অরণ্যে রোদন-মেঘলোক থেকে জানাই ঈদের শুভেচ্ছা by আনিসুল হক

কাল ঈদ। বহু দূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে কল্পনা করার চেষ্টা করছি আজকের দিনটায় বাংলাদেশের অবস্থা। কোরবানির পশুর হাট বসেছে, লোকজন হাট থেকে ফিরছে, কারও হাতে গরুর দড়ি, একটা গরু সামলাতে গোটা চারেক লোক দরকার হচ্ছে। কারও হাতে ছাগল, ছাগলের সামনে ছোট্ট শিশুটি কাঁঠালের পাতা ধরছে। রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ।


এই গরু-ছাগল কেনা নিয়ে কত কথা—কোন হাটে এবার কী রকম দাম, সকালে দাম বেশি তো বিকেলে কম, সকালে আমদানি কম তো বিকেলে বেশি, এই হাটে যখন দাম বেশি যাচ্ছে, ওই হাটে তখন দাম খুব পড়ে গিয়েছিল—এসব গল্পে বাতাস গম গম করছে।
এরই মধ্যে অনেকেই নিজের আদি বাড়িতে ফিরে গেছে, অনেকেই বাড়ির পথে। কী যে কষ্ট সেই বাড়ি ফেরার পথটা পেরোনো, কী যে ধকল, টিকিট পাওয়া যায় না, পাওয়া গেলেও রেলস্টেশনে, বাস টার্মিনালে, স্টিমার ঘাটে ভিড়ের ঠেলায় চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়, বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেল বাস নেই, মহাসড়কে যানজট, আট ঘণ্টার পথ ১৬ ঘণ্টায় পেরোনো যাবে কি না সন্দেহ। লঞ্চের ছাদে, ট্রেনের ছাদে যে যেভাবে পারছে ছুটে যাচ্ছে। কত কষ্টই না স্বীকার করে নিচ্ছে তারা। কেন? না, বাবা, মা, ভাইবোন—সবাই মিলে একসঙ্গে ঈদ করবে। আহা, আমার বাংলাদেশ। আমার চোখ ভিজে আসে। ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ!
আমি এই লেখাটা লিখছি ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ট্রেনে চেপে নিউইয়র্ক যাওয়ার পথে, ট্রেনে বসে। বাইরে হেমন্তের আগুন লেগেছে গাছে গাছে, পাতায় পাতায়, তাতে কত রং, কিন্তু কে তাকাবে তার দিকে। আমার মনে বরং বাংলাদেশের দেশি ফ্যাশন হাউসগুলোর ঈদ ফ্যাশনের রং, কী রংদার পোশাক-আশাকই না আমরা বাংলাদেশিরা পরে থাকি। একেকটা ঈদে আবার একেকটা রঙের ফ্যাশন আসে। কাপড়ের দোকানে ভিড়, মসলার দোকানে ভিড়, কামাররা ব্যস্ত ছুরি-দা ধার করা নিয়ে। আমার পরিচালক বন্ধুরা উত্তেজিত কিংবা চিন্তিত তাদের ঈদের টেলিভিশন নাটক বা চলচ্চিত্রটা ‘কেমন যাবে’ তাই নিয়ে। খবরের কাগজগুলো এই ঈদেও ঈদসংখ্যা বের করছে, অন্তত আমার কাগজটা তো করেছেই। বিজ্ঞাপনদাতারা ব্যস্ত টেলিভিশনের ঈদের অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপন প্রচারের সময়সূচি নিয়ে। টেলিভিশনের কর্তারা ব্যস্ত টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দিয়ে দর্শকদের মন আর বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের পকেট ভরার কাজে। শিল্পীরা তাঁদের ঈদের অ্যালবাম বাজারে ছেড়ে শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করছেন। পুলিশ প্রশাসন ব্যস্ত কোরবানির হাটে চাঁদাবাজি বন্ধ করার কাজে।
ঘরে ঘরে গৃহিণীরা ব্যস্ত মসলা নিয়ে, পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে তাঁরা চোখের জল ফেলছেন। তরুণীরা হাতে মেহেদির আলপনা এঁকে হাতটা আলগা করে ধরে রেখেছে।
এমনকি আমার রংপুরের বা কুড়িগ্রামের মফিজেরাও বাসের ছাদে চড়ে নিজের মানুষটার কাছে ফিরছেন। তাঁর মানুষিটা যে বাড়ির দাওয়ায় পথ চেয়ে আছে, ‘কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে!’ বা ‘ও কি আরেকবার আসিয়া সোনার চান মোক যান রে দেখিয়া।’ কুড়িগ্রামের চরের ছেলেমেয়েরাও হয়তো বছরে একটা দিন মাংস খাবে। ওই যে ছেলেমেয়েদের আমি দেখে এসেছিলাম কয়েক বছর আগে উজিরপুর যাত্রাপুরের গহিন চরে, ধরলা নদীর ওপারে, তিস্তার বুকে, যারা কাশবন থেকে কাশ তুলে নিয়ে তার গোড়া চিবুচ্ছিল।
আমার সোনার বাংলার প্রতিটা ঘরেই ঈদ আসে। এমনকি আমাদের অমুসলিম বন্ধু প্রতিবেশীদেরও ঘরে। ঈদের নাটক তাঁরাও দেখেন, বন্ধুদের বাড়িতে তাঁরাও নেমন্তন্ন খান। আমাদের ঈদের এমন একটা সাংস্কৃতিক অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আছে। এই রকম করে ঈদ নিশ্চয়ই পৃথিবীর আর কোথাও আসে না। একেকটা দেশে ঈদ পালিত হয় একেক রকম ভাবে। বাঙালিরা ঈদুল ফিতরে সেমাই খায়। আফ্রিকার মরিশাসের লেখক বন্ধু ফরহাদ খয়রাতির কাছ থেকে জানতে পারলাম, তাঁদের ওখানেও ওই ঈদে সেমাই, হালুয়া ইত্যাদি রান্না করা হয়।
এই আমেরিকায় বাঙালিরা ঈদ পালন করেন বাঙালিদের মতো করেই। সত্যি কথা কি, যেখানে বাঙালি বসতি কম, সেখানে টের পাওয়ার উপায়ই নেই যে আজ ঈদ। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সব খোলা। সবাই যার যার কাজে যেতে বাধ্য। এবার ঈদুল ফিতরে আমি ছিলাম আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, সন্ধ্যার পর এখানকার হাতেগোনা গোটা তিনেক বাঙালি পরিবারের একটির কর্ত্রী, সংগীতশিল্পী মেঘনা আমিনের গাড়ি করে গেলাম পাশের শহরে এক বাঙালির বাড়িতে। ওইখানে আরও কয়েকটা পরিবার যোগ দিল। বিরিয়ানি ইত্যাদি খাওয়া হলো। পরের দিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল বলে, একটা কমিউনিটি সেন্টারে বাঙালিরা একটা প্রীতি সম্মিলনীর আয়োজন করলেন। সেখানে হাজির হলাম প্রায় ১০০ মাইল পথ অতিক্রম করে। শ খানেক বাঙালি পরিবার মিলে গান-বাজনা, কুইজ প্রতিযোগিতা করে আনন্দেই কাটালেন সময়টা। সবাই কিছু কিছু খাবার বানিয়ে এনেছিলেন। খাওয়াটাও মন্দ হলো না।
আমেরিকায় ক্রিসমাস পালিত হয় মহা-আড়ম্বরে। পশ্চিমবঙ্গে যেমন পালিত হয় দুর্গাপূজা। এবার দুর্গাপূজার সময় আইওয়াতে পরিচয় হয়েছিল কলকাতা থেকে আসা এক শিক্ষার্থিনীর সঙ্গে। সম্প্রতি তিনি এসেছেন এই পরবাসে, এটাই তাঁর জীবনের প্রথম দেশের বাইরে আসা। পূজার দিনগুলোতে এখানে কিছুই হচ্ছে না, কয়েক দিন পরে একটা ছুটির দিনে ১০০ মাইল দূরে একটা পূজার আয়োজন হবে, সেটার আশায় তিনি বসে আছেন। মেঘনা আমিনের একটা প্রতিষ্ঠান আছে দেশে এবং আইওয়ায়, সর্বশ্রী ফাউন্ডেশন, তিনি সাধনা করেন কার্নাটিক সংগীতের, তারই একটা অনুষ্ঠান ছিল এইখানে, আমাকে তিনি বললেন সেই অনুষ্ঠানে কিছু বলার জন্য। আমি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান থেকে উদ্ধৃতি দিলাম, বললাম, ‘আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়, মেশে তেরো নদী সাত সাগরের জল গঙ্গায় পদ্মায়..।’ বাংলাদেশি একজন সাধিকা আমেরিকার শহরে আয়োজন করেছেন দক্ষিণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর, যার শ্রোতা আমেরিকানরা! আমার মুখে বাংলা শুনে ওই তরুণী এগিয়ে এসেছিলেন, ইস্, এইখানে আমেরিকায় বাংলা শুনে কী যে ভালো লাগল। আমি ওই কলকাতার মেয়েটিকে দেখেছি পূজার দিন কটায় খুব তাঁর দেশকে মিস করছিলেন। মানে বলতে চাচ্ছি, একেকটা দেশে বড় উৎসব একেকটা, আর তা পালন করার দেশি রেওয়াজটাও ভিন্ন রকমের। যেমন ইরানের লেখিকা ফারাঙ্গিস জানালেন, তাঁদের ওখানে কোরবানির ঈদে সবাই পশু কোরবানি দেয় না, কেউ কেউ দেয়, এটা তাঁদের প্রধান উৎসব নয়, তাঁদের প্রধান উৎসব নববর্ষ।
বাঙালির ঈদ বাঙালির মতো। অবশ্যই ঈদের একটা সর্বমুসলিম অভিন্নতা আছে, কিন্তু দেশভিত্তিক, জাতিভিত্তিক ভিন্নতাও আছে। শ্রেণীভিত্তিক তো আছেই, গরিবের ঈদ আর বড়লোকের ঈদ, গার্মেন্টস মালিকের ঈদ আর গার্মেন্টসকর্মীর ঈদ এক রকম হয় না।
আমার ভালো লাগে বাংলাদেশের মানুষদের ঈদ উপলক্ষে বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাড়াটা।
ঢাকা কি এরই মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেছে?
আমি বাংলাদেশের ঈদের অনুপস্থিতি আমার ভেতরে অনুভব করছি, নাকি ঈদের দিনটায় বাংলাদেশে থাকতে না পারাটাকে অনুভব করছি?
তবে এই ট্রেন পৌঁছে যাবে নিউইয়র্কে। ওখানে বাংলাদেশি প্রচুর। ওখানে আমার ঈদের দিনটা নিশ্চয়ই খানিকটা বাংলাদেশের মতোই লাগবে।
এখানে স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত খোলা বলে বাংলাদেশিরা হয়তো ছুটি নিয়েই দিনটা উদ্যাপন করবেন। নয়তো কাজে যাবেন। ফিরে এসে মাংস খেয়ে টেলিভিশনে বাংলাদেশি চ্যানেল দেখতে বসবেন। দেশের খবর শুনবেন। বিএনপি আর আওয়ামী লীগের চিরকালের ঝগড়ার কথা শুনে মন খারাপ করবেন।
এবার ঈদের আগেই একটা হরতাল হয়েছে। মানুষের নিশ্চয়ই কষ্ট হয়েছে তাতে। আবার হরতালের দিন কি ফিরে এল? হরতালটা পরিহার করা যায় না? দেশটাকে যে আমরা এগিয়ে নিতে চাই।
ঈদ আমাদের শিক্ষা দেয় নিজের লোভ-লালসা বিসর্জন দেওয়ার। নিজের ভেতরের পশুত্বটাকে কোরবানি করার। আমরা কি নিজেদের মধ্যে কলহ করার কুপ্রবৃত্তিটাকে বিসর্জন দিতে পারি? আমরা কি হরতাল পরিহার করার পরিবেশ তৈরি করতে পারি?
ঈদের আগের দিনের লেখায় এসব প্রসঙ্গ আনতেই চাইনি। কিন্তু ঘরমুখো মানুষের কষ্টটা একটা ‘আজাড়ে’ হরতালের কারণে কী পরিমাণ বেড়ে গেছে, ভেবে মন খারাপ করছি আর এই প্রসঙ্গ পাড়তে বাধ্য হচ্ছি। কবে আমরা মানুষ হব? কবে আমাদের রাজনীতি থেকে হানাহানি দূর হবে?
আগামীকাল বাংলাদেশে যখন যথাযোগ্য মর্যাদায় ঈদ পালিত হতে থাকবে, আমি তখন থাকব আকাশে, মেঘের ওপরে। নিউইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্টে নিশ্চয়ই ঈদের আমেজ টের পাব না, কিন্তু আমার বিমান যাবে আবুধাবি, সেখানে কি ঈদের উষ্ণতা খানিকটা টের পাব?
জানি না পাব কি না। কিন্তু আমি যা মিস করব তা হলো, ঈদের দিন প্রিয়জনের সঙ্গে থাকা, আর ঈদের উৎসবের আলোয় ঝকমক করতে থাকা বাংলাদেশটাকে। পোশাকে-আশাকে, নাটকে-সংগীতে, খাওয়ায়-দাওয়ায়, প্রিয়জনের কাছে ছুটে যাওয়ায়, ঈদসংখ্যায়, ঈদফ্যাশনে, ঈদের গৃহসজ্জায়, ত্যাগে-তিতিক্ষায়, দানে-উৎসর্গে, আধ্যাত্মিক আবেগ অনুভূতিতে মেশানো এমন ঈদ আমার বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথায় পাব?
আকাশের ঠিকানা থেকেই সবাইকে জানাই ঈদ মোবারক।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.