান। ভেজাল এমনই ডালপালা বিস্তৃত করেছে যে, সেখান থেকে ভালো পণ্য বেছে নেওয়া খুব কঠিন। পরিস্থিতি বলছে, নিম্নমানের ভেজাল ও দূষিত পণ্যের কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছে বাংলাদেশের ভোক্তাসাধারণ। এ অবস্থায় সরকারের প্রধান কর্তব্য হলো বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফে মাঝে মধ্যেই বাজারে অভিযান পরিচালিত হয়। এতে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য বেরিয়ে আসে, ভেজালকারীদের শাস্তি ও জরিমানাও হয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের এসব অভিযান ইতিবাচক হলেও এগুলো সমস্যার ডালপালায় বিস্তৃত। কখনও কখনও গোড়াও অন্যখানে। আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাটি হওয়া দরকার প্রবেশপথেই। আর দেশে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে ফ্যাক্টরি বা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রেই মান নিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতি থাকা দরকার। বিস্ময়কর হলেও সত্য, আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে বিমানবন্দর, নদী ও স্থলবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া কার্যত অচল। অসাধু কর্মকর্তারা কি ক্রমাগত ছাড় দিয়ে চলেছেন? মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে বন্দরের চোখ উপেক্ষা করে বাজারে আসছে ভেজাল পণ্য? নাকি এ ক্ষেত্রে আইন ও নীতির ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে? সমকালের ধারাবাহিক অনুসন্ধানে এ বিষয়ে যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা হতাশাজনক। ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে হয়তো অনেক সমস্যাই আমাদের আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির অভাব। আমদানিকৃত পণ্যের হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হলেও এসব পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের 'সামান্য' ব্যবস্থাও করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনা ও দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সংকট স্পষ্ট। দেশের ২৬টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে প্রতিবছর ঢুকছে ৫ লাখ টন রাসায়নিক মিশ্রিত ভেজাল ফল। অথচ এ ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক আছে কি-না তা পরীক্ষার ব্যবস্থাই নেই বন্দরগুলোতে। কোথাও পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর ল্যাবরেটরি নেই। ল্যাবরেটরি থাকলেও প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবল ও সরঞ্জামের অভাব। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯২ শতাংশ আমদানি-রফতানির কাজ হলেও এখনকার ল্যাবরেটরি কার্যত অচল। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বন্দর অতিক্রমণের সময় ফলসহ খাদ্যপণ্যের ফরমালিন টেস্ট বাধ্যতামূলক নয়। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে ল্যাবে চলছে নানা দুর্নীতি, ছলচাতুরী। সমানে আসছে ভেজাল পণ্য। মান নিয়ন্ত্রণের জন্য সরঞ্জাম কিনতে চেয়েও সাড়া মিলছে না। যেন ভেজাল, দূষিত ও রাসায়নিকযুক্ত পণ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ৩৫টি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য বিএসটিআইর সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও দুধ, জুস ও শিশুখাদ্যের মতো জরুরি এসব পণ্যের অধিকাংশের পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই চট্টগ্রাম বিএসটিআইতে। নিত্যব্যবহার্য ১৫৩টি পণ্যের মধ্যে ৫৬টি পণ্যের মান যাচাই করা হচ্ছে সেখানে। এখানেও লোকবল ও সরঞ্জাম সংকট। পণ্যের বিএসটিআই ছাড়পত্রের জন্য আমদানিকারকদের ছোটাছুটি করতে হচ্ছে ঢাকায়। চট্টগ্রামে অবস্থিত বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগারের (বিসিএসআইআর) অবস্থা ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট। প্রয়োজনীয় লোকবল নেই, সরঞ্জাম নেই, অফিসের অবস্থা শোচনীয়। নামে গবেষণাগার হলেও গবেষণার বরাদ্দ নামমাত্র। বিশ্বের সাম্প্রতিক জ্ঞানের সঙ্গে সংযোগের ব্যবস্থা নেই। ঢাল নেই তলোয়ার নেই অবস্থায় আছে অধিকাংশ ল্যাব। আমদানিকৃত ও উৎপাদিত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত এসব প্রতিষ্ঠানের বেহাল দশা বলছে, সমস্যার গোড়া মেরামত করার কোনো তাগিদই আমাদের নেই। আর এ কারণে ভেজাল, দূষিত ও নিম্নমানের পণ্যে সয়লাব হয়ে গেছে বাজার। কিন্তু প্রবেশপথেই যদি মান নিয়ন্ত্রণ করা যেত তবে এ বিপুল ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হতো না আমাদের।
 

No comments

Powered by Blogger.