প্রথম আলো গোলটেবিল বৈঠক-উত্ত্যক্ততার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ

১০ নভেম্বর প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘উত্ত্যক্ততার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেন। তাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো।


যাঁরা অংশ নিলেন
নুরুল ইসলাম নাহিদ
শিক্ষামন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
অধ্যাপক মিজানুর রহমান
চেয়ারম্যান, মানবাধিকার কমিশন
এ কে এম শহীদুল হক
পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) বাংলাদেশ পুলিশ
সালমা খান
সাবেক চেয়ারপারসন
জাতিসংঘ সিডও কমিটি
আয়েশা খানম
সভানেত্রী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
শাহীন আনাম
নির্বাহী পরিচালক
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
মেহতাব খানম
অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সালমা আলী
নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি
হোসনে আরা বেগম
অধ্যক্ষ
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
সোহেলী খাদিজা আজাদ
চেয়ারপারসন, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার
স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এলিনা খান
প্রধান নির্বাহী
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন
কর্নেল এ এস এম মুশফিকুর রহমান (পিএসসি)
অধ্যক্ষ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
হাবিবুল বাশার
সাবেক অধিনায়ক
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল
আব্দুন নূর তুষার
টিভি উপস্থাপক ও সভাপতি
বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশন
চঞ্চল চৌধুরী
অভিনেতা
জয়া আহসান
অভিনেত্রী
ফারজানা রূপা
বিশেষ প্রতিনিধি, দেশ টিভি
সৈয়দ আশিক
শিক্ষার্থী, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান ব্যবস্থাপনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি
লিরানা রহমান
শিক্ষার্থী, ব্যবসায় প্রশাসন
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম
যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
সুমনা শারমীন
ফিচার সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম
উত্ত্যক্ততার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ—বর্তমান সময়ে সবার জন্য এটি একটি অবশ্যকরণীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কয়েক দিন আগে আমরা যখন এ বিষয়ে গোলটেবিল বৈঠকের পরিকল্পনা করছিলাম, তখনো অবস্থা এত খারাপ ছিল না। কিন্তু ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় আজকের আলোচনার প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সর্বপ্রথম সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বললেন। তিনি উদ্যোগী হয়ে দেশব্যাপী সহিংস উত্ত্যক্তের বিরুদ্ধে সমাবেশ ও মিছিলও করলেন। আমরা সত্যিই খুশী যে মন্ত্রী মহোদয় আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকে এসেছেন। তাঁর অংশগ্রহণ সারা দেশে উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের জন্য সহায়ক হবে। আজকের আলোচনায় যাঁরা অংশ নিচ্ছেন, তাঁরা সবাই ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করছেন।
আমরা উত্ত্যক্ততা শব্দটি ব্যবহার করেছি, আবার কেউ কেউ ইভ টিজিং শব্দ ব্যবহার করেন। আদৌ বিষয়টিকে শুধু উত্ত্যক্ততা কিংবা ইভ টিজিং বলা যায় কি না, এ নিয়েও অনেক বিতর্ক রয়েছে। কারণ, সত্যিকার অর্থে বর্তমানে এটি মেয়ে কিংবা নারীর বিরুদ্ধে একটি সহিংসতার রূপ ধারণ করেছে। শুধু ইভ টিজিং কিংবা উত্ত্যক্ততা শব্দগুলো কিন্তু এই অপরাধের জঘন্য বিভিন্ন দিক পুরোপুরি তুলে ধরে না। আমরা আপাতত উত্ত্যক্ততা শব্দটি ব্যবহার করছি, যার অর্থ শুধু ইভ টিজিংই নয়। এর চেয়ে আরও সহিংস ঘটনাকে বোঝাচ্ছি।
প্রথম আলো এর আগে ২০০৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর উত্ত্যক্ততার বিরুদ্ধে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। তখনো সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তখনকার সময়ের চেয়ে বর্তমানে ব্যাপক আকারে এই সমস্যা আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে। ১৯৮৪ সালে যখন স্কুলের সামনে বখাটেদের উৎপাত হতো, তখনো কিন্তু একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল। মাঝেমধ্যেই উত্ত্যক্ততার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে। অনেক আগে থেকেই আমাদের সমাজে উত্ত্যক্ততার ঘটনা ছিল, কিন্তু বর্তমান সময়ের মতো এত ব্যাপক আকারে ছিল না।
এ ছাড়া নারীর বিরুদ্ধে সমাজে যে অন্যায় ও অবিচার চলে, সেসব বিষয়েও এর আগে আমরা অনেক গোলটেবিল বৈঠক করেছি। যেমন, কিছুদিন আগে ‘নারীর প্রতি নিপীড়ন: একটি নির্দেশনা ও তার বাস্তবায়ন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক করেছি। আদালত থেকে একটি নির্দেশ ছিল যে যৌন হয়রানি রোধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি করে কমিটি থাকবে, সেখানে নারী প্রতিনিধি থাকবেন এবং কেউ কোনো অভিযোগ করলে কমিটি তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেক প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কমিটি গঠন করা হয়নি। এসব বিষয় গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা হয়েছিল।
এ ছাড়া নারীর স্বাস্থ্যবিষয়ক, এইডসের বিরুদ্ধে অনেক গোলটেবিল বৈঠক করেছি, বিশেষ করে এইডস সংক্রমণের বিরুদ্ধে পুরুষের কী ভূমিকা থাকা উচিত, সে বিষয়েও আমরা বৈঠক করেছি। এসব গোলটেবিল বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য হলো, আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান যেন যথাযথ হয়, নারীর মর্যাদা যেন নিশ্চিত হয়, সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, সে ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা।
শুধু গত অক্টোবর মাসেই ১৩টি উত্ত্যক্ত করার ঘটনার সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। এই হিসাব প্রথম আলো, ইত্তেফাক ও দ্য ডেইলি স্টার—এই তিনটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর মাত্র। এ ছাড়া আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা প্রকাশিত হয়নি। উত্ত্যক্তের ঘটনায় গত মাসে দুজন খুনও হয়েছেন। আর গত সাত মাসে শুধু পত্রিকায় এসেছে, এমন ৩৩টি উত্ত্যক্তের ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা হয়তো প্রকাশিত হয়নি। এ সময়ের মধ্যে চারজন নিহত ও ৪২ জন আহত হয়েছেন—উত্ত্যক্তের ঘটনায় তিনটি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ তথ্য পেয়েছি। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্তের ঘটনায় জড়িত থাকার কারণে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এর আগেও আরও বহিষ্কার করা হয়েছে কয়েকজন ছাত্রকে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু বহিষ্কার কেন, এসব উত্ত্যক্তকারীকে পুলিশের হাতে কি তুলে দেওয়া যেত না? উত্ত্যক্তের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারের যে নতুন আইনটি করা হয়েছে, সেখানেও আমরা দেখেছি, মাত্র এক বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে, আরও বেশি শাস্তির বিধান কি করা যেত না? হয়তো এখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা দরকার।
তবে শুধু পুলিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে এসব সহিংস আচরণের সমাধান করা সম্ভব নয়। সমাজে সামগ্রিকভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে পরিবার ও সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে উত্ত্যক্তের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। উত্ত্যক্তের বিষয়টি যে খারাপ এবং খারাপ কাজকে খারাপ বলার মূল্যবোধ আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যারা এ ধরনের অপরাধ করে থাকে, তাদের সংখ্যা কিন্তু খুবই নগণ্য। ১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশ। আমরা প্রত্যেক নাগরিক যদি উত্ত্যক্তের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি এবং আইনশৃঙ্খলা দৃঢ় করতে পারি, তবেই কেবল আমরা আমাদের সমাজকে প্রকৃত অর্থে সভ্য সমাজ হিসেবে দাবি করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাব।
শুধু নারী উত্ত্যক্তকরণই নয়, আমাদের দেশে নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা একপেশে ও ত্রুটিপূর্ণ। ঘরে-বাইরে নারী নির্যাতিত হচ্ছেন। নারীর প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। যৌতুক প্রথার মাধ্যমে নারীদের নির্যাতন করা হয়। আমাদের দেশে এসবের বিরুদ্ধে আইন আছে, কিন্তু তার কার্যকর প্রয়োগ প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় না।
আজকের আলোচনায় প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে অনুরোধ করব উত্ত্যক্তের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্পর্কে কিছু বলার জন্য।

নুরুল ইসলাম নাহিদ
সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ‘উত্ত্যক্ততার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকটি আয়োজনের জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি আজকের আলোচনায় যাঁরা উপস্থিত হয়েছেন, সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। প্রথমেই বলতে চাই, বর্তমান সময়ে উত্ত্যক্তের বিষয়টি আমাদের সমাজে শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি সমাজের সব মানুষ এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। নারীর অধিকার, নিরাপত্তা, আইন—এসব বিষয় নিয়ে যাঁরা কাজ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে, তাঁদের অনেকেই এখানে উপস্থিত আছেন।
যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে নারী উত্ত্যক্তকরণের ঘটনা ঘটে আসছে। মেয়েদের প্রতি ছেলেদের এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ নানাভাবে হয়ে থাকে, যাকে আমরা বলছি ইভ টিজিং বা বখাটেদের উত্ত্যক্তকরণ। আমিও বলতে চাই, ইভ টিজিং বলার মধ্যে এটি সীমাবদ্ধ নয়, আমাদের নারীর প্রতি সহিংস আক্রমণের বিষয়, এটিকে প্রতিহত করতে হবে আমাদের। বখাটে বললে একটু আদুরে আদুরে ভাব মনে হয়। তাই আমি বলতে চাই, এরা বখাটে সন্ত্রাসী। সেই হিসেবে আমাদের মেয়েদের ওপর যারা এ ধরনের আক্রমণাত্মক আচরণ করে, তারা হচ্ছে সন্ত্রাসী। তারা আমাদের সমাজে একটি বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। উত্ত্যক্তের ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমাজে চলে আসছে। আগে স্বল্প আকারে ছিল, কিন্তু সম্প্রতি এর তীব্রতা অনেক বেড়েছে। মেয়েরা অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়ার কারণে অনেকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন। সেখানে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন তাঁদের পাশে দাঁড়াতে গেলে তাঁরাও মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছেন। অভিভাবকদের হত্যা করা হচ্ছে। এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটছে।
এতে বোঝা যাচ্ছে, এসব ঘটনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তারা খুবই সহিংস হয়ে উঠেছে। তারা তাদের ইচ্ছা কিংবা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন মনে করছে, তা করতে তারা দ্বিধা করছে না। সম্প্রতি মধুখালীতে মাকে, নাটোরে একজন অধ্যাপককে হত্যা করা হলো। কিছুদিন আগে শ্রীনগর উপজেলায় সিনথিয়া নামের একটি মেয়ে আত্মহত্যা করল। কয়েক দিন আগে ঢাকা শহরে মা মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যান। একদিন মা মেয়েকে নিয়ে যেতে পারেননি, চাচাতো ভাই নিয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করলে চাচাতো ভাই আপত্তি করায় সেখানে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। বাড়িতে ঢুকে অভিভাবকদের হত্যা করা হচ্ছে। এ ধরনের জঘন্যতম অপরাধ বেশ কিছুদিন ধরেই প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন পত্রিকায় দেখি, বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে কিংবা তাদের স্কুলে যেতে বাধা দিচ্ছে বখাটে সন্ত্রাসীরা। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওই সব জেলার জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার পরও এসব ঘটনা কমছে না, নিয়মিত ঘটেই যাচ্ছে। সে জন্য অনুধাবন করলাম, আমাদের যথাযথ পুলিশি ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য আমাদের যা যা করা দরকার, তার সবই কঠোরভাবে করতে হবে এ সমস্যা সমাধান করার জন্য। আমাদের আইন যথেষ্ট নয়। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনি ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।
আমাদের ছাত্রীরা স্কুলে যেতে পারছে না। তারা রাস্তায়, বাড়িতে এমনকি ক্লাসে পর্যন্ত বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এতে অনেকে, অনেক পরিবার মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। এ রকম উত্ত্যক্তকরণের ঘটনা ঘটতে পারে—এই আশঙ্কায় অনেক পরিবার মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। তাই এ ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মেয়েদের বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মেয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়ার বিষয়টি যথেষ্ট হুমকির মুখে পড়েছে।
আমাদের আইনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এ সমস্যা সমাধানে। আমি মনে করি, শুধু আইন করে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। দেশে বহু অপরাধ আছে, যেগুলো রোধ করার জন্য আইন আছে, বিচার হয়। শাস্তি দেওয়া হয়। তবু বন্ধ হয়নি সেসব অপরাধ। সুতরাং শুধু আইন করে নয়, যদি আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে না পারি, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে আমাদের মেয়েদের আমরা নিরাপত্তা দিতে পারব না। এসব উত্ত্যক্তকারীর হাত থেকে ছাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে না।
সে জন্য আমাদের সমাজের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। যেসব ছেলে এসব অপরাধ করে, তারা কিন্তু আমাদের সমাজেরই তথা কারও না কারও সন্তান। তারা বিপথগামী হচ্ছে। সামগ্রিক সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের যে অধঃপতন ঘটেছে, এটি তারই একটি প্রকাশ। তারা আরও আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে এসব অপরাধ করছে। আমাদের মেয়েদের যেমন রক্ষা করতে হবে, তেমনি আমাদের ছেলেদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য সুদূরপ্রসারী কাজ করতে হবে। আমরা নতুন সিলেবাস তৈরি করছি। আমাদের পুরোনো সিলেবাস যুগোপযোগী নয়। আমরা কাজ করছি নতুন সিলেবাসে এসব নৈতিকতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। দ্রুত কিছু করার জন্য একটি বই তৈরি করছি সব শিক্ষকের জন্য। যেখানে মেয়েদের নিরাপত্তা, মাদকাসক্তি, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিসহ নানা বিষয়ে কিছু নির্দেশিকা থাকবে, যেগুলো স্কুলগুলোতে অ্যাসেম্বলি কিংবা ক্লাসে প্রতিদিন শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের এসব বিষয় ব্যাখ্যা করে বলবেন।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে ছেলেদের মধ্যে। ছেলেরা যাতে মনে করতে পারে, মেয়েরা তাদের সহপাঠী, বন্ধু কিংবা বোনের মতো। ছেলেরা মেয়েদের দুর্বল মনে করে, মেয়েদের দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি তা ভিন্ন মনে করে। সুতরাং এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সামাজিক আন্দোলন ও সচেতনতা। পরিবার ও সমাজ যদি তার সন্তানকে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের শিক্ষা দিতে পারে, তবেই শুধু এ সমস্যা সমাধানে অনেকটা অগ্রসর হওয়া সম্ভব। আমরা সব স্কুলে একটি করে কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছি, যেখানে শিক্ষকদের, ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধি থাকবে। পাশাপাশি এলাকায় স্থানীয় লোকজন এর সদস্য থাকবেন। সেই কমিটি এসব উত্ত্যক্তকারীকে চিহ্নিত করবে, তাদের পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং যারা সীমা লঙ্ঘন করবে, তাদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করবে।
উত্ত্যক্তকারীদের শোধরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমাদের ছাত্রীদের নিরাপত্তা যদি দিতে না পারি, তবে আমাদের সমাজ অনেকটা পিছিয়ে পড়বে। কারণ, বর্তমানে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন। প্রতিবছর এসএসসি বা এ ধরনের পরীক্ষায় ছেলেমেয়ে প্রায় সমান সমান পরীক্ষা দেয়। এ বছর অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় ১৫ লাখ পাঁচ হাজার ৩৯১ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় এক লাখের বেশি মেয়ে পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে ছেলেদের তুলনায়। কিন্তু এসএসসি পর্যায়ে এ সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কারণ, মেয়েরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেওয়ায় সামাজিক বাধা যদি বাড়তে থাকে, তবে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তাই মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখার জন্য কঠোর আইন তৈরি ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এসব সামাজিক বাধা দূর করার জন্য।
আইন তৈরির প্রক্রিয়াটি দ্রুত করার জন্য কয়েক দিনের মধ্যে সবাইকে নিয়ে একটি সভার আয়োজন করতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সমাজের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও সব শ্রেণীর সবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামাজিক আন্দোলন ও সচেতনতা সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে সমন্বিতভাবে উত্ত্যক্তের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

সুমনা শারমীন
যেখানেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে, সেখানেই শিক্ষামন্ত্রী ছুটে যাচ্ছেন। সেই পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। স্কুলগুলোর খবর নিচ্ছেন। সে জন্য তাঁকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয়েরই প্রকাশ হয়তো ঘটছে এসব ঘটনার মাধ্যমে। নারীর প্রতি যে বৈষম্য, তা এখন পর্যন্ত বিলোপ হয়নি। নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপে জাতিসংঘের যে সিডও কমিটি, তার সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খানের কাছে জানতে চাইব, এই যে নারীর প্রতি বৈষম্য, সে ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী।

সালমা খান
নারীর প্রতি বৈষম্য চিহ্নিত করা হয়েছে জাতিসংঘের সিডও কমিটিতে। আজকের আলোচনার বিষয় উত্ত্যক্তকরণ বলতে নারীর প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। নারী যেহেতু শুধুই নারী, এ কারণেই তাঁদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। তাই নারীকে উত্ত্যক্ত করার বিরুদ্ধে আমাদের আরেকটু বেশি জোর দিতে হবে। জাতিসংঘের সব সনদে নারীর প্রতি উত্ত্যক্তকরণকে যৌন হয়রানি বা যৌন নির্যাতন হিসেবে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে। আমরা যখনই একটি দীর্ঘমেয়াদি কাজ করতে চাই, প্রথমে একটি ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আনা প্রয়োজন। আমরা কী সংজ্ঞা গ্রহণ করছি, সেটিও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। জাতিসংঘের সিডও কনভেনশনে, পরবর্তী সময়ে সিডও যে আরও বিন্যস্ত করা হয়েছে, জেনারেল রিকমেন্ডেশন নাম্বার নাইনটিন, যেটা বিশ্বজুড়ে নারীর প্রতি বৈষম্যের একটি মূল হাতিয়ারের বিশ্লেষণ হিসেবে ব্যবহূত হয়। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে নারীর প্রতি যে আগ্রাসন করা হয়, সেখানেও এটি ব্যবহূত হয়। সেই সংজ্ঞাটি আমরা নেব কি না, আজকে তা আমাদের চিন্তা করতে হবে। অবশেষে আইনটিকেও বিশ্লেষণ করতে হবে। আইনটি উপযোগী কি না তা দেখা এবং আইনের একটি পরিধি নির্ণয় করতে হবে। আসলে এখানে আমরা কী সংজ্ঞা ব্যবহার করব, সে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু উত্ত্যক্তকারীরা নারীর চলাফেরা, স্বাধীনতা, বিকাশ, উন্নয়ন ও শিক্ষা—সবকিছুকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ ছাড়া কর্মস্থলেও নারীরা ব্যাপক বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অর্থাৎ এটি সাধারণ যৌন হয়রানির চেয়েও আরও মাত্রাতিরিক্ত ঘটনা।
উইমেন ফর উইমেন ও স্টেপস্ টুয়ার্ডসডেভেলপমেন্ট মিলিতভাবে একটি সমীক্ষা করেছিল, আসলে কারা উত্ত্যক্তকরণের সঙ্গে জড়িত। সেখানে দেখা গেছে, ১৫ শতাংশ উচ্চবিত্ত ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান, ৬০ শতাংশ মধ্যবিত্ত উচ্চ পরিবারের এবং নিম্নবিত্ত মাত্র ২৭ শতাংশ। এ থেকে স্পষ্ট, যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, তারা সমাজে প্রভাব দেখানোর ক্ষমতা রাখে। আসলেই কোনো ঘটনার জন্যই বখাটেরা একা দায়ী নয়। কোনোভাবেই এটি তারা করতে পারত না, যদি না সে পার পেয়ে যেত। সেখানে আমরা দেখি, সমাজ, রাজনীতি, প্রশাসন সমন্বিতভাবে এসব বখাটেকে পার পেয়ে যেতে সাহায্য করছে। সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসিতে ছাত্রী উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় তিনজন সাংবাদিককে পেটানো হয়। পরে পুলিশ এলে স্থানীয় ছাত্রলীগের কর্মী উত্ত্যক্তকারীকে নিজের কর্মী দাবি করে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। এ ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোর যে চিত্র, তা উঠে আসছে। সে জন্য আমি শুধু বখাটেকে তো দোষ দিতে পারি না। তাই আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, সমাজে কোথাও না কোথাও রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা, অভিভাবকত্ব ও পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী মৌলবাদ কিংবা যেকোনো ধারা এসব উত্ত্যক্তের ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী।
আমরা জানি, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে অগ্রগতি বা অর্জন, তা কিন্তু বিরাট মাত্রার। সম্প্রতি মানব উন্নয়নের সূচকে বড় অগ্রগতি হয়েছে। সেখানে ১৬৯ থেকে ১২৯-এ এগিয়ে এসেছি এবং ৯৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়নে একটি অগ্রগামী উদাহরণ, শুধু তৃতীয় বিশ্বের জন্য নয়, এখন উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্যও। এটি এ মাসের প্রতিবেদন। সেখানে সরকারের নীতি যদি দেখতে যাই, সেখানে দেখি সরকারের উৎস থেকে জানতে পারি, গত এক দশকে বেকারত্বের হার বেড়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। বর্তমানে বেকারত্ব ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। শিক্ষিত ও মধ্য শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। দেশের সাড়ে চার কোটি বেকার মানুষের মধ্যে তিন কোটিরও বেশি যুবসম্প্রদায়। এই বিশাল যুবসম্প্রদায়ের বেকারদের সরকারি চাকরি পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকার সরকারি চাকরির জন্য প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। যে চাকরিগুলো সাধারণভাবে পাওয়া যেত, সেই চাকরিগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের বংশপরম্পরায় কোটা বেঁধে রাখার জন্য পাওয়া যাচ্ছে না। এই প্রায় সোয়া তিন কোটি যুবকের কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব শিক্ষিত বেকার ও মধ্য শিক্ষিত যুবসমাজ বেকারত্বের কারণে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাই আমি বলতে চাই, এই যুবসমাজের কর্মসংস্থানের দিকেও সরকারের নজর দিতে হবে।

সুমনা শারমীন
দীর্ঘদিন ধরে যিনি নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে আন্দোলন করে যাচ্ছেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়েশা খানমকে অনুরোধ করছি বলার জন্য।

আয়েশা খানম
উত্ত্যক্তের ঘটনাগুলো দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমাজে চলে আসছিল। তরুণেরা মনে করত, এ রকম না করলে আমাদের টিনএজ যে পার হচ্ছে, সেটিই কীভাবে বুঝব। তরুণীরা মনে করত, আমরা কতটা আকর্ষণীয়—এগুলো ছিল আগের সময়ে ভিন্ন মাত্রায়। কিন্তু কয়েক দশকে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেখি, ঢাকা শহরে সিমির ঘটনা কিংবা নাটোরে মহিমার ঘটনা লক্ষ করলে বোঝা যায়, পরিস্থিতি কত ভয়াবহ। আমরা সব সময় আমাদের বাস্তব জীবনের পুরোনো ঘটনাগুলো টেনে আনতে বাধ্য হই বারবার। নাটোরে যখন গিয়েছিলাম প্রয়াত কে এম সোবহান, আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের এবং আমরা—বড় একটা সামাজিক নারী সংগঠন—তখন দেখেছিলাম একই ঘটনা। মহিমাকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছিল এবং তার ভিডিওচিত্র বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তাকে উত্ত্যক্তকরণ, প্রেমে সফল পরিণতির জন্য চাপ সৃষ্টি করা পুরো পরিবারের ওপর এবং পরবর্তী সময়ে একই রাজনৈতিক চেহারা দেখা গেল। ঢাকার ফাহিমা, খুলনার রুমি ও গাইবান্ধার তৃষা—সব প্রায় একই রকম ঘটনা। যখন প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে তৃষার উত্ত্যক্তকারীর বিরুদ্ধে বিশাল জনসভা করেছিলাম, তখন এই উত্ত্যক্তকরণের ঘটনাগুলো কখনো থেমেছে আবার কখনো বেড়েছে। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা যদি বলতে চাই, তাহলে বলব ঢাকার সিমির ঘটনা। ঢাকার বিশেষ প্রভাবশালী রাজনীতিক, রাষ্ট্র, সরকারসহ সবার উদ্যোগ নেওয়ার পরও আমাদের আকাঙ্ক্ষিত রায় কিন্তু এখন পর্যন্ত হয়নি। এসব ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অবশ্যই আমাদের করতে হবে। তবে এ মুহূর্তে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে এ সমস্যা দূর করার জন্য। পাশাপাশি সুদূরপ্রসারী উদ্যোগও আমাদের নিতে হবে।
আমরা ২০০৩-০৪ সালে যখন কাজ শুরু করলাম, তখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনা শুরু হয়েছিল। আমরা ২০০৩ সালে প্রথম সিদ্ধেশ্বরীতে ইভ টিজিংয়ের খবর পাওয়ার পরই সেখানে কাজ শুরু করেছিলাম। তখন এ বিষয়টি নিয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তি ও কিছু গণমাধ্যম বা পত্রিকা এ বিষয়ে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু ইদানীং আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইভ টিজিংয়ের ঘটনাগুলো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। প্রথম দিকে এ সমস্যাটি যথাযথভাবে চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলনের পক্ষ থেকে পরবর্তী সময়ে বাধ্য করা হয়েছিল। ফলে হাইকোর্টে যাওয়া, সরকার ও প্রশাসনকে বাধ্য করা হয়েছিল এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। এখন একটু আশান্বিত হচ্ছি এ কারণে যে সরকার বর্তমানে আইনগুলো তৈরি ও প্রয়োগের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে। আমাদের দেশের নারী ও শিশু নির্যাতনবিরোধী আইনসহ বেশ কয়েকটি আইন রয়েছে। এখন প্রয়োজন এ আইনগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকর একটি আইন করা, যাতে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে বখাটেদের সতর্ক করে দেওয়া যায়। পুলিশ প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিত। কারণ, অতীতে পুলিশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তেমন কোনো দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারেনি সমস্যাটি সমাধানের ক্ষেত্রে। এরই মধ্যে সরকার ও প্রশাসনের কাছে অনেক সুপারিশ জমা দিয়েছি। আমরা মনে করি, এসব সুপারিশের ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
পরিবার ও সামাজিক শক্তিগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আমাদের অবশ্যই জানা প্রয়োজন, কেন হঠাৎ করে আমাদের তরুণেরা নারীদের প্রতি এত উদ্ধত হয়ে পড়ল, নারীদের প্রতি সংহিস হয়ে উঠল। তরুণদের সঙ্গে আরও আমাদের মতবিনিময় বাড়ানো উচিত। তাঁদের সমস্যার কারণ কী, তা আলোচনার মাধ্যমে বের করে নিয়ে আসতে হবে এবং তা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
বর্তমানে উত্ত্যক্তের বিষয়টিকে নারীর প্রতি সন্ত্রাসী আচরণ বলা উচিত। কারণ, এটি নারীর স্বাধীনতা, চলাফেরা, শিক্ষা, মত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। আমরা বিগত তিন দশকের অধিক সময় দেখেছি আমাদের রাজনীতিতে সহিংসতার মনোভাব, যেখানে কোনো পরমতসহিষ্ণুতা নেই। ভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার অভাব এবং প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রচলন দেখা যাচ্ছে। এ জন্য আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এ ছাড়া মাদক ব্যবসার ভয়াল থাবা তরুণদের গ্রাস করছে, তা থেকে মুক্তির জন্য অবশ্যই সারা দেশে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এলাকায় পাঠাগারের পরিবর্তে রাস্তায় রাস্তায় মাদকের অবাধ ব্যবসা চলছে। এসব অবশ্যই চিহ্নিত করে বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। তরুণদের কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। আমাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এ সমস্যা সমাধানের জন্য।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মামলার শুরুতেই ভিন্ন ধারায় করা হয়, ফলে আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা বের হয়ে আসছে। অপরাধীরা যাতে পার না পায়, সে জন্য আইনের যথাযোগ্য প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সংস্কৃতির জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, বিভিন্ন অপসংস্কৃতি ও সাইবার ক্রাইম বন্ধ করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নারীদের সতীত্ব বিষয়ে পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। কোনো ঘটনা ঘটলে পরিবারগুলো মেয়েদেরই প্রথমে দায়ী করে, ফলে তাঁরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

সুমনা শারমীন
তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় এবং নিজেও তরুণ চঞ্চল চৌধুরীর কাছে জানতে চাইব এ সমস্যা সমাধানে তরুণেরা কীভাবে এগিয়ে আসবে।

চঞ্চল চৌধুরী
ইভ টিজিং একটি শব্দ। এ শব্দটির সঙ্গে অধিকাংশ জনগোষ্ঠীকে একত্র করতে চাই। আমার মনে হয়, সহজবোধ্য কোনো শব্দ নির্ধারণ করা দরকার। কারণ মনে হয়, ১৬ কোটি মানুষের কাছে ইভ টিজিং শব্দটির অর্থ পরিষ্কার নয়। কিছু কিছু বিষয় আছে, যেগুলো সরকার বা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, শুধু প্রশাসন, আলোচনা বা বৈঠকের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয়। তেমনই একটি সংকট হচ্ছে ইভ টিজিং। আমাদের এর মূলে যেতে হবে। কীভাবে একটি ছেলে এই পথে পা বাড়াচ্ছে। পারিবারিক একটি সংকট সব সময় এর জন্য একটি কারণ হিসেবে কাজ করে। একটি শিশু জন্মগ্রহণের পর থেকে মানুষ হয়ে ওঠা পর্যন্ত দীর্ঘ যে সময়, তার একটি বড় অংশই দেখভালের দায়িত্ব থাকে পরিবারের ওপর। ছেলেরা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে—এসব বিষয়ে যদি পরিবার খোঁজখবর না রাখে, তবেই ছেলেদের বিপথে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। পরিবারের মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজনের একটি বড় দায়বদ্ধতা থাকে তার সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। একটা সময় ছিল, যখন আমাদের সমাজে যৌথ পরিবারব্যবস্থা ছিল। তখন যেহেতু সবাই একসঙ্গে থাকত, ফলে সন্তানদের খারাপ কাজ করার সুযোগ কম থাকত। আর বর্তমানে একক পরিবার হওয়ার ফলে সন্তানদের খোঁজখবর নেওয়ার সুযোগ থাকছে না।
যে ছেলেটি বখে যাচ্ছে, তার জগৎটা অনেক ক্ষুদ্র, সে বেশি কিছু চিন্তা করতে পারে না। দুর্বল মুহূর্তগুলো সীমাবদ্ধ জায়গায় আবদ্ধ হয়ে থাকতে থাকতে উন্মুক্ত চিন্তা করতে পারে না। তার হাতে আছে মোবাইল ফোন ও নেটওয়ার্ক, যেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে ভালোর চেয়ে খারাপের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের হাতে কেন মোবাইল ফোন থাকছে, এ বিষয়টির প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা রোধ কেন আমরা করতে পারছি না। আমাদের বেশির ভাগ বাচ্চা মানুষ হচ্ছে বাসার বুয়া কিংবা ড্রাইভারের কাছে। আমাদের মা-বাবা তাদের দেখভাল করতে পারছেন না। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যেহেতু একটিমাত্র সন্তান বেশির ভাগ পরিবারের, তাই মা-বাবা তাঁর সন্তানকে যথেষ্ট স্বাধীনতা ও প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। ফলে তাদের বখে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
তা ছাড়া আমাদের সমাজে বখে যাওয়ার সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। আগে বন্ধুবান্ধবের মধ্যে হাতাহাতি হতো, এখন বন্দুকের গুলিবিনিময় হয়। অর্থাৎ সহিংসতার পরিমাণ ও ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। আরেকটা দিক হচ্ছে মানবিক শিক্ষা। যে যুবকটি এই অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, তার আসলে মানবিক শিক্ষা বলে কিছু থাকে না, যদিও পুঁথিগত শিক্ষা থাকে তার মধ্যে। আবার যারা এসব কাজ করছে, সবাই যে শিক্ষিত কিংবা ছাত্র, তা-ও কিন্তু নয়। আমার মনে হয়, মানুষ হওয়ার শিক্ষাটি বেশি প্রয়োজন পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার চেয়েও বেশি। মানবিক শিক্ষার অভাবের কারণেই কিন্তু আজকে এই সমাজ ক্রমেই অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সমাজে একটি ছেলে একটি মেয়েকে পছন্দ করলে কিংবা প্রেমের প্রস্তাব দিলে মেয়েটি গ্রহণ করল না। তখন ছেলেটি হতাশ হয়ে উত্ত্যক্তকরণের পথ বেছে নিচ্ছে। আমার মনে হয়, ছেলেদের এই মনোভাব পরিবর্তন করা উচিত। সে যদি বুঝতে পারে যে সে যদি যোগ্যতা অর্জন করে বড় কোনো লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, তখন সে যেকোনো মেয়েকে পছন্দ করলে তাকে পাওয়া সম্ভব।
পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি এ ধরনের মনোভাব ছেলেদের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারে, তবে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এ ছাড়া এলাকার স্থানীয় মুরব্বিদের নিজ নিজ এলাকায় দায়িত্ব নিতে হবে, কোন পরিবারের কার সন্তান এসব অপকর্ম করছে, তাদের পরিবারকে সতর্ক করে দেওয়া। যদি পরিবারের সঙ্গে সন্তানদের সুসম্পর্ক থাকে, তাহলে এ ধরনের কাজ করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই আমরা বলতে পারি, যদি আমার সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব নিই, এভাবে সমাজে প্রত্যেকে তাঁর নিজ পরিবারের সন্তানদের দায়িত্ব নেন, তবেই এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। আর যখন একটি ঘটনা ঘটে যায়, তখন প্রশাসনিক যে শাস্তির ব্যবস্থা আছে, সেখানে দেখা যায়, প্রশাসনই অর্থাৎ রক্ষকই যেন ভক্ষক হয়ে যায়। এটি আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। অপরাধ করে সহজেই অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার রীতি পরিবর্তনের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে অপরাধের পথে ঢোকার আগেই, অর্থাৎ গোড়াতেই সমস্যার সমাধান করে তা বন্ধ করে দিতে হবে।

সুমনা শারমীন
তরুণেরা যদি বেশি বেশি সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সময়ই হয়তো পাবে না। বারবার কথা আসছে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিষয়ে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলীকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

সালমা আলী
উত্ত্যক্তের বিরুদ্ধে কাজ করা আমাদের প্রত্যেকেরই সামাজিক দায়বদ্ধতা। আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে কীভাবে সরকারকে নিজেরা সাহায্য করব, সে বিষয়ে কাজ করা উচিত এ সমস্যা সমাধানের জন্য। আমাদের নারীদের সুরক্ষার চেয়ে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিরোধের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নারীদের প্রতি সহিংসতার বিষয়গুলো শুধু ইভ টিজিং হিসেবে দেখা উচিত নয়। কারণ এটি একটি অপরাধমূলক সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লন্ডনে যখন এ ধরনের একটি অরাজকতা কিংবা ইভ টিজিংয়ের মতো চলছিল, তখন ব্রিটিশ সরকার এটি বন্ধের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ভারতের সোয়াম নামের একটি এনজিও গবেষণা করেছিল, ইভ টিজিং যৌন হয়রানি কি না সে বিষয়ে। এখানে কেউ কেউ বলছে, এটি ইভ টিজিং আবার কেউ কেউ বলেছে, এটি যৌন হয়রানির প্রাথমিক অবস্থা।
আদালত গত বছর যে রায়টি দিয়েছেন, সেখানে ইভ টিজিংকে যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যৌন হয়রানি ও নিপীড়নমূলক উক্তি, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা, যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ আবেদন, পর্নোগ্রাফি দেখানো, যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি, অশালীন ভঙ্গি বা ভাষা, উত্ত্যক্ত কিংবা অশালীন উদ্দেশ্যপূরণের জন্য কোনো ব্যক্তির অলক্ষে তার নিকটবর্তী হওয়া বা অনুসরণ করা, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করা, ঠাট্টা বা উপহাস করা, চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল ফোন, এসএমএসে ছবি, নোটিশ, কার্টুন প্রেরণ, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, নোটিশ বোর্ডে বিভিন্ন কটূক্তি, বিভিন্ন বিষয়ে ব্ল্যাকমেইল অথবা চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে স্থিরচিত্র কিংবা ভিডিওচিত্র ধারণ করা, বিভিন্নভাবে প্রেম নিবেদন করা—এসব বিষয় যৌন হয়রানির মধ্যে পড়ে। আমরা গত বছর এই গাইডলাইনটি পেয়েছিলাম, যা আমাদের সংবিধানের ১১১ ধারা অনুযায়ী একটি আইন হিসেবে গণ্য হবে। যেহেতু আমাদের আলাদা করে কোনো বিশেষ আইন নেই। এখন যে আইনটি আছে, সেটিও সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। সে জন্য একটি নতুন আইন কিংবা বিদ্যমান আইনের পরিবর্তন করা দরকার।
নারীর ক্ষমতায়ন থেকে শুরু করে নারীদের সাংবিধানিক অধিকার বিভিন্নভাবে খর্ব হচ্ছে, যেখানে তা রোধে একটি আইনের অতি জরুরি। একটি আইন শুধু প্রয়োগ করা হয় সুরক্ষার জন্যই নয়, পাশাপাশি অপরাধকে কমিয়ে আনার জন্যও কাজ করে। আমরা বিভিন্ন সংগঠন একত্র হয়ে এই গাইডলাইনকে ও অন্যান্য দেশের অনেক আইনকে সামনে রেখে কর্মক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি এলাকায় যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য একটি খসড়া আইন কমিশনে জমা দিয়েছি। ইভ টিজিংয়ের ৫০৯ ধারা দণ্ডবিধির আরও পরিবর্তন করে ভারত ও পাকিস্তানের আইনের খসড়ার সঙ্গে সংগতি রেখে সাত বছরের কারাদণ্ড, অন্যান্য জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে খসড়া প্রস্তাব সরকারের আইন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে তা পড়ে আছে। আমরা এগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চাই। সে জন্য আমি বাদী হয়ে গত সপ্তাহে আরেকটি মামলা করেছিলাম, সেখানে বিচারক দ্রুত চারটি সংগঠন আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চেয়েছেন কে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, কোন কাজের কতটা অগ্রগতি হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে তারা তাদের রিপোর্ট পেশ করবে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে একটি গাইডলাইন তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন।
ইভ টিজিংয়ের শাস্তি হিসেবে এক বছর জেলের বিধান গেজেট আকারে নোটিশ হয়ে গেছে। ফলে আমরা ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অনুরোধ করব, আমরা দ্রুত দেখতে চাই, আইনটির যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে। সেগুলো যদি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তবে ইভ টিজাররা অনেকটা সতর্ক হয়ে যাবে। আমার অনুরোধ, এ সমস্যা সমাধানে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে খসড়া আইনটি বাস্তবায়নের জন্য।
এ ছাড়া মহিলা আইনজীবী সমিতি কিছু কমিটির সঙ্গে ‘গুড প্যারেন্টিং’ নিয়ে কাজ করছি। পাশাপাশি স্কুলগুলোতে ‘পজিটিভ ডিসিপ্লিন’ নিয়েও কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। যুবসমাজকে বিপথে যেতে দিতে পারি না, সে জন্য পরিবারগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনকে নিজ নিজ এলাকার দায়িত্ব নিতে হবে। যেসব এলাকায় বেশি ইভ টিজিংয়ের ঘটনা ঘটত যেমন—কসবা, কেরানীগঞ্জ—এসব এলাকায় শিক্ষক, সাংবাদিক, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে নিয়ে কমিটি করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে এসব এলাকা এখন শতভাগ ইভ টিজিংমুক্ত হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এভাবে প্রতিটি এলাকায় এ ধরনের কমিটি গঠনের মাধ্যমে সমাজের সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে ইভ টিজিং প্রতিরোধের জন্য।

সুমনা শারমীন
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।

শাহীন আনাম
আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সবার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে সমস্যাটি সমাধানের জন্য। কতগুলো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও ভূমিকার দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। একদিকে আছে আইন, পাশাপাশি আরেক দিকে আছে পরিবার ও সমাজ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আসলে সমাজ নারীকে কোন অবস্থানে দেখতে চায়। বর্তমানেও আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান কোন জায়গায় আছে, সেদিকেও দৃষ্টিপাত করতে হবে। আমি মনে করি, বর্তমানে সমাজের নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি, তার পরিবর্তন আনা দরকার অতি জরুরিভাবে। নারীদের সমাজে দেখা হয় এখনো দুর্বল, নির্ভরশীল ও পণ্য হিসেবে। একটি ছেলে মনে করে, সে কোনো মেয়েকে চাইল কিন্তু পেল না, সে তাকে না করে দিলে ছেলেটি তার মুখে এসিড নিক্ষেপ করবে, তাকে পুড়িয়ে দেবে, তাকে ভয়ভীতি দেখাবে, মারবে কিংবা ধর্ষণ করবে। সম্প্রতি এসবের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছে, তাদেরও মেরে ফেলা হচ্ছে। নারীর যে সমাজে একটা অবস্থান আছে, সেটি একটি বিরাট ক্যাম্পেইন করে সমাজের সবাইকে সচেতন করতে হবে।
আমরা যদি আমাদের আইনগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, অনেক ভালো আইন করা হয়েছে, আইনগুলোর সংশোধন করা হয়েছে। আমাদের সুরক্ষার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরাও তাঁদের কাজ করছেন। তবু আমরা এখন পর্যন্ত একটি নারীবান্ধব বিচারব্যবস্থা পাইনি। একজন নারী যখন বিচার চাইতে যান, তখন তাঁকে কী পরিমাণ হয়রানির শিকার হতে হয় এবং মাঝপথে তাঁকে বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা ছেড়ে দিতে হয়। সুতরাং আমাদের বিচারব্যবস্থা নারীর পক্ষে নেই।
সমাজের দিকে যদি তাকাই, যে মেয়ে একটু সাহসী, আত্মনির্ভরশীল; সমাজ বলবে, মেয়েটি বেশি বাড়াবাড়ি করছে। সমাজ বলবে, এই মেয়েকে ঘরে বন্ধ করে ফেলো। অবশ্যই ১০-১৫ বছরে আমাদের সমাজের নারী-দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নারীরা বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছেন। তা সত্ত্বেও নারীর বিরুদ্ধে সমাজের একটি চাপ কিন্তু রয়েই গেছে।
পরিবারের দিকে লক্ষ করলে দেখি, মেয়েদের পরিবারগুলো সাহস দিচ্ছে না। পরিবার কীভাবে একটি মেয়েকে মানুষ করছে, আমরা তাদের সাহসী ও আত্মনির্ভরশীল হতে দিচ্ছি না। আমরা মেয়েদের সেই জায়গায় রেখে দিতে চাইছি, যেখানে সে দুর্বল ও নির্ভরশীল। তরুণ সমাজের ছেলে ও মেয়ে উভয়ের কাছে আমাদের আবেদন, তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক মেলামেশার শিক্ষা দিতে হবে। ছেলেমেয়েদের একে অপরের প্রতি সম্মান দেখানো শিক্ষা দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সমাজে নারীর অবদানের কথা সবাইকে স্বীকার করতে হবে। নারীরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে অবদান রাখছেন, তা একজন পুরুষের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। নারীর এই অবদানকে আমরা সম্মান, মূল্যায়ন কিংবা কোনো মর্যাদা দিই না। আমরা যদি নারীর সম্মান ও সমাজে তাঁর অবদান—এসব বিষয়ে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়াতে পারি, তবেই নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা সম্ভব।
পরিশেষে আমি তরুণীদের কাছে বলতে চাই, সমাজ তাকে কীভাবে দেখছে, সেটি ভিন্ন বিষয়; কিন্তু সে নিজেকে নিজে কীভাবে দেখছে, সেটি হচ্ছে মূল বিষয়। তরুণীরা নিজেদের কেন দুর্বল মনে করবে। সে নিজেকে সাহসী-আত্মনির্ভরশীল মেয়ে হিসেবে তৈরি করে সব বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাবে। অবশ্যই সে একা করতে পারবে, এ জন্য তার সহযোগী, পরিবারের সাহস, স্কুল ও সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। কিন্তু তাকে নিজেকেও সেভাবে দেখতে হবে। আজকে ছোট ছোট উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে যেমন—কারাতে শেখানো, যার মাধ্যমে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। মেয়েদের তৈরি করতে হবে আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা, আত্মরক্ষার দিকে, যা নির্ভরশীল না হওয়ার দিকে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা একটি সুযোগ পেয়েছি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করার, এ অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য। একটি সমন্বিত কমিটি করা যেতে পারে, যারা নিয়মিত মনিটরিং করবে, বর্তমান অবস্থার কোনো পরিবর্তন আসলেই হচ্ছে কি না। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে নিয়মিত। আরেকটি বিষয়, যখন এ ধরনের সংবাদগুলো গণমাধ্যমে আসে, তখন বেশ হইচই পড়ে, কিন্তু কিছুদিন পর বিষয়গুলো হারিয়ে যায়। আমাদের উচিত, নিয়মিত এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হচ্ছে কি না, তার ফলোআপ নিউজ করা। আমাদের সবাইকেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য।

সুমনা শারমীন
তরুণীদের আত্মবিশ্বাসের কথা শুনব নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার্থী লিরানা রহমানের কাছ থেকে।

লিরানা রহমান
আমি যদি প্রতিবাদ করিও, দেখা যাবে, আমার পরিবার বলবে, অন্যরা তো কেউ করছে না, তুমি কেন করছ। আমাদের সবাইকেই জানতে হবে, এটি আমার অধিকার। আমাকে অন্যরা কেন উত্ত্যক্ত করবে, আমি এর প্রতিবাদ করতেই পারি। এ অধিকার আমাদের জানতে হবে এবং সবাইকে জানাতে হবে। আমাদের সমাজ মেয়েদের সেই অধিকার দেবে। আমরা আমাদের অধিকার পাব, আমরা আমাদের কথা সবাইকে জানাতে পারব—এতে লজ্জার কিছু নেই। যদি এটি লজ্জা মনে করি, তবে এটি আমাদেরই লজ্জা। আসলে, যারা আমাদের উত্ত্যক্ত করছে, লজ্জা পাওয়া তাদেরই উচিত। এটি উত্ত্যক্তকারীর জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে প্রত্যেক তরুণীকে সচেতন হতে হবে।

সুমনা শারমীন
আলোচনার এ পর্যায়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমানকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

মিজানুর রহমান
বর্তমানে ইভ টিজিং একটি ফৌজদারি অপরাধ। ফৌজদারি আইনানুযায়ী এর বিচার হতে হবে। যদি এটি ফৌজদারি অপরাধ হয়ে থাকে, তবে এটি আমাদের আইনে কীভাবে দেখব সেটি কিন্তু একটু সমস্যাসংকুল হয়ে দাঁড়ায়। সমাজে নতুন নতুন যে সমস্যা আমরা দেখছি, সেগুলোকে সনাতনী আইনবিজ্ঞানে ঠিক সেভাবে গ্রহণ করা হয়নি। আমার কাছে মনে হয়েছে, নারীর বিরুদ্ধে যে নির্যাতন বা সন্ত্রাস, তার একটি রূপ হচ্ছে এই ইভ টিজিং। একে অপরাধ হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে এর মোকাবিলা করার চিন্তা আমাদের করতে হবে। যদি প্রশ্ন দাঁড়ায়, কেন এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, এ জন্য সমস্যার মূলে আমাদের যেতে হবে। কেন এ অপরাধটি হচ্ছে? এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার যে সংস্কৃতি আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে সেটি। অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া এবং শাস্তি হবে না—এ ব্যাপারে অপরাধীরা নিশ্চিত থাকে বলেই বারবার এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। তাই এই অপরাধ করা ক্ষমতারই একটি বহিঃপ্রকাশরূপে প্রতিপন্ন হয়। তাই অপরাধপ্রবণতায় আমি ভুগছি এবং বারবার একই অপরাধ করছি। এর পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণটি যদি উড়িয়ে দিই, তবে এটি একটি বড় ভুল হবে।
আজকে আমাদের সমাজে নারীদের যে উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে, এটিও কিন্তু সেটির একটি সুদূরপ্রসারী ফলের বহিঃপ্রকাশ। যারা সর্বোচ্চ অপরাধ করেছে, তাদের আমরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বারবার বিলম্ব করছি বা ব্যর্থ হয়েছি।
এ ছাড়া আরেকটি দিক হচ্ছে, এসব অপরাধীর পেছনে পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। আমরা পরিসংখ্যানে দেখেছি, আমাদের নিম্নশ্রেণীর ছেলেরা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে তুলনামূলক কম সম্পৃক্ত। সমাজে যাদের প্রভাব রয়েছে, তারাই কিন্তু এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা নির্দ্বিধায় এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। কারণ তারা জানে, তারা অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে কী পন্থা অবলম্বন করলে এই অপরাধপ্রবণতা দূর করা যায়, সে বিষয়ে চিন্তা করা দরকার।
আরেকটি কথা আসছে, মূল্যবোধের অবক্ষয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে এ ধরনের নীতিহীনতা যেন আমরা দেখতে পাচ্ছি। যার যেমন ইচ্ছে, সে সেভাবে তার বিদ্যালয় পরিচালনা করতে পারে। কয়েক দিন আগে আমি বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখানে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠিত একটি বিদ্যালয়ের লাইব্রেরি দেখতে চেয়েছিলাম। তখন সেই লাইব্রেরিটি খুলতে অনেক সময় লেগে গেল। যখন লাইব্রেরির তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম তখন বুঝতে পারলাম, কয়েক বছর ধরে এই লাইব্রেরির তালাটি খোলা হয়নি।
আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে সহশিক্ষার ব্যবস্থা কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
আমাদের এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য পরিবারকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। কারণ, মানুষের জীবনে সবচেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে তার পরিবার। আমাদের মা-বাবাকে তাঁদের সন্তানকে বেশি করে সময় দিতে হবে। সন্তানেরা কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে, সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে মা-বাবাকে। দ্বিতীয়ত, আমাদের এ সমস্যা সমাধানে জাতীয় মতৈক্যের কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন, যারা বখাটে, যারা অপরাধ করে, যারা সন্ত্রাসী, তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। আমরা এ কথাটি বিশ্বাস করতে চাই। যারা নারীদের উত্ত্যক্ত করার মাধ্যমে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দল-মতনির্বিশেষে একই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে সমগ্র জাতির উদ্দেশে তারা বলবে, এ অপরাধ আমরা আর হতে দেব না। এটি যদি সম্ভব হয়, তবে এটি কল্পনাতীত শক্তি হিসেবে সমাজে কাজ করবে এ ধরনের অপরাধ নির্মূলের জন্য। আর আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে।
একটি জেলায় আমাকে সেখানকার এসপি জানালেন, ওই জেলায় যেসব ছেলে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে, তাদের জুতার মালা পরিয়ে কিংবা কান ধরিয়ে সারা শহর ঘোরানো হবে। এটি সভ্য সমাজে হতে পারে না। একজন অপরাধী অপরাধ করতে পারে। কিন্তু একজন অপরাধীর সঙ্গেও একটি সভ্য সমাজকে মানবিক আচরণ করতে হবে—এটি হচ্ছে মানবাধিকারের কথা। এখানে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে, আমরা আমাদের আইনের শাসনটি কীভাবে নিশ্চিত করব। আমরা কিন্তু এখনো খতিয়ে দেখিনি, অপরাধগুলো কারা করছে। যদি ১৮ বছরের নিচে বয়স হয়, তবে এ আইনটি শিশু আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে। তাদের তো আমরা শাস্তি দিতে পারব না। তাদের সংশোধন কীভাবে করা যায়, সে ব্যাপারে কাজ করতে হবে। আমাদের গবেষণা করে বের করতে হবে, কারা অপরাধ করছে, তা বন্ধের জন্য আমাদের কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা দরকার। আমি জেল পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছি, ১৪-১৬ বছরের কিশোরেরা যারা দু-তিন বোতল ফেনসিডিল বা মাদকদ্রব্য বহন করার সময় ধরা পড়েছে, তাদের বিচারের সম্মুখীন না করে জেলহাজতে বন্দী করে রাখা হচ্ছে। এসব মাদকদ্রব্যের মূল হোতারা কিন্তু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। আমাদের স্কুলগুলোকে এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে, যাতে পড়াশোনার অভ্যাসটি আবার ফিরিয়ে আনা যায়, মূল্যবোধের চর্চা যেন সেখানে করা হয়, আলোকিত মানুষ যেন সেখানে গড়ে ওঠে।

সুমনা শারমীন
জনপ্রিয় তরুণ টিভি উপস্থাপক ও বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশনের সভাপতি আব্দুন নূর তুষারকে অনুরোধ করছি বলার জন্য। তরুণেরা বিতর্ক করে নিজেদের চিন্তাভাবনার পরিধিকে আরও প্রশস্ত করেন।

আব্দুন নূর তুষার
আমাদের সমাজে হতাশা রয়েছে। বিশেষ করে, এ ধরনের গোলটেবিল বৈঠকগুলোতে হতাশার কথা বেশি শুনে থাকি। আমরা আসলে এসব হতাশা থেকে মুক্তি চাই বলেই এ ধরনের অলোচনায় অংশ নিই। আমরা আজকের আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটি চিহ্নিত করেছি। সমস্যার পেছনের কারণগুলো তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, এ সমস্যার পেছনে একটি আর্থিক কারণ আছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের ছেলেরা এ অপরাধ বেশি করছে। সামাজিক, আইনি, মানসিক প্রশ্রয় ইত্যাদি কারণ আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমি বলতে চাই, উত্ত্যক্ত করার পেছনে একটি সাংস্কৃতিক কারণও কিন্তু আছে। আমরা ভুলে গেছি, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও মুক্ত সংস্কৃতি আসলে এক কথা নয়। অর্থনীতি আমাকে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি নিশ্চিত করবে। কিন্তু সমাজপতিদের দায়িত্ব হবে, সামাজিক সংস্কৃতি নিশ্চিত করা। আমাদের সমাজের সংস্কৃতি কী হবে, মানুষ কী গান শুনবে, কী কবিতা পড়বে, কী লিখবে, কী নাটক দেখবে—এ বিষয়গুলো কিন্তু আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা একধরনের জাগতিক উন্নয়নকে ধরে নিয়েছি আমাদের উন্নয়নের সূচক। আমরা আমাদের মানসিক উন্নয়নকে নিশ্চিত করতে পারিনি। ফলে আজকে যখন বলি, আমরা মানবসম্পদ উন্নয়ন করেছি, ১৬৯তম অবস্থান থেকে ১২৯-এ চলে এসেছি। আমাদের ৪০ ধাপ অগ্রগতি হয়েছে। আমরা কিন্তু লক্ষ করি না, একই সঙ্গে মানবিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলছি। আমরা মানসিকভাবে পশ্চাৎপদ একটি জাতিতে পরিণত হয়েছি।
ফলে এ জায়গাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সমাজের সংস্কৃতি আসলে কী হবে। জাতীয় গণমাধ্যম এটি নিশ্চিত করতে পারত। সরকার এবং যাঁরা সমাজসচেতনতা বিষয় প্রচার করেন, তাঁরা এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারতেন। আমরা একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারতাম এ সমস্যা সমাধানে। আজকে যখন মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো যেন সুযোগ করে দেয়, বলে, এত তাড়াতাড়ি প্রেম নিবেদন করার কী দরকার। রাতে সাশ্রয়ে দীর্ঘ সময়ে ফোনে কথা বলার পর প্রেম নিবেদন কর। তখন সে কোম্পানিগুলো যুবসমাজকে প্রলোভন দেখায়, তোমরা সারা রাত ফোনে কথা বলো, কারণ রাতে ফ্রি, কিংবা ২৫ পয়সায় কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে, তখন আমি কিন্তু আদালতের সেই রায়টির বিরুদ্ধে যাচ্ছি। যেখানে বলা হয়েছে, আমি টেলিফোন, মোবাইল ফোন কিংবা এসএমএস করে কাউকে উত্ত্যক্ত করতে পারব না। আমরা এ ধরনের বিষয়টি প্রশ্রয় দিচ্ছি। কারণ, মুক্ত বাজার অর্থনীতি আমাদের বলে, বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে, আয় বাড়াতে হবে, লাভবান হতে হবে। আমরা সামাজিক লাভের কথা ভুলে গিয়ে আর্থিক লাভকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। এ জায়গা থেকে আমাদের সমাজকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আমি গর্ব করে বলতে পারি, যে ছেলেটি গান করে, কবিতা পড়ে, বিতর্ক করে, সাংবাদিকতা করে, কিন্তু সে ছেলেটি ইভ টিজিং করে, এটা যদি কেউ দেখাতে পারেন, তবে আমি এ ধরনের জায়গায় এসে কখনো বক্তব্য দেব না। একজন সংস্কৃতিমনা কিংবা খেলোয়াড় অথবা সমাজে কোনো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন, তিনি ইভ টিজিং করেন না। কারণ, তাঁর হাতে সময় নেই এসব করার।
আমরা ছেলেদের কাজের জায়গা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে এসে তাকে বুঝিয়েছি, মোটরসাইকেল থাকা মানে হচ্ছে পুরুষ হওয়া। আমাদের সমাজ আজ পর্যন্ত এ সংজ্ঞাই নির্ধারণ করতে পারেনি—পুরুষ কে, কাপুরুষ কে, সুপুরুষ কে, কিং পুরুষ কে ও নপুংসক কে। কাকে আমরা পুরুষ মনে করি। সে পুরুষ কি ভাই, সেই পুরুষ কি বন্ধু, সেই পুরুষ কি প্রেমিক, সে পুরুষ কি আমার আত্মীয়, নাকি সে পুরুষ হচ্ছে নির্যাতনকারী। যে দাঁড়িয়ে থাকে আমার স্কুলের পথে, যে বাধা দেয় আমার বড় হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে, যে আমাকে বাধা দেয় বিকশিত হতে। আজকে পুরুষের সামনে রোল মডেল কে—এ জায়গাটি আমরা তৈরি করতে পারিনি।
সরকার আজকে সরকারি সংবাদ প্রচারের জন্য বেসরকারি চ্যানেলগুলোকে বলে আধা বা এক ঘণ্টা সময় ছেড়ে দিতে। আমরা বলব, সরকারের উচিত, তা না করে চ্যানেলগুলোর কাছে সময় নিয়ে সেখানে সরকারি বিজ্ঞাপন প্রচার করা, যেখানে ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে, এসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, নারীর অধিকারের পক্ষে এবং শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সামাজিক বিজ্ঞাপন বেশি করে প্রচার করতে হবে জনগণকে সচেতন করতে।
আমরা অনেক সময় নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য যে আইনগুলো করি, নারীর দুর্বলতার কথা মাথায় রেখে এ আইনগুলো নারীকেন্দ্রিক করে ফেলি। আইনগুলো মানবকেন্দ্রিক হওয়া উচিত। ইভ টিজিংয়ের যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত। পাশ্চাত্যে পুরুষেরাও এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আজকে আমাদের সমাজে পুরুষেরা সুযোগ পেয়ে এ কাজটি করছেন। আমাদের আসলে আরও বেশি লিঙ্গনিরপেক্ষ হওয়া উচিত। কেউ কাউকে ব্ল্যাকমেইলের শিকার বানাতে পারবে না। আজকে যখন একজন তারকা এভাবে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হন যে তাঁর ভিডিওচিত্র সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশির ভাগই তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। আমরা বলেছি, সেই ছেলেটির শাস্তি হওয়া উচিত। আমরা নিজেকে এ ঘটনাটি থেকে সরিয়ে রেখেছি।
আমাদের ত্রিমুখী পরিকল্পনা নেওয়া উচিত এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে। সরকার এরই মধ্যে একটি উদ্যোগ নিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ইভ টিজারদের শাস্তি নিশ্চিত করতে। কিন্তু আমাদের মধ্যে এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার জন্য যারা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের কাছে আমাদের যাওয়া উচিত। তাদের মানসিকতার বিশ্লেষণ করে, কারণগুলো চিহ্নিত করে সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আমাদের সংশোধনী প্রক্রিয়ায় এগোতে হবে। শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজে সাময়িক সময়ের জন্য কোনো অপরাধ বন্ধ করতে পারি। সংশোধিত না হলে এ সংখ্যা আবার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে। এদের একই ধরনের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। প্রায় প্রত্যেক ইভ টিজারের মোটরসাইকেল থাকে। এরা টাকা দিয়ে তেল ভরে, সেই মোটরসাইকেল নারীর গায়ে, মায়ের গায়ে কিংবা শিক্ষকের গায়ে তুলে দিচ্ছে। যে দেশে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বেকার, সে দেশে কীভাবে ১০-১৫ জন ছেলে টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কিনে ঘুরতে পারে, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে!
যদি শুধু এসব মোটরসাইকেল ইভ টিজারদের হেলমেট ব্যবহার করা, লাইসেন্স আছে কি না, এখানে কী করো—এ বিষয়গুলো পুলিশ জিজ্ঞাসা করত, তাহলে এগুলো অনেকটা বন্ধ হয়ে যেত। কারণ, হেলমেট পরে ইভ টিজিং করা যায় না। কারণ, ইভ টিজারকে চেহারা দেখাতে হয়। সে ভালো জামা পরে মোটরসাইকেলে বসে মেয়েদের চেহারা দেখিয়ে উত্ত্যক্ত করে থাকে। সাধারণ আইন ব্যবহার করে অনেক অসাধারণ অপরাধ দূর করা সম্ভব।
আমরা শুধু ভাবি, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ নির্মূল করব, গাড়ি-ট্যাক্সি চেক করে বোমা উদ্ধার করব। কিন্তু যে বোমা আমাদের হূদয়ে তৈরি হচ্ছে, সে বোমা যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বন্ধ করতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সমাজ মুক্ত হতে পারবে না। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রমের আরও ব্যাপক আয়োজন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের বই পড়া, নাটক, গান ও বিতর্ক করার সুযোগ করে দিতে হবে তাদের মানসিক বিকাশের জন্য। সমাজ শুধু ভালো ছাত্রদের দিয়ে তৈরি হয় না, ভালো খেলোয়াড়, ভালো গায়ক দিয়েও তৈরি হয়।
আমাদের হতাশ হলে চলবে না যে তরুণ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এসব বখাটের সংখ্যা অতি নগণ্য। আমাদের তরুণদের অনেক সাফল্য রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। তরুণদের এসব সাফল্যকে সমাজের সামনে তুলে ধরে আদর্শ তরুণের মডেল সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। সমাজ উন্নয়নের সূচক শুধু টাকাপয়সা নয়। আমি বাংলাদেশে নারীর অধিকার নিশ্চিত হয়েছে তখনই বুঝতে পারব, যখন জেলখানার মতো দেয়াল তুলে মেয়েদের স্কুল ও হোস্টেলকে আমাদের সমাজের কাছ থেকে আলাদা করতে হবে না। যতই এই দেয়ালগুলো নিচু হতে থাকবে, তখনই আমরা বুঝব, মেয়েদের জন্য সমাজ নিরাপদ হয়েছে। মেয়েদের কি সারা জীবন দেয়াল তুলে বন্দী করে রাখব? তারা কি সেখান থেকে বের হয়ে আসবে না, আমাদের পাশাপাশি তারাও কি কাজ করবে না? নারীদের সমাজে অবস্থান গড়ে তোলার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

সুমনা শারমীন
আমরা অনেক সময় যেটি অপরাধ, সেটিকে আঙুল তুলে বলি না, এটি অপরাধ। এর শাস্তি হওয়া উচিত। এখন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগমকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

হোসনে আরা বেগম
উত্ত্যক্তের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অনেক দূর এগিয়ে আসতে হবে। ১৮ বছরের নিচের বাচ্চাদের শাস্তি দেওয়া যাবে না। ১৮ বছরের নিচের বাচ্চারা স্কুল-কলেজে পড়ছে। তাদের যদি মানবিক শিক্ষাবোধ দিতে পারি, নীতিশিক্ষা দিতে পারি, তাহলে তাদের অপরাধপ্রবণতা অনেকটা কমে যাবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষকদের জন্য নির্দেশিকামূলক বই দেবেন। মোবাইল ফোন মেয়েরাও স্কুলে নিয়ে আসে। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তারা লুকিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে আসে। অনেক ছাত্রীকে হাতেনাতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের অভিযোগে ধরেছি এবং তাদের অভিভাবকদের ডেকে জানতে পেরেছি, মোবাইল ফোনটি তার পরিবার তাকে দেয়নি। এটি দিয়েছে ‘জান’ নামের কেউ একজন। মোবাইলে মেসেজ পর্যন্ত পাঠায় ‘জান’ নাম দিয়ে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষক ও অভিভাবকদের আরও সতর্ক ভূমিকা পালন করা উচিত।
আমি শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করব, শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণগুলো হয়, সেখানে শিক্ষকদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হবে ছেলেমেয়েদের ক্লাসরুমে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে। শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের সমস্যা জানতে হবে এবং সমাধানে সুপরামর্শ দিতে হবে। মেয়েরাও অনেক ছেলেকে উত্ত্যক্ত করে আমার জানামতে। যেহেতু আমি মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছি, সে ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে উভয়কেই আমাদের শিক্ষা দিতে হবে—এটি নৈতিকতাবিবর্জিত কাজ। মানবিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবন্ধ, গল্প—এগুলোর মধ্য দিয়ে নৈতিক কথাগুলো নিয়ে আসতে হবে। ছোট বয়স থেকে যদি নীতিকথাগুলো রপ্ত করতে পারে, তাহলে নৈতিক মূল্যবোধের দিকে ছেলেমেয়ে উভয়ই সঠিক পথে এগিয়ে যাবে। তখন আর ইভ টিজিংয়ের মতো ঘটনা ঘটবে না।
আমি মনে করি, পাড়ায় পাড়ায় কিংবা মহল্লায় স্থানীয় সাংস্কৃতিক দলগুলোকে আরও শক্তিশালী ও সচেতন হতে হবে অপসংস্কৃতি রোধের জন্য। আমাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরি নিয়মিত খোলা রাখতে হবে, যাতে ছেলেমেয়েরা সেখানে যেতে পারে এবং বই পড়তে উৎসাহিত হয়। আমাদের জাতীয় বিভিন্ন দিবসে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করতে হবে। ছেলেমেয়েদের সচেতন করতে হলে তাদের ভালো কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে হবে। ফলে তাদের নৈতিকতার উন্নয়নের মাধ্যমে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের সব প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এ সমস্যা প্রতিহত করার জন্য।
মেয়েদের আত্মহত্যার বিষয়ে বলতে চাই, তাদের মানসিকতাকে আরও বলিষ্ঠ করার জন্য সাহস জোগাতে হবে। কেউ ইভ টিজিং করলেই তাকে আত্মহত্যা করতে হবে—এ ধরনের মানসিকতা থেকে মেয়েদের বের করে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের শিক্ষকদের এসব বিষয়ে আরও খোলামেলাভাবে শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা উচিত।

সুমনা শারমীন
আলোচনার এ পর্যায়ে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের অধ্যক্ষ কর্নেল এ এস এম মুশফিকুর রহমানকে বলার জন্য অনুরোধ করছি। তাঁর প্রতিষ্ঠানে ছেলে মেয়ে উভয়েই পড়াশোনা করছে।

এ এস এম মুশফিকুর রহমান
আমাদের পুরোনো যে মূল্যবোধ, সেটি ভেঙে পড়ছে। আমরা নতুন কোনো মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে পেরেছি কি না, জানা নেই। আমি ছেলেমেয়েদের যখন মোটিভেট করতে যাই, তখন আমি নিজেই প্রশ্ন করি, তাদের অনেক অভিভাবকই আমাদের বলেন তাঁদের ধর্মকর্মের প্রতি মনোযোগী করার কথা। তাবলিগের একদল লোক এসে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে আমি যদি আমার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এসব ধর্মীয় মূল্যবোধে সচেতন করতে পারি, তবে অনেক সওয়াব পাব। আমাদের অনেক অভিভাবকই এ ধরনের মতাবলম্বী। তাঁদের সন্তানদের যদি একেবারে তালেবান বানিয়ে দিতে পারি, তাহলেও বোধ হয় তাঁরা খুশি। আবার একদল অভিভাবক আছেন, যাঁরা পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসারী। তাঁদের সন্তানদের পোশাকআশাক, চলাফেরা এমন হয়, যেগুলো আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না।
বর্তমানে আধুনিক স্যাটেলাইট যুগে আমরা আমাদের পুরোনো বাঙালিয়ানা ধরে রাখতে পারছি না। কারণ, আমরা বিশ্বায়নের এই যুগে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারব না। আমরা যদি আমাদের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করতে না পারি, তবে তাদের মূল্যবোধের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। আমরা কি জাতীয়ভাবে নির্ধারণ করতে পেরেছি, যাঁরা নীতিনির্ধারক আছেন, দল-মতনির্বিশেষে প্রকৃতপক্ষে কী মূল্যবোধ নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দেব, তা ঠিক করতে পারিনি। সবাইকে মতৈক্যে পৌঁছাতে হবে, আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ কী হবে, তা নির্ধারণের জন্য। আমাদের অনেক বৈপরীত্য আছে। আমরা ছেলেমেয়েদের ওয়েস্টার্ন কালচার অনুসরণ করতে দিচ্ছি, স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিচ্ছি। আবার আমরা ছেলেমেয়েকে ডেটিং করতে অনুমতি দিচ্ছি না। যেহেতু পশ্চিমা সংস্কৃতি এসব অনুমতি দিচ্ছে, কিন্তু আমরা দিচ্ছি না। ফলে তাদের যে জৈবিক চাহিদা আছে, সে ব্যাপারে আমরা আবার অত্যন্ত সংকীর্ণ মনোভাব পোষণ করছি। এ ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
আবার অনেকে পর্দানশিন হয়ে চলাফেরা করে। কিন্তু তাদের অভিভাবকদের অনেকেরই হয়তো আয়ের উৎস সৎ নয়। তাঁরা যতই মূল্যবোধ শিক্ষা দেন না কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যেখানে পারিবারিক মূল্যবোধটা অত্যন্ত জরুরি, সেখানে কতজন অভিভাবক পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সৎভাবে জীবন যাপন করছেন! নানা ধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও অসৎ পথের সঙ্গে অনেকে জড়িত। আমরা যদি এই সামাজিক বৈপরীত্যগুলো দূর করতে না পারি, তবে এ ধরনের একটিমাত্র উপসর্গ ইভ টিজিং প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যেখানে এ সমস্যাগুলোর কারণ চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। পরিবর্তিত যুগের সুচিন্তিত মতামত, আমাদের কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, সে ধরনের একটি দিকনির্দেশনা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেওয়া উচিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।

সুমনা শারমীন
মেয়েদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস। মেয়েদের না পেলেই তাদের প্রতি সহিংস আচরণ করা হয়। এখন বলবেন অভিনেত্রী জয়া আহসান।

জয়া আহসান
যে সমস্যাটি নিয়ে আমরা আজকে কথা বলছি, আমার মত হচ্ছে, এটি সমাজে ব্যাধির আকার ধারণ করেছে। আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান কী, বিষয়টি আগে জানা দরকার। আমরা নারীরা জানি যে সমাজে আমরা দুর্বল। সমাজের প্রায় অর্ধেক অংশ নারী। সেই অর্ধেকাংশ নারীই কিন্তু আজকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। পুরো জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষই আজকে নিশ্চয়ই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। সমাজে নারীর ক্ষমতায়নকে আরও বাড়াতে হবে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আসলে আমাদের পরিবার থেকে কাজ শুরু করতে হবে। আমরা সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি। আমাদের বর্তমানে একক পরিবার দেখছি। আগে যেমন এক পরিবার অন্য পরিবারের খোঁজখবর নিত, কিন্তু বর্তমানে পরিবারগুলোর মধ্যে মেলবন্ধন অনেকটা হালকা হয়ে গেছে। আমরা আসলে আরেক পরিবারের বোনকে বোন মনে করতে পারছি না।
আমাদের সাংস্কৃতিক দলগুলো খুব বেশি জরুরি। তরুণদের এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখা প্রয়োজন তাদের মানসিক গঠনের জন্য। আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের হাত থেকে তরুণ সমাজকে বাঁচাতে হবে। আগের দিনে আমরা নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম। আমাদের মা-বাবা জিজ্ঞেস করতেন, আজকে সম্পাদকীয়তে কী লিখেছে। কিন্তু বর্তমানে তরুণেরা পত্রিকা পড়ে না। আমার মত হচ্ছে, সামাজিক অনুশাসনের পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসনের কিছুটা হলেও প্রয়োজন রয়েছে আমাদের সমাজে। তরুণদের বিদ্বেষী না হয়ে সহমর্মিতার হাত বাড়ানো উচিত।

সুমনা শারমীন
আমাদের তরুণদের নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। আমরা এখন তেমনই এক যোগ্য তরুণ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের কথা শুনব।

হাবিবুল বাশার
সম্প্রতি যখন উত্ত্যক্তকরণের ঘটনাগুলো ঘটছে, মেয়েরা আত্মহত্যা করছে, তখন প্রথমে আমি খুবই চিন্তিত ছিলাম। পরে যখন উত্ত্যক্তকারীরা এতটা সহিংস হয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের হত্যা করল, তখন আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। এগুলো আমাদের চিন্তার বাইরে ছিল, যা আমরা কখনো মেনে নিতে পারি না।
সম্প্রতি এ ঘটনাগুলো পর পর বেশ কয়েকটি ঘটেছে। এটি বন্ধ করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। আজকে দেখলাম, ইভ টিজারদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনটি হয়েছে। এতে আমি কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, আমাদের দেশে যখন মামলা হয়, তখন দীর্ঘ সময় পর তা নিষ্পত্তি হয়, যাতে আমরা আসলে জানতেও পারি না বিচার কী হয়। যারা এ ধরনের অপরাধ করছে, তাদের মনে একধরনের বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে যে অপরাধ করে পার পাওয়া যায়।
আমাদের আসলে অপরাধের বেশ কিছু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ জনগণের সামনে তুলে আনা দরকার, যাতে অপরাধীরা সতর্ক হয়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে অনেকভাবে পরিচিত হচ্ছে। আমরা নিশ্চয় চাইব না যে বিশ্বে বাংলাদেশ এভাবে পরিচিত হোক, যেখানে মেয়েদের নির্যাতন করা হয়। ইভ টিজিংয়ের মাধ্যমে মেয়েদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়। সামাজিক প্রতিরোধের জন্য পরিবার একটি মূল প্রতিষ্ঠান। কারণ, পরিবার হচ্ছে একটি মানুষের সবচেয়ে বড় স্কুল। পরিবারের কাছ থেকে আসলে সে কী শিখে আসছে, তা তার চরিত্রে বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
আমি যেহেতু খেলাধুলা করি। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমি যে মফস্বল শহরে থাকতাম, সেখানে বিকেলে খেলাধুলা করতে যে মাঠে যেতাম, এখন সেই মাঠটি ব্যবহূত হচ্ছে আড্ডা মারার জন্য। আমরা জানি, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডাখানা। আমাদের আসলে চিন্তা করতে হবে, অবসর সময়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা আসলে কী করবে। অবসর সময়ে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা কিংবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যাতে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে, সে ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আগে স্কুলে স্কুলে বিভিন্ন মেলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো। বর্তমানে এগুলো অনেক কমে গেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত রাখা যায়, যাতে অবসর সময়ে আড্ডা মেরে অযথা সময় নষ্ট না হয়।

সুমনা শারমীন
কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা মনে করি, অপরাধী কি ধরা পড়বে? আর ধরা পড়লে আসলে তাদের বিচার হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় থাকি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বলবেন।

এলিনা খান
উত্ত্যক্ত-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আইনের মাধ্যমে কেন বিচার পায় না ভুক্তভোগীরা, তা ইয়াসমীন ও সীমা চৌধুরীর ঘটনার আলোকপাত করি, সেখান থেকে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করছি, সম্প্রতি চাঁপা রানী ও শিক্ষক মিজানুরের হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ইয়াসমীন ও সীমার পর অনেক ঘটনা ঘটেছিল, যখন সব নারী সম্মিলিত হয়ে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করে। অনেক ফাঁক ছিল চার্জশিটে, সাক্ষ্যে দুর্বলতা ছিল, সেগুলো থাকা সত্ত্বেও দিনাজপুর থেকে রংপুরে নিয়ে এসে আমরা তাদের পাশে থেকে ১৯৯৫-৯৬ সালের ঘটনার রায় ২০০৩ সালে পেয়েছিলাম দীর্ঘ সময় ধরে সবার সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমে। আমাদের সামনে যে দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আছে, এগুলোর ব্যাপারে যদি সরকার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে, তবে অপরাধীরা সতর্ক হবে যে অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না। ইয়াসমীনের মামলা এ সত্য প্রমাণ করলেও সীমার মামলা তা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে, যার জন্য বিচারক তাঁর রায়ে লিখতে বাধ্য হয়েছেন। একই ঘটনা ঘটে মানুষ জানে, ঘটার পর মাঝখানে কী হয় মানুষ তা জানে না। যখন বিচার শেষ হয়, তখন মানুষ জানে, আসামি ছাড়া পেল। মাঝখানে কী হলো, পুলিশ চার্জশিট ঠিকমতো দেয়নি কিংবা সাক্ষীর ঠিকমতো সাক্ষ্য নেয়নি, আলামত ঠিকমতো সংগ্রহ করা হয়নি। ফলে মামলা থেকে খালাস পেয়ে গেল আসামি। এর ভিত্তিতেই কিন্তু সীমার মামলাটি অন্যদিকে মোড় নিয়েছিল। এ বিষয়গুলোর ওপর আমাদের নজর দিতে হবে।
আজকে তরুণদের নিয়ে আলোচনা করছি। কিন্তু আমরা তাদের কাছে কতটুকু পৌঁছাতে পেরেছি। এ সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করতে হবে তাদের সঙ্গে, তাদের সচেতন করতে হবে। ইভ টিজিং করলে কী শাস্তি হবে কিংবা এর ক্ষতিকর দিকগুলো কী, এগুলো লিফলেট আকারে ছেপে সরকারের উচিত হেলিকপ্টার দিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া। তাহলে জনগণকে অনেকাংশে সচেতন করা যাবে। অথবা এ ধরনের লিফলেটগুলো যদি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়, তাহলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই সচেতন হতে পারবেন।
কিছুদিন আগে বিটিভিতে ইভ টিজিংয়ের বিষয়ে একটি বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে। সেখানে ইভ টিজিংয়ের কারণে কান ধরে ওঠানো-বসানো হচ্ছে। অদ্ভুত একটি ঘটনা আছে সেখানে। মেয়েদের বলা হচ্ছে, তুমি শালীনভাবে পোশাক পরে এসো। সেখানে ছেলেমেয়ে উভয়কে শালীন পোশাক পরার কথা বলা হচ্ছে না। আমাদের মনে একটি বদ্ধ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, মেয়েরা শালীন পোশাক পরে আসছে না বলে ছেলেরা ইভ টিজিং করছে। এ বিজ্ঞাপনটি আজই বন্ধ করা খুব জরুরি। আমাদের নাটক ও চলচ্চিত্রের গানগুলোর মাধ্যমে আমাদের সমাজে বদ্ধপরিকর ধারণা দেখানো হচ্ছে। নারীর ক্ষমতার কথা আমরা বলছি আবার চলচ্চিত্রে গানে বলা হচ্ছে, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত কিংবা নাটকে যাঁরা কর্মজীবী নারী আছেন, তাঁদের সন্তানেরা উচ্ছন্নে চলে গেছে। এ ধরনের চলচ্চিত্র ও নাটকের যে ভ্রান্ত ধারণা দেখানো হচ্ছে, তা বন্ধে সেন্সর বোর্ডের আরও সতর্ক হওয়া দরকার।
আরেকটি কথা, ঢাকায় সুপ্রতিষ্ঠিত একজন বিচারক তাঁর রায়ে বলেছেন, মেয়েরা বিয়ের আগে তার বাবার এবং বিয়ের পর তার স্বামীর তত্ত্বাবধানে থাকবে। এখন কিন্তু মেয়েদের আর নিজস্ব কোনো অস্তিত্বই থাকছে না। এ ধরনের মনোবৃত্তি আমাদের বিচার ব্যবস্থায় রয়েছে, সেখানে নারী অধিকার আদায়ের বিচারের প্রত্যাশা আমরা কীভাবে করতে পারি? আমি মনে করি, প্রথম আলোর মতো গণমাধ্যমগুলো যদি বিভাগীয় পর্যায়ে এ ধরনের ঘটনাগুলো নিয়মিত ফলোআপ করে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য শোভাযাত্রা ও সেমিনারের আয়োজন করে, তবে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারব।

সুমনা শারমীন
পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) এ কে এম শহীদুল হককে বলার জন্য অনুরোধ করছি।

এ কে এম শহীদুল হক
১৮৯৮ সালে ৫০৯-এ পেনাল কোড, এটি আগে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ছিল, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পেনাল কোড করা হয়। এখন শুধু পেনাল কোড বলা হয়। ১৮৯৮ সালেও কিন্তু ইভ টিজিং বিষয়টি ছিল। এর অনেক আগে থেকেই এই ইভ টিজিং বিষয়টি ছিল। সামাজিক পরিবর্তন কিন্তু চলছেই। যেসব কারণে এই সামাজিক পরিবর্তনগুলো হচ্ছে, এই যে আকাশ সংস্কৃতি বলুন আর যা-ই বলুন, এগুলো কিন্তু আমরা দমিয়ে রাখতে পারিনি। আমরা পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে অপ্রীতিকর ওয়েবসাইটের তালিকা করে বিটিআরসিকে দিয়েছিলাম এগুলো বন্ধ করার জন্য। কিছু মিডিয়ায় পশ্চিমা চ্যানেল বন্ধ করার সুপারিশও করেছিলাম। এগুলোর কোনো ফল আমরা পাইনি।
যেহেতু আমরা এসব সামাজিক বিবর্তন ঠেকাতে পারছি না, সুতরাং সমাজকেই দায়িত্ব নিতে হবে এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য। সমাজের প্রত্যেক নাগরিককে সচেতন করতে হবে। স্বশিক্ষিত লোকমাত্রই সুশিক্ষিত। কিন্তু আমাদের সমাজে স্বশিক্ষিত লোক পাওয়া যায় না। কারণ, আমার সন্তান কিন্তু আমাকে অনুসরণ করে না। আমাদের সন্তানেরা অভিভাবকদের কথা শোনে না। তারা মনে করে, অভিভাবকেরা প্রাচীন ধারণাবলম্বী। সামাজিক পরিবর্তন রোধ শুধু আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এই যে ৫০৯ ধারা নন-কগনিজেবল অপরাধ, পুলিশ এ অপরাধে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে না, কিংবা কোর্টের অনুমতি ছাড়া কারও বিরুদ্ধে তদন্ত ও অভিযান চালাতে পারে না। এ ধরনের আইনের মধ্যে থেকেও আমরা কাজ করেছি। পুলিশের পক্ষ থেকে মেয়েদের স্কুল-কলেজের আশপাশে সাদা পোশাকে পুলিশের অনেক সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। অনেককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এলে অভিভাবক, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা এসে মাফ চেয়ে মুচলেকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান। কিছু কিছু অপরাধীকে আবার কোর্টে চালানও করি। এ ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে অনেক স্কুলে কমিউনিটি পুলিশিং প্রোগ্রাম করেছি। এ বিষয়গুলো নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। মেয়েদের আমরা অভয় দিয়েছি। মেয়েরা যাতে আত্মহত্যা না করে, সে জন্য তাদের মানসিক সহযোগিতা দিতে হবে। এ জন্য অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে একসঙ্গে বসে খোলামেলা আলোচনার আয়োজন করেছি।
পুলিশের যে লোকবল আছে, তা ব্যবহার করে আমরা চেষ্টা করছি, কীভাবে সমস্যাটি সমাধান করা যায়। শিক্ষার্থীদের এই মানসিক বিকাশের জন্য যে ধরনের বই-পত্রিকা পড়া দরকার, তারা তা পড়ছে না। সম্প্রতি পেনাল কোড আইনটি ভ্রাম্যমাণ আদালতে অন্তর্ভুক্ত করায় দ্রুত কিছু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে এসব অপরাধীকে সতর্ক করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস। আইনের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করতে হবে, যেখানে তারা তাদের সন্তানদের সঙ্গে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে সচেতন করতে পারবে। আমরা থানাগুলোতে মেয়ে বন্দীদের জন্য আলাদা মহিলা পুলিশের সেল করার কাজ শুরু করছি, যাতে মেয়েদের সমস্যাগুলো খোলামেলাভাবে পুলিশের কাছে বলতে পারে। আমরা শুধু বখাটের কথা বলছি, কিন্তু যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা যৌন হয়রানি করেন, কর্মস্থলে কর্মকর্তারা নারীদের যৌন হয়রানি করছেন। এগুলো আসলে আমাদের সমাজের মানুষের মানসিক বিকৃতি কি না, তা নিয়েও ভাবতে হবে।

সুমনা শারমীন
আলোচনার এ পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন সোহেলী খাদিজা আজাদকে অনুরোধ করব বলার জন্য।

সোহেলী খাদিজা আজাদ
বর্তমানে যে ধরনের অপরাধ হচ্ছে, তাতে ইভ টিজিং শব্দটি অত্যন্ত লঘু অর্থে ব্যবহূত হয়। অপরাধের যে ব্যাপকতা, নারীর প্রতি ভয়াবহ মানসিক নির্যাতন যে ট্রমার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়, সে ক্ষেত্রে ইভ টিজিং শব্দটি খুবই সামান্য। আমার মতে, ইভ টিজিংয়ের পরিবর্তে যৌন হয়রানি শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে। শুধু আইন করে এ সমস্যাটি সমাধান করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন জেন্ডার সমতা। পারস্পরিক মর্যাদা দেওয়ার বিষয়গুলো শুধু মুখে না বলে সেটাকে বিশ্বাস করতে হবে এবং তা ধারণ করতে হবে। যখন পর্যন্ত এ বিষয়গুলো আমরা ধারণ করতে না পারব, ততক্ষণ আমরা সমতায়নের জায়গায় পৌঁছাতে পারব না। পরিবারের শিক্ষার পর যেহেতু সে স্কুলে যাচ্ছে, সুতরাং স্কুলের কারিকুলামেও এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তারপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা দরকার।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে যে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কমিটি হচ্ছে, সেখানে যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁদের বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানির এবং এর ধাপগুলো সম্পর্কে জানা আছে কি না, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কোনগুলোকে আমরা যৌন হয়রানি বলব, কোনগুলোকে যৌন হয়রানি বলব না—এ বিষয়গুলো সম্পর্কে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তাঁরা এগুলো সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। এ মুহূর্তে আমাদের গণমাধ্যমগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত। আর আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের কথা বলতে গেলে বলি যে আমাদের ছবিগুলোতে দেখানো হয় ভালোবাসার জন্য অনেক বাধা, সহিংসতা পার হয়ে ভালোবাসা পেতে হয়। এই সহিংসতার বিষয়গুলো চলচ্চিত্রে দেখানো হচ্ছে, এগুলো বন্ধ করা উচিত। আমাদের এ ধরনের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

সুমনা শারমীন
গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। তেমন একজন গণমাধ্যমকর্মী দেশ টিভির বিশেষ প্রতিনিধি ফারজানা রূপাকে অনুরোধ করব তাঁর অভিজ্ঞতা বলার জন্য।

ফারজানা রূপা
আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। আমার বয়সী একজন তরুণী যদি কারওরান বাজার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত গাড়ি ছাড়া ঘুরে এসে তার মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক থাকে, তবে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি মনে করতে পারি, এ সমাজ নারীদের বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠেছে। যে সমাজে নারীরা রাস্তায় নিরাপদে চলতে পারেন না, তিনি যে পোশাকই পরুন, কোনো কিছুই তোয়াক্কা করা হয় না। ফলে সেখানে আমাদের কোনো অধিকার নেই এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলার। আমি নিজে খুবই লজ্জিত, আমি খুবই বিব্রত। আমার একটি সাড়ে তিন বছরের মেয়ে আছে। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন নিজে কারাতে শিখেছিলাম আত্মরক্ষার জন্য। এখন আমার মনে হয়, যখন আমার মেয়ের বয়স ১৩ বছর হবে, তখন কীভাবে তাকে আমি রক্ষা করব। যখন আমার বয়স ৪০ পার হবে, তখন হয় আমাকে দামি গাড়ি কিনতে হবে অসৎ পথে পয়সা উপার্জন করে, নয়তো জীবনে সুখ-আনন্দ বিসর্জন দিয়ে গাড়ি কেনার পেছনে ছুটতে হবে। তা না হলে আমার মেয়ে কাঁদবে, নয়তো আত্মহত্যা করবে। আর মা হিসেবে হয়তো কোনো বখাটের মোটরসাইকেলের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ দিতে হবে।
আমরা হচ্ছি সেই প্রজন্ম, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়া অবস্থায় শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে আন্দোলন করেছিলাম। আমার দুঃখ লাগে, যখন দেখি সেই শিক্ষক আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান কিংবা টক শোতে এসে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। আমরা যাঁরা গণমাধ্যমে টক শোর আয়োজন করি, তারা আমারই বন্ধুবান্ধব কিংবা সহকর্মী, আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানাই, কথা বলার সুযোগ করে দিই।
আমরা আসলে আশাবাদী হতে পারছি না আমাদের সমাজের বর্তমান চিত্র নিয়ে। আমরা যখন শুনি, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আইন করে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যায়নি। তাহলে যতই কঠোর আইন করি না কেন, আমরা কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছি না সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য। আমি আসলে দিনবদলের স্বপ্নে বিশ্বাস করতে চাই। আমি চাই, আসলে সমাজে চিত্রগুলো এমন করে পরিবর্তিত হবে, যেখানে আমার মেয়ে টিনএজ বয়সে কেউ তাকে উত্ত্যক্ত করলে সরকারের প্রতিষ্ঠানের কাছে বিচার চাইলে সে বিচার পাবে।
আমি যখন বড় হতে থাকি, তখন শজারু খুব পছন্দ করতাম। মনে করতাম, আমার গায়ে যদি কাঁটা থাকত, তবে কেউ আমার গায়ে হাত দিলে তার রক্ত ঝরত। তাহলে হয়তো তারা আমার গায়ে হাত দিত না। আমি কী করে আমার পুরুষ সহকর্মী কিংবা আমার স্বামীকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করব, যেখানে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজ নিত্যদিন মেয়েদের নির্যাতন করছে। আমাদের সমাজের নেতিবাচক দিকগুলো সবার কাছে স্পষ্ট। সিমির মায়ের চোখের জল দিয়ে আরেকটি বঙ্গোপসাগর হয়ে যেত। সে পরিণতি যে আমার হবে না, কিংবা আমার মেয়ের হবে না, সে বিষয়গুলোর কে নিশ্চয়তা দেবে। আমাদের সবার একত্র হয়ে নারীদের পথে নামতে হবে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য।

সুমনা শারমীন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি সৈয়দ আশিককে বলার জন্য অনুরোধ করছি।

সৈয়দ আশিক
আজকে আমরা দেখছি, ইভ টিজিংয়ের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেমেয়ে কিংবা তরুণ-তরুণীদের একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি। আজকে আলোচনায় এও দেখছি, পুরুষ ও নারীদের মধ্যে দ্বিধান্বিত অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে। নারীরা নারীদের কথা বলছেন, পুরুষেরা পুরুষের কথা বলছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা একে অন্যের যদি প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যায়, তাহলে ইভ টিজিংসহ অন্য সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব হবে না। আমাদের জাতীয় স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আমার নিজেরও ইভ টিজিংয়ের সংজ্ঞা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা নেই। কোন আচরণ করলে ইভ টিজিং হবে, সেগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে। যদি সমস্যাটি বুঝতে না পারি, তবে কখনো তা সমাধান করা সম্ভব হবে না।
যদি নারী নির্যাতন ইভ টিজিং হয়, আবার প্রেম নিবেদনও ইভ টিজিং হয়, তাহলে এমন একটি সময় আসবে, যখন মেয়েদের সঙ্গে কথা বলাও ইভ টিজিং হবে। যারা এ ধরনের অপরাধ ঘটাচ্ছে, তাদের কাছে আমাদের যেতে হবে। তাদের সমস্যার কারণগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। তরুণ নামধারী বখাটের বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। মেয়ে-বন্ধুদের বিপদে ছেলেদের এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি জেলায় ছেলে ও মেয়েদের পাশাপাশি নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করতে হবে, যেখানে মেয়ে বন্ধুদের সমস্যায় ছেলেরা কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। যারা বহিরাগত, তাদের সন্ত্রাসী ও বখাটে হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
আমি কিছুদিন আগে যখন ভোলার বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন সকালে আমার বন্ধুর মোটরসাইকেলে করে শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে যাব। এ সময় আমার মা আমাকে সতর্ক করে বলেন স্কুল-কলেজের সামনে না দাঁড়ানোর জন্য। কারণ, বর্তমানে স্কুল-কলেজে পুলিশি রেইড চলছে। এভাবে যদি পরিবারগুলো তাদের নিজ সন্তানদের সচেতন করে, তাহলে এই অস্থিরতা দূর হবে।

মেহতাব খানম
আমরা প্রথম আলোর কাছে একটি প্রস্তাব রেখেছিলাম, বিভাগীয় পর্যায়ে গিয়ে অভিভাবকদের নিয়ে পজিটিভ প্যারেন্টিং (অভিভাবকত্ব) বিষয়ে আলোচনার আয়োজন করার জন্য। আমরা এ প্রক্রিয়াটি শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা এখনো করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই আসলে পজিটিভ প্যারেন্টিং কিংবা পজিটিভ ডিসিপ্লিন সম্পর্কে জানে না। আমাদের বিষয়গুলো সম্পর্কে জনগণকে আরও সচেতন করতে হবে। আসলে প্রচার বা গণমাধ্যমের সহযোগিতা ছাড়া এ শব্দগুলো জনগণের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। আমাদের এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সমস্যার মূলে গিয়ে প্রতিরোধমূলক কাজ করতে হবে। প্রতিকারের মাধ্যমে হয়তো কিছু সময়ের জন্য আমরা অপরাধগুলো বন্ধ করতে পারি। কিন্তু স্থায়ীভাবে কোনো সমাধান করতে চাইলে অবশ্যই প্রতিকারমূলক কাজের চেয়ে প্রতিরোধমূলক কাজের ওপর বেশি জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশে যখন কোনো ঘটনা ঘটে, তখন আমরা সবাই হুজুগে মেতে থাকি। আমরা বাঙালিরা অসম্ভব আবেগপ্রবণ। আবেগের তোড়ে ভেসে যাই এবং বিষয়গুলো নিয়ে বেশ জোর গলায় কথা বলি। কিছুদিন পর ব্যাপারগুলো থেমে যায়। আমাদের একটি শিশু যখন পরিবারে বড় হয়, তখন প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে তার চরিত্রের মূল ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। তারপর সে বিদ্যালয় কিংবা কলেজে যাচ্ছে। তাই পরিবারে থাকা অবস্থায়ই শিশুদের নৈতিক, সামাজিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া দরকার। আমাদের ঘরের মধ্যে রোল মডেল তৈরি করতে হবে। আমার বাবা আমার মাকে শ্রদ্ধা করছেন কি না, আমার ভাই আমার বোনকে শ্রদ্ধা করছে কি না; এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। এ জায়গাগুলোয় যদি আমরা কাজ করতে না পারি, তাহলে মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কিংবা মূল্যায়নের এ জায়গাগুলো আমাদের ভেতর সৃষ্টি হবে না।
অনেক কারণ একত্র হয়ে আজকে সমাজে এ সমস্যাগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। আমি যখন মেয়েদের কান্না শুনি, তারা বলে, তাদের ভিডিওচিত্র তুলে বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের বিয়ে হচ্ছে না—এসব দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। আমরা নেগেটিভ প্যারেন্টিং করছি। আমাদের অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছেন। আমি মনে করি, আমাদের মা-বাবাকে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের সমস্যা নিয়ে তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। আমাদের বংশপরম্পরায় এই যে কুশিক্ষা ও কুসংস্কার, তা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকদের একত্র করে পজিটিভ প্যারেন্টিংয়ের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার আয়োজন করা দরকার।
আমাকে প্রতিবছর ডিফেন্স স্টাফ কলেজে পজিটিভ প্যারেন্টিংয়ের ব্যাপারে কিছু বলার জন্য নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে দেখি, শুধু মায়েরা উপস্থিত থাকেন। বাবারা আসেন না। আমি বারবার বলেছি, আমাদের বাবাদের এসব জায়গায় আনতে হবে। কারণ, পরিবারে মায়েদের চেয়ে বাবাদেরই ক্ষমতা বেশি থাকে। তাই পজিটিভ প্যারেন্টিং প্রোগ্রামে মায়েদের পাশাপাশি বাবাদের থাকাটাও জরুরি।
মেয়েরা জন্মের পর থেকেই জানে, বিয়ের পর তাকে স্বামীর বাড়িতে যেতে হবে। এই যে সে ছোটবেলা থেকে জানে, তার আসলে নিজস্ব কিছু নেই। তাকে কে সম্মান করবে? এ মানসিকতার পরিবর্তন আনা উচিত। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মেয়েদের এসব সমস্যা সমাধানের জন্য হেল্পলাইন চালু করতে হবে। কারণ, অনেক মেয়ে এ ধরনের ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে মুখ বুজে সহ্য করছে। তারা তাদের পরিবারের কাছে বলতে পারছে না। কারণ, পরিবার বরং তাকেই বেশি দোষারোপ করে। ‘কেন অন্য মেয়েদের এ ধরনের সমস্যা হয় না, তোমার বেলায় কেন হবে?’ এ ধরনের প্রশ্ন করে মেয়েদের আরও মানসিক চাপ প্রয়োগ করছে পরিবারগুলো।
আরেকটি বিষয় মেয়েদের বাল্যবিবাহ। বরিশালে মেয়েদের গড় বিয়ের বয়স ১৩। এতে অল্প বয়সে তাঁরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের স্বামীরা আবার দ্বিতীয় বিয়ে করছেন। এভাবে নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আমাদের সমাজে নারীরা কী অবস্থায় আছেন, তা জানা দরকার। এই যে একটি কারণে আরেক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, এগুলো নিয়ে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আর মেয়েদের অভিযোগ থাকলেও সেগুলো প্রমাণ করার কোনো প্রক্রিয়াও আমাদের জানা নেই। আমাদের শূন্য টলারেন্সে যেতে হবে। উন্নত বিশ্বগুলো শেষ পর্যন্ত শূন্য টলারেন্সে গেছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না রেখে সর্বনিম্ন ১০ বছর শাস্তির বিধান করেছে। আর অর্থদণ্ড তুলে দিতে হবে। কারণ, এ দিয়ে আসলে কিছু হয় না। কারণ, আমার ছেলেকে যে-ই ধরে নিয়ে যাক, তখন আমি যত টাকাই লাগুক, তা দিয়ে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসব। গণমাধ্যমের বিষয়ে আমি বলতে চাই, আমরা মেয়েদের ব্যাপারে যে কথাগুলো লিখছি, সেখানেও পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন—প্রথম আলোতে লেখা হয়েছে, আরও অনেক মেয়েকে হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে। এটি এভাবে না লিখে লিখতে হবে, আত্মহত্যায় মেয়েদের বাধ্য করা হচ্ছে। আমাদের আবেগ থেকে বের হয়ে এসে কঠিনভাবে বলতে হবে। আমাদের সেই ছেলেদের পরিবারে যেতে হবে, যারা অপরাধ করছে। আমরা শুধু নির্যাতিত পরিবারগুলোর কথা তুলে ধরছি। আমাদের উচিত, ওই সব উত্ত্যক্তকারী পরিবারকে তুলে আনা এবং তাদের মা-বাবাকে প্রশ্ন করা, কেন তাঁদের সন্তান এ ধরনের অপরাধ করছে। আমাদের সামাজিকভাবে এসব পরিবারকে চাপ দিতে হবে, তাদের বয়কট করতে হবে। এতে এসব অপরাধকারী কিছুটা হলেও সতর্ক হবে। আমাদের অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে নিজ সন্তানের অপকর্মের জন্য। আমাদের গণমাধ্যমে প্রচারিত নাটক ও সিনেমাগুলো সেন্সরিংয়ের পর প্রচার করা উচিত, সামাজিক মূল্যবোধ মাথায় রেখে।

আয়েশা খানম
আমাদের সামাজিক আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে। আমাদের যার যার ক্ষেত্র থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে এ সমস্যাটি সমাধানের জন্য। আমাদের সবার সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আমাদের আজকের আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আমরা সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ভেতর আধুনিক সবকিছু নিয়ে এসেছি। এতে আমাদের অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষাব্যবস্থা—সবকিছুর মধ্যেই আধুনিকতা প্রবেশ করেছে। আমাদের তরুণদের মধ্যে সৃজনশীলতা নেই, তারা ধ্বংস হয়ে গেছে—এসব বললে আমাদের আরেকটা ভুল হবে। বর্তমানে আমাদের সৃজনশীল ও অঙ্গীকারবদ্ধ তরুণ সমাজ তৈরি হচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের মূল্যবোধের প্রশ্নে আধুনিক মূল্যবোধকে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। যুবসমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয়গুলোকে আরও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে আধুনিক মূল্যবোধে যুবসমাজকে গড়ে তোলার জন্য।

নুরুল ইসলাম নাহিদ
আজকের আলোচনার মাধ্যমে অনেক বিষয় উঠে এসেছে, যেগুলো আমাদের ভবিষ্যতের কার্যপদ্ধতি নির্ধারণে অনেক সহযোগিতা করবে। সমস্যার কারণ এবং তা সমাধানের প্রক্রিয়াগুলো উঠে এসেছে আলোচনার মাধ্যমে। ছাত্রীদের ওপর আক্রমণাত্মক বখাটের এই যে কার্যক্রম, সেখানে আমি নিজেকেও একজন ভুক্তভোগী মনে করি। পাশাপাশি আমি নিজেকে শিক্ষা পরিবারের একজন সদস্য বা কর্মী মনে করি। আর এই উত্ত্যক্তকরণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। এক বছর ধরে আমরা মাঠে নেমেছি সামাজিক আন্দোলন ও সচেতনতা সৃষ্টি করতে, যাতে আমাদের ছাত্রীরা নির্ভয়ে স্কুলে আসতে পারে। এ আন্দোলনে সমাজের সব সংগঠন ও ব্যক্তি যত যুক্ত হবে, তত এর প্রসার ঘটবে এবং এ সমস্যা সমাধানে আমরা অগ্রসর হতে পারব। আমাদের ঢাকার স্কুলগুলোর নিজস্ব কোনো মাঠ নেই। স্কুল থেকে বের হলেই রাস্তায় পা দিতে হয়। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও নাচ-গানের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব ছেলে কী করবে! তাই আমরা দুই বছর ধরে আন্তস্কুল প্রতিযোগিতা শুরু করেছি। যেটি স্কুলপর্যায়ে হয়ে হয়ে জাতীয় পর্যায়ে আসবে, একটি শীতকালীন, অন্যটি গ্রীষ্মকালীন। আমরা স্কুলগুলোয় জাতীয় দিবসগুলোতে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন বাধ্যতামূলক করছি। এর মাধ্যমে অনেক সৃজনশীল তরুণ বের হয়ে আসছে। তরুণদের মধ্যে সামান্য একটি অংশ বিপথগামী হয়েছে, যারা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আমাদের সামগ্রিক সমাজের যে অধঃপতন ঘটেছে, তারই একটি প্রকাশ এটি।
যেসব পরিবারে মেয়েরা আত্মহত্যা করছে, বেশির ভাগ জায়গায় আমি গেছি। সেখানে আমার উপলব্ধি হয়েছে, বেশির ভাগ পরিবারের এ বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞতা রয়ে গেছে। আমাদের বর্তমানে ৯২ শতাংশ বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে, যার অধিকাংশই ওই পরিবারে প্রথম প্রজন্ম, যারা স্কুলে যাচ্ছে। সুতরাং তাদের অভিভাবকদের অশিক্ষা ও কুসংস্কার থেকেই যাচ্ছে। তা ছাড়া আমরা যারা শিক্ষিত, তারাও বুঝি না, আসলে কীভাবে আমাদের বাচ্চাদের পরিচালনা করব। যখন কোনো মেয়ে আক্রমণের শিকার হয়, তখন সে শিক্ষক কিংবা মা-বাবাকে বলতে পারে না। আর যখন মা-বাবাকে বলে, তখন তাঁরা বলেন, ‘আর কাউকে করে না, তোমাকে কেন করে?’ তখন সে দেখে, তার আর কোনো আশ্রয় নেই। তখন তারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে।
আমাদের পরিবারগুলোকে প্রস্তুত করতে হবে, যাতে তারা তাদের বংশধরদের সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে দীর্ঘ সময়ের জন্য। পরিবার, স্কুল ও সমাজকে একত্র হয়ে সামাজিকভাবে মেয়েদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এ বিষয়ে আমাদের কারও সঙ্গে কোনো আপস নেই। আমরা ঢাকা শহরে স্কুলগুলো থেকে ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি মিছিলের আয়োজন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু স্কুলগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ৭২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। অর্থাৎ তারা এ বিষয়ে কতটা উদ্যোগী ও আগ্রহী। আমরা সব কটি জেলায় এবং বেশ কয়েকটি উপজেলায়ও এ ধরনের আয়োজন করেছিলাম। আমাদের অবশ্যই আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনের যেসব ঘাটতি আছে, সেগুলো পূরণের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও মন্ত্রণালয়গুলো উদ্যোগ নিয়েছে। এ সমস্যাটি স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ করার জন্য সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর আইন তৈরি করা হবে।
কিন্তু বিষয়গুলো এতই দ্রুত ঘটে যাচ্ছে যে আমাদের আজকেই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যেমন—ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু করা হয়েছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমরা এটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা সামাজিক আন্দোলন, সামাজিক সচেতনতা, সামাজিক প্রতিরোধ—এ বিষয়গুলোর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। এ কাজটি করার জন্য সমাজের সব মহলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। আমাদের আধুনিক পাঠ্যক্রম দরকার শিক্ষাব্যবস্থায়।
আমরা পাঠ্যক্রমে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করব, যেখানে ছেলেমেয়েরা ক্লাসরুমে বসেই সেই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। যেখানে একজন ছেলে ও মেয়ের মধ্যে যে সুস্থ সম্পর্ক হওয়া উচিত, তা তারা শিখতে পারবে। মেয়েদের প্রতি ছেলেদের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে। আমরা যেন একজন মেয়েকে সমান ভাবতে পারি। তাকে সহপাঠী ও বন্ধু হিসেবে ভাবতে পারি। তার প্রতি যেন আমি সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখাতে পারি—এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ছেলেমেয়েদের মধ্যে তৈরি করতে হবে। আমাদের ছেলেরা যাতে বিপথে না যায়, সে জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। আমাদের স্কুলগুলোয় মনোরোগ চিকিৎসক ও পরামর্শক দেওয়া প্রয়োজন। হয়তো আমরা এখনই তা করতে পারব না, তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের প্রতিটি স্কুলে একজন বিশ্বাসযোগ্য শিক্ষক বাছাই করছি, যাঁর কাছে শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যার কথা বলতে পারবে। আমরা চাই শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তিবিদ্যায় শিক্ষিত করে নৈতিক মূল্যবোধে জাগ্রত করতে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ একটি তরুণ প্রজন্ম তৈরি করতে পারলে দেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে এগিয়ে যাবে।

আব্দুল কাইয়ুম
গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা ও সুপারিশগুলো বখাটে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে সাহায্য করবে। আজকের আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

No comments

Powered by Blogger.