জাপানের অর্থে ঢাকায় উড়াল রেলপথ-সাত প্রকল্পে জাইকার অর্থ প্রত্যাশা by পার্থ সারথি দাস

রাজধানীতে তৈরি হবে একটি উড়াল রেলপথ। ভূমি অপেক্ষা ১০ থেকে ১৯ মিটার উঁচুতে খুঁটির ওপর ৩ দশমিক ৬ মিটার দূরত্বে বসানো হবে দুটি লাইন। মিরপুর-মতিঝিল রুটে এই উড়াল রেলপথে থাকবে ১৮টি স্টেশন। তিন মিনিট ২০ সেকেন্ড পরপর ট্রেন থামবে স্টেশনে।


ফলে দুই দিক থেকে প্রতি ঘণ্টায় কমপক্ষে ৬০ হাজার যাত্রী বহন করা সম্ভব হবে। রাজধানীর যানজট সংকট মোকাবিলায় জাপানের অর্থায়নে এ ধরনের একটি স্বপ্নের প্রকল্প নিয়ে এখন কাজ করছে সরকার। জাপান অর্থায়ন করবে- এ সম্ভাবনার বিষয়টি সামনে রেখে মোট সাতটি প্রকল্প নিয়ে সরকার এগোচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নতুন তিন সেতু নির্মাণ এবং তিন সেতু সংস্কার নিয়ে জাইকার প্রাথমিক প্রতিবেদন গত বৃহস্পতিবার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। মেট্রো রেল প্রকল্পের নকশা প্রণয়নের জন্য শিগগিরই পরামর্শক নিয়োগ করা হচ্ছে।
স্বপ্নের উড়াল রেল : মেট্রো রেল প্রকল্পটি পল্লবী-রোকেয়া সরণি-খামারবাড়ি-ফার্মগেট-সোনারগাঁও-দোয়েল চত্বর দিয়ে মতিঝিল পর্যন্ত নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। শুরুতে ভাবা হয়েছিল বিজয় সরণি দিয়ে রেলপথ নেওয়া হবে। এখন বিজয় সরণি অংশ বাদ দিয়ে খামারবাড়ি দিয়ে রেলপথ নেওয়ার জন্য নতুন করে নকশা প্রণয়ন করা হবে। এ লক্ষ্যে গত ১৪ মে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড পরামর্শক নিয়োগের জন্য ইওআই (এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট) আহ্বান করেছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই পরামর্শক নিয়োগ করা হবে।
জানা যায়, ২৩ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে জাইকার সম্ভাব্য অর্থায়নের অংশ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যানবাহন সমন্বয় বোর্ড গত ১৪ জুন প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠনের নির্দেশনা জারি করেছে। এই কমিটির আহ্বায়ক থাকবেন স্পেশাল প্রজেক্ট অর্গানাইজেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মূল্যায়ন কমিটিতে পর্যবেক্ষক থাকবেন জাইকার একজন প্রতিনিধি। প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প ছক (ডিপিপি) ইতিমধ্যেই তৈরি করা হয়েছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও ডিপো লোকেশন নির্ধারণের কাজ চলছে।
রাজধানীতে উড়াল রেলপথটি ইলেকট্রনিক মাল্টিপ্ল্যান ইউনিট (ইএমইউ) প্রযুক্তিতে স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে সরকার এগোচ্ছে। প্রচলিত ট্রেনে সাধারণত ইঞ্জিনের বগি পৃথকভাবে থাকে। তবে ইএমইউ প্রযুক্তির ট্রেনে থাকে বিদ্যুৎচালিত ছোট আকারের ইঞ্জিন, যা যাত্রীবাহী বগির সঙ্গেই সামনের দিকে যুক্ত থাকে। ইতিমধ্যেই জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন, সুইডেন, রাশিয়া, জাপান এবং ভারতের মুম্বাই ও দিল্লিসহ বিভিন্ন দেশ বা নগরীতে এ ধরনের রেলব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের প্রকৌশলী (পরিবহন) আনিসুর রহমান উড়াল রেলপথ প্রকল্পের বাস্তবতা প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন ও বিস্তারিত ডিজাইন তৈরির জন্য পরামর্শক নিয়োগ করতে ইওআই আহ্বান করেছি। আগ্রহীদের প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ আগামী ৯ জুলাইয়ের মধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করতে হবে। এরপর মূল্যায়ন করে তালিকা তৈরি করা হবে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে পরামর্শক নিয়োগ করার সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি হবে বলে আশা করছি। তবে প্রক্রিয়া শেষ না হলে সেপ্টেম্বর মাস থেকে আরো কয়েক মাস বেশি সময় লাগতে পারে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে।'
ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডের সদ্য সাবেক অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক এম সালেহ উদ্দিন আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গত প্রায় সাড়ে তিন বছর মেট্রো রেল প্রকল্পের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। রুট নির্ধারণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিয়েছিল। বিমানবাহিনীর আপত্তির কারণে এই মেট্রো রেলপথ এখন পল্লবী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাবে বিজয় সরণি অংশ বাদ দিয়ে। এই রুটের বিস্তারিত ডিজাইন ও নকশা প্রণয়নের জন্য পরামর্শক নিয়োগ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করছি, প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাইকার সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণচুক্তি অচিরেই হবে। আমাদের দেশে প্রস্তাবিত মেট্রো রেল বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশও প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎচালিত রেলগাড়ির সঙ্গে পরিচিত হবে।'
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামসুল হক বলেন, ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় একাধিক মেট্রো রেলরুটের প্রস্তাব করা হয়েছে। একটি রুটে মেট্রো রেল চালুর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে। একটি রুট চালু হলে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্যান্য রুটেও মেট্রো রেল চালু করা যাবে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে। যানজট নিরসন ও দুর্ঘটনা হ্রাসে উড়াল রেলপথ অসামান্য ভূমিকা রাখবে বলেও তিনি আশা ব্যক্ত করেন।
নতুন তিন সেতু : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তিনটি নদীর ওপর নতুন তিনটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, কাঁচপুর সেতু, দ্বিতীয় মেঘনা সেতু ও মেঘনা-গোমতী সেতুর পাশেই তিন নতুন সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। নতুন তিন সেতু নির্মাণ ও পুরনো তিন সেতু সংস্কার বিষয়ে জাইকার বিশেষজ্ঞদল চলতি মাসে তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে জমা দিয়েছে। গত ছয় মাস কাজ করে বিশেষজ্ঞদল প্রতিবেদনটি তৈরি করে। জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সওজের প্রধান প্রকৌশলী জাইকার এ প্রতিবেদনটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু ব্যবস্থাপনা) মো. সাইদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, নতুন সেতু নির্মাণ ও সংস্কারে জাইকার একটি প্রতিনিধিদল গত জানুয়ারি মাস থেকেই কাজ শুরু করে। সম্ভাব্যতা যাইয়ের লক্ষ্যে সংস্থার একটি দল আগামী মাসে বাংলাদেশে আসছে। সাইদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা নতুন তিনটি সেতু নির্মাণে জাইকার কাছ থেকে সহযোগিতার ব্যাপারে আশাবাদী। জাইকার একটি প্রতিনিধিদল ২০-২৫ দিন আগে বিভিন্ন সাইট পরিদর্শন করে গেছে। জাইকা সুপারিশ করেছে নতুন তিনটি সেতুই হবে চার লেনের। কিন্তু অ্যালাইনমেন্ট কোনদিক দিয়ে হবে এ বিষয়টির আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।'
সওজ ঢাকার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শাহাবুদ্দিন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তিনটি নতুন সেতু নির্মাণের ব্যাপারে দুই-তিন মাসের মধ্যে জাইকার সঙ্গে চুক্তি হতে পারে- এমনটাই আশা করছি। যানবাহনের চাপ সামলানোর জন্য এই তিনটি সেতু অবশ্যই নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়া বিদ্যমান তিনটি সেতুর দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারও প্রয়োজন।'
সওজ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতুটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। একই মহাসড়কে মেঘনা সেতু ও মেঘনা-গোমতী সেতু দুটি আরো ঝুঁকির মুখে রয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দিনে কাঁচপুর সেতুর ওপর দিয়ে গড়ে ৩০ হাজার যানবাহন চলাচল করছে। এ ছাড়া মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতু দিয়ে দিনে ২০ হাজার যানবাহন চলাচল করছে। অতিরিক্ত ওজনবাহী যানবাহনের চলাচল বেড়ে যাওয়ায় তিনটি সেতুই যানবাহন চলাচলের জন্য বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.