রাজবাড়িতে অগ্নিকাণ্ড-নিছক দুর্ঘটনা, না অন্যকিছু? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

রাঙামাটিতে চাকমা রাজার বাড়ি আগুনে পুড়ে যাওয়ার খবরটি শুনে খুবই মন খারাপ হয়েছিল। অনেক কাল আগে ওই বাড়িতে রাজার সান্নিধ্যে একটি আনন্দমুখর দিন কাটানোর সুযোগ আমার হয়েছিল। সেই অসাধারণ স্মৃতিটুকুর জন্য শুধু নয়, মন খারাপ হয়েছে ওই বাড়িটির দুর্ভাগ্যের পুনরাবৃত্তির কথা ভেবে।


১৯৬০ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য বাঁধ দেওয়ার পর পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল রাঙামাটির বিরাট একটি এলাকা। সেই প্লাবনে ডুবে গিয়েছিল ঐতিহ্যবাহী মূল রাজবাড়িটি। নির্মাণ ও স্থাপত্যশৈলীতে সেই বাড়িটি ছিল প্রকৃতই রাজমর্যাদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এখনো কাপ্তাই হ্রদের নিচে জলমগ্ন বাড়িটির অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। এরপর নতুন করে রাজবাড়ি নির্মিত হয় ১৯৬০ সালেই। এই বাড়িটি ঠিক ইমারত ছিল না। হ্রদের ধারে দ্বীপের মতো একটি ভূখণ্ডে এটি ছিল পাকা ভিটের ওপর মাটির প্রলেপ দেওয়া বাঁশ-বেড়ার দেয়াল ও টিনের ছাউনি দিয়ে নির্মিত। বিত্তের জৌলুশ না থাকলেও বাড়িটির স্থাপত্যশৈলী ছিল দৃষ্টিনন্দন ও ঐতিহ্যমণ্ডিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনজন সার্কেল-প্রধান রাজা নামে সম্মানিত। তাঁরা হলেন চাকমা, মং ও বোমাং রাজা। এখানকার আদিবাসীরা এখনো রাজাকে খাজনা দেন। এটাকে তাঁরা পুণ্য বলেই গ্রহণ করেছেন দীর্ঘ ঐতিহ্যের সূত্র ধরে—তাই খাজনা দেওয়ার এই অনুষ্ঠানের নাম পুণ্যাহ। এমনকি এখনো রাজদরবার বসে, দরবারে সামাজিক বিচার ও বিরোধ নিষ্পত্তি হয়।
হ্রদ পেরিয়ে রাজবাড়ির ঘাটে এসে যখন নৌকা পৌঁছাল, দেখি লোকজনের ভিড়। স্থানীয় লোকজন দলে দলে দেখতে আসছেন ভস্মীভূত রাজবাড়িটি। নৌকায় বসে সহযাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, ঘাটে নেমেও অনেকের সঙ্গে কথা হলো। কিন্তু সবার মধ্যেই দেখলাম, এ বিষয়ে মুখ না খোলার প্রবণতা রয়েছে। অগ্নিকাণ্ড কেন ঘটল, এ বিষয়ে কেউ কিছুই জানেন না। তার চেয়েও বড় কথা, এর পেছনে কোনো রহস্য আছে কি না—এ নিয়ে নিজেরা সংশয়ে থাকলেও মুখ ফুটে আগন্তুকের সামনে সে বিষয়টি খোলাসা করতে রাজি নন কেউই।
পোড়া বাড়িটার সামনে এসে অনেকেই দেখি বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। একধরনের বিষণ্নতা ভর করল আমার ওপরও। বেশ কয়েক বছর আগে এক বৈসাবি উৎসবের পরদিন কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে এ বাড়িতে এসেছিলাম রাজা দেবাশীষ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে। মনে পড়ে সেদিন খাওয়াদাওয়ার পর বাড়ির প্রশস্ত বারান্দায় বসেছিল গানের আসর। দেবাশীষ রায় নিজে পিয়ানো বাজিয়ে গান শুনিয়েছিলেন আমাদের। গান গেয়েছিল ছোট্ট রাজকন্যা সদ্য-মাতৃহীনা আত্রেয়ী (আত্রেয়ী এখন বড় হয়েছে, থাইল্যান্ডের এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দশম শ্রেণীর ছাত্রী)। আজ পোড়াবাড়ির বিবর্ণ বারান্দাটির দিকে তাকিয়ে সেই দিনটির কথা মনে পড়ে।
রাজবাড়িতে আগুন কীভাবে লাগল, তার কোনো নির্দিষ্ট কারণ উদ্ঘাটিত হয়নি এখনো। এ নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি এখনো কোনো প্রতিবেদন (রিপোর্ট) দেয়নি বলে ব্যাপারটি রহস্যময় হয়েই রইল। রহস্য ঘনীভূত হয়েছে আগুন লাগার সময়টির কারণে। বাড়িতে রাজপরিবারের কেউ ছিলেন না। প্রহরীদের পালাবদলের ফাঁকে যে এক ঘণ্টা বাড়িটি প্রায় অরক্ষিত থাকে (সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাতটা) সেই সময়টিতেই এ আগুনের সূত্রপাত। ফলে প্রত্যক্ষদর্শী প্রায় কেউ ছিল না বললেই চলে। অনুমান করে বলা হচ্ছে, কঠিন চীবরদান উৎসব উপলক্ষে কোনো স্থান থেকে ওড়ানো জ্বলন্ত ফানুশ পড়ে আগুন লেগেছে। কিন্তু সরেজমিনে দেখে মনে হয়, চারপাশের অজস্র বৃক্ষের আড়াল পেরিয়ে এখানে বাড়ির ওপর ফানুশ পড়ে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা খুবই কম।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এ অগ্নিকাণ্ডকে সাধারণ দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে না নিয়ে অন্য কোনো নাশকতার সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে কেন?
সন্দেহটা সৃষ্টি হচ্ছে অন্য এক ইতিহাসের সূত্র ধরে। ১৯৯১ সালের ৯ মার্চ খাগড়াছড়িতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গিয়েছিল অনেক দলিল-দস্তাবেজ। এর অব্যবহিত আগে ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকারের আমলে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের (বর্তমান জেলা পরিষদ) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা বাহিনী ও তৎকালীন শান্তি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে ভীতসন্ত্রস্ত অনেক আদিবাসী দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের ত্রিপুরা রাজ্যে। ধারণা করা হয়, জমিজমার কাগজপত্র সম্পর্কে অজ্ঞ ও অসচেতন আদিবাসীদের জমির মালিকানার স্বীকৃতি ছিল ওই সব দলিলে। সেই রহস্যের সুরাহা হয়নি এখনো।
বর্তমান চাকমা রাজার বাড়িটিতেও এ রকম কিছু মূল্যবান দলিল-দস্তাবেজ ছিল। ছিল ব্রিটিশ সরকার কিংবা তারও পূর্ববর্তী শাসকদের সঙ্গে চাকমা রাজাদের পত্রযোগাযোগের সাক্ষ্য, পার্বত্য চুক্তির আলোকে ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে এসব নথিপত্র আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমির অধিকার হিসেবে উপস্থাপন করা যেত বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
তবে, স্বয়ং চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় এ ধরনের কোনো নাশকতার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। রাজবাড়িতে গিয়ে তাঁকে না পেয়ে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেছেন, ‘নাশকতার কোনো কারণ তো দেখি না।’ রাজবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যা গেছে তার অর্থনৈতিক মূল্যের চেয়েও অনেক বেশি ছিল সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক মূল্য।’
কালিন্দী রানির হাতির দাঁতের চেয়ার, সোনার প্রলেপ দেওয়া তরবারিসহ বহুকালের সঞ্চিত তৈজসপত্র, পুরোনো আসবাব, দুষ্প্রাপ্য ছবি, দুর্লভ উপহারসামগ্রী ইত্যাদির মধ্যেই যেন ছিল একটি রাজপরিবারের ধারাবাহিক ইতিহাস। বিষণ্ন কণ্ঠে দেবাশীষ বললেন, ‘এ বাড়িতে জন্ম হয়নি বটে, কিন্তু বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এখানেই বেড়ে উঠেছি আমি। শৈশব, কৈশোর-যৌবনের অসংখ্য স্মৃতি আমার এই বাড়িকে ঘিরে। একটি অগ্নিকাণ্ড যেন মুছে দিল আমার জীবনের বড় একটি অধ্যায়।’
রাজবাড়ির অগ্নিকাণ্ড সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। আমরা আশা করব, তদন্ত কমিটি বিষয়টি আমলে নিয়েই তদন্তকাজ সম্পন্ন করবে। আমরা চাই, আমাদের আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হোক। কিন্তু সত্যিই যদি সে রকম কিছু ঘটে থাকে, তা যেন ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টি এড়িয়ে না যায় আমাদের। পার্বত্যাঞ্চলের সম্প্রীতির কথা বারবার বলছি আমরা, তাই কোনো সন্দেহের বীজ যেন এ ঘটনাকে ঘিরে তৈরি না হয়। কেননা, আগুনে সম্পদ বিনষ্ট হলে ক্ষতিটা হয়তো পুষিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু মন দগ্ধ হলে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
রাঙামাটি ঘুরে এসে
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.