বিশেষ সাক্ষাৎকার-ট্রাইব্যুনালকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে by আহমেদ জিয়াউদ্দিন

ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন বাংলাদেশ ও বেলজিয়ামে অধ্যয়ন করেছেন আইন, আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন এবং রাজনীতি ও উন্নয়ন বিষয়ে। বেলজিয়ামে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ নামের প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণহত্যা-বিশারদ সংস্থার সদস্য।


আন্তর্জাতিক আইন ও বিচার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন আফগানিস্তান, নেপাল, পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওসসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এশিয়া নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক। সেই সূত্রে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন আইসিসির রোম ঘোষণা প্রণয়ন এবং তাতে বাংলাদেশের স্বাক্ষর দান কার্যক্রমে। সম্প্রতি তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের উদ্যোগ বিষয়ে কাজ করতে বাংলাদেশ সফর করেন।
 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ

প্রথম আলো  যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত এর অগ্রগতিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আহমেদ জিয়াউদ্দিন  দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে এবং তারা কাজও শুরু করে দিয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ছিল, যাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট বা মোটামুটি প্রমাণ আছে, তাদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে, অর্থাৎ তারা বিচারাধীন আছে। যদিও মূল বিচার এখনো শুরু হয়নি, তার পরও তদন্তকারী দল বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে, তথ্যপ্রমাণও পাচ্ছে। একাত্তরের অপরাধের বিচারহীনতার যে পরিবেশ ছিল, সেটা বদলাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার এখন একটি বাস্তবতা, একে অস্বীকার করার উপায় নেই।
প্রথম আলো  জামায়াতে ইসলামীর তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে তাদের নেতাদের বিচারের উদ্দেশ্যে। এ আইনের কোনো রাজনৈতিক অভিপ্রায় আছে বলে মনে করেন কি?
আহমেদ জিয়াউদ্দিন  আইনের ভেতর কিন্তু জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কারও নামধাম নেই। কার্যত ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি পূর্ণাঙ্গ আইন। এর ভেতর অপরাধের বৃত্তান্ত আছে, সংজ্ঞা এবং বিচারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা আছে। কীভাবে অপরাধ প্রমাণ হবে, ট্রাইব্যুনাল কীভাবে গঠিত হবে, সেটা নির্দেশ করা আছে। তারা কীভাবে কাজ করবে, কীভাবে আপিল হবে—সব বলা আছে। কাজেই বাংলাদেশের আইনের কাঠামোর মধ্যে এটি ছোট কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন। এটা কোনো রাজনৈতিক দলকে লক্ষ্য করে করা হয়নি। এ আইনের লক্ষ্য তারাই, যারা একাত্তরের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।
প্রথম আলো  এখন বিচার তো করা হচ্ছে কেবল দেশীয় অপরাধীদের। তাহলে একে কেন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বলা হচ্ছে?
আহমেদ জিয়াউদ্দিন  যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ বিশ্বের যেখানেই ঘটুক না কেন, সারা বিশ্ব এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে যায়। এ ধরনের অপরাধ কঙ্গো, রুয়ান্ডা বা ইরাকে হোক, দৃশ্যত তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এ অপরাধগুলো মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ। এ অপরাধগুলো হচ্ছে মানুষের সেই মৌলিক ধারণার বিরুদ্ধে আক্রমণ। আপনি একটা জনগোষ্ঠী বা জাতিকে হত্যা করছেন, তাদের বিশ্বাসের জন্য মারছেন, ধরে নেওয়া হচ্ছে, এ ধরনের অপরাধ সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধেই করা হচ্ছে। সে কারণেই এটা আন্তর্জাতিক অপরাধ।
প্রথম আলো  বাংলাদেশের আইনজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান ট্রাইব্যুনালে সংগঠিত অপরাধীদের বিচারের সুযোগ থাকলেও দলবহির্ভূত ব্যক্তিদের বিচার করায় সমস্যা হবে। সে জন্য তাঁরা আইনের সংস্কার করায় একটা সংশোধনী আনার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার তা রাখেনি। এতে আইনে ত্রুটি রয়ে গেল কি না?
আহমেদ জিয়াউদ্দিন  আইনে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে সহযোগী বাহিনীগুলোর কথা বলা হয়েছে। তা হলেও সেসব বাহিনীর বাইরের অপরাধীরাও এ আইনের আওতায় পড়বে। আমরা তো এখানে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে আলোচনা করতে পারব না। আইনের সংশোধনের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালকে বিচারিক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। এখন ট্রাইব্যুনালই সিদ্ধান্ত নেবেন, তাঁরা কী ধরনের তদন্ত করবেন, কাকে কাকে অভিযুক্ত করবেন এবং কীভাবে বিচার করবেন। আইনের বিধিগুলোও নিয়মিতভাবে সংশোধন করার অধিকার তাঁদের আছে। আমাদের সবার দায়িত্ব হলো একে সহযোগিতা করা, যাতে ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব তাঁরা স্বাধীনভাবেই পালন করতে পারেন।
প্রথম আলো  তিয়াত্তরের সাধারণ ক্ষমার বিষয়েও প্রশ্ন আছে। সংবিধান অনুসারে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ আইনের দিক থেকে বিচার নিঃশেষ হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি কাউকে ক্ষমা করতে পারেন না।
আহমেদ জিয়াউদ্দিন  শুধু চূড়ান্তভাবে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার একটা ক্ষমতা সংবিধানে দেওয়া আছে। পৃথিবীর সব দেশের সংবিধানেই রাষ্ট্রপ্রধানকে এ ক্ষমতা দেওয়া আছে। এটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তিয়াত্তরের সাধারণ ক্ষমা বিষয়ে একটা জিনিস ভুলে যাওয়া হয় যে, এটা ‘শর্তযুক্ত সাধারণ ক্ষমা’। এটাকে পুরো সাধারণ ক্ষমা বলা যায় না। সেখানে বলা হয়েছে, কোন কোন পরিপ্রেক্ষিতে এবং কী ধরনের লোকের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে না। চিন্তার দিক থেকে এটাকে সাধারণ ক্ষমা বলা ঠিক নয়।
প্রথম আলো  বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সেটা কি সাধারণ ক্ষমা থেকেই চালু হয়ে গেল?
আহমেদ জিয়াউদ্দিন  সেটা বলা যেতে পারে। তবে সরকার কিন্তু সেভাবেও সিদ্ধান্ত নেয়নি যে, বিচার একেবারেই করব না। সাধারণ ক্ষমার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, এরা দেশের উন্নয়নে অংশ নেবে এবং সেই বিবেচনায়ই সরকার তাদের ক্ষমা করেছে।
কিন্তু পরে দেখা গেল, যাদের আসলে ওসব শর্তের ভেতর আটকে থাকার কথা, তারা আটকে থাকল না। যে আইনে তাদের বিচার করা হচ্ছিল পঁচাত্তরের ডিসেম্বরে সেই আইনটা বাতিল হওয়ায় বিচারের ভিত্তিটাই সরে গেল। ফলে আইন না থাকার কারণে, তাদের তখন ক্ষমাপ্রাপ্তও বলা যাবে না, আবার সাজাপ্রাপ্তও বলা যাবে না। আজকের যে ট্রাইব্যুনাল তারা যদি মনে করে, সে ধরনের কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে"তদন্ত করবে তাহলে আমার মনে হয় কোনো অসুবিধা নেই।
প্রথম আলো  তার মানে তাদের আবার নতুন করে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব?
আহমেদ জিয়াউদ্দিন আপনাকে দেখতে হবে, রাষ্ট্রপতি তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতার বলে ক্ষমা করেননি, এটা হয়েছিল একটা নির্বাহী আদেশের বলে। সাজাপ্রাপ্ত কেউ ক্ষমা পেলে আইন ধরে নেবে, ক্ষমার পর ওই ব্যক্তি এখন সম্পূর্ণ নির্দোষ। তাকে আবার নতুন করে বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না। কিন্তু যাদের বিচার শেষ হয়নি, নির্বাহী আদেশের বলে যাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের আবার বিচারের মধ্যে আনায় কোনো সমস্যা নেই। আসলে চিন্তার দিক থেকে এটাকে সাধারণ ক্ষমা বলা ঠিক নয়। তখন আসলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সবার বিচার আমরা করব না। যাদের বিরুদ্ধে হত্যা-খুন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আছে, তাদের আমরা বিচার করব। এটাই এর সত্যিকার আইনগত ফল। এখন যে মুহূর্তে সরকার সিদ্ধান্ত নিল, আমি এদের বিচার করব না, সেই মুহূর্তে তারা কিন্তু মুক্ত হয়ে গেল, তাদের সামনে আর কোনো বাধা রইল না। আসলে সরকার ক্ষমা করেনি, বিচার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এখন পরের সরকার কিন্তু ঠিক করতে পারে, আগের সরকার যা করুক না কেন, আমরা বিচার করব। কাজেই যদি আইসিটি মনে করে, তারা সবার বিচার করবে, তাহলে আইনগতভাবে কিন্তু কোনো বাধা নেই। কারণ, কেউই রাষ্ট্রপতির সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ক্ষমা পায়নি।
প্রথম আলো একাত্তরে গণহত্যাসহ ব্যাপকভিত্তিক অনেক অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে কেবল যুদ্ধাপরাধ কীভাবে বড় হয়ে উঠল?
আহমেদ জিয়াউদ্দিন  এখানে ধারণাগতভাবে কিছু জিনিস আগে পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। আইনে লেখা আছে জেনোসাইড। আর গণহত্যার ইংরেজি করলে দাঁড়ায় মাস কিলিং। তিয়াত্তরের আইনে যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, সেখানে কিন্তু মাস কিলিংয়ের কথা বলা নেই। তখন আন্তর্জাতিক জেনোসাইড কনভেনশন থেকে জেনোসাইডের সংজ্ঞাটা উঠিয়ে আনা হয়েছিল এবং এর সঙ্গে রাজনৈতিক দলকে গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত করে ছোট্ট একটি সংযোজন করা হয়েছিল। সুনির্দিষ্ট একটা জনগোষ্ঠী বা গ্রুপকে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে শেষ করে ফেলার উদ্দেশ্যে থাকলেই সেটা জেনোসাইড। এ ছাড়া এমন এমন কিছু করা, যাতে ওই জনগোষ্ঠী বা গ্রুপের জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে, তাও জেনোসাইডের আওতায় পড়বে। এখানে কিন্তু কোথাও হত্যার কথা লেখা নেই, যেটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বা যুদ্ধাপরাদের বেলায় লেখা থাকে। অর্থাৎ হত্যা ছাড়াও জেনোসাইড হতে পারে। যেমন দারফুরে কাউকে হাতে মারা হচ্ছে না, কিন্তু পরিস্থিতি এমনভাবে সৃষ্টি করা হচ্ছে, যাতে মানুষ না খেয়ে মারা যায়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল আইনকে ঠিকমতো না বোঝার কারণে চলতি ব্যবহারে অপরাধটা শুধু যুদ্ধাপরাধ হয়ে গেছে। অথচ আপনি ট্রাইব্যুনালের নামটাও দেখেন, সেখানে কিন্তু আন্তর্জাতিক অপরাধ বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধের ভেতর কী কী আসবে, তাও তিয়াত্তরের আইনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে। আইনের ভাষাটা ভালোভাবে বুঝে নেওয়া দরকার।
প্রথম আলো  পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের কথা যতটা ওঠে, দিনের পর দিন পরিকল্পিতভাবে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা, ভাসিয়ে দেওয়া, নিষ্ঠুরতা এবং নারী ধর্ষণকে একটা কর্মসূচি হিসেবে পালন করা, এই দুটি দিক বিচারের আলোচনায় কম ওঠে।
আহমেদ জিয়াউদ্দিন  আমি মনে করি, জেনোসাইড প্রমাণ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। এখানে অনেক জেনোসাইড হয়েছে। যেমন বাঙালিদের বিরুদ্ধে, আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে, হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে। অন্ততপক্ষে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে নিঃশেষ করার পরিকল্পনা পাকিস্তানের শাসকদের ছিল এবং সে অনুযায়ী তাদের আক্রমণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, কেবল আওয়ামী লীগ বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে অনেককে খুঁজে বের করে করে মারা হয়েছে। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এ কারণে নয়, কেবল রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে। যেকোনো আদালতেই এটা প্রমাণ করা কঠিন কিছু নয়। অন্ততপক্ষে এ দুটো বড় অভিজ্ঞতা দিয়েও আমরা প্রমাণ করতে পারব, বড় ধরনের দুটো জেনোসাইড হয়েছে। এর বাইরেও মুক্তিযোদ্ধা নন, আওয়ামী লীগ নয়, কমিউনিস্ট নয়, হিন্দু নয়, কেবল বাঙালি হওয়ার কারণেই অনেককে মরতে হয়েছে। অনেক এলাকায়ই অবাঙালিদের ছেড়ে দিয়ে কেবল বাঙালিদের ধরা হয়েছে। অতএব, তিনটি বড় ক্ষেত্রে অর্থাৎ জাতি হিসেবে, দল হিসেবে, ধর্ম হিসেবে জেনোসাইড করা হয়েছিল। আবার আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা মানলে, গণধর্ষণকেও জেনোসাইডের আওতায় নেওয়া যায়। কারণএর উদ্দেশ্যছিল, একটি জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বদলে দেওয়া।
প্রথম আলো  অভিযোগ আছে, বিহারি জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও যুদ্ধাপরাধ হয়েছে। তারা কি এই ট্রাইব্যুনালের কাছে বিচার চাইতে পারবে?
আহমেদ জিয়াউদ্দিন  বিহারিদের মানবাধিকার আসলেই লঙ্ঘিত হয়েছে সে সময়। কিন্তু এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন আর আন্তর্জাতিক অপরাধের মধ্যে পার্থক্যটা মনে রাখতে হবে। যখন আপনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে, পরিকল্পনা করে, সংগঠিত শক্তির বলে অপরাধ কার্যকর করছেন, তখন সেটা আন্তর্জাতিক অপরাধের আওতায় আসবে। আমি মনে করি না, বাংলাদেশ সরকার বা ভারত সরকার কারোরই আসলে বিহারিদের হত্যা করার কোনো ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ছিল। এবং সে অনুযায়ী তা কার্যকর করার ঘটনাও নেই। বিহারিরা সে সময় স্রোতের উল্টো দিকে ছিল এবং তারাও সহিংসতায় জড়িত ছিল। সবাই নয়, কিছু কিছু লোক। কখনোই অপরাধ সবাই করে না। এর প্রতিক্রিয়ায় কিছু কিছু সহিংসতা বাঙালিদের তরফেও হয়েছিল। যদিও আইনগতভাবে বাঙালি-বিহারিনির্বিশেষে সবাইকেই রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল সরকারের। মনে রাখতে হবে, তখনো সারা দেশে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তার পরও একটি ঘটনাও পাওয়া যাবে না, যেখানে সেনাসদস্যদের বিহারিদের হত্যার জন্য পাঠানো হয়েছে। যেটা হয়েছে তা প্রতিহিংসামূলক কিছু ঘটনা। এর বিচার চাওয়ার সুযোগ তো সাধারণ আইনেই রয়েছে। বিহারিদের যে বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র কখনোই টার্গেট করেনি, তার সাম্প্রতিক প্রমাণ হলো, বাংলাদেশের আইন ও আদালত পূর্ণাঙ্গভাবে তাদের জাতিগত সত্তাকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব দিয়েছেন। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করি না।
প্রথম আলো  আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের বিচারের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
আহমেদ জিয়াউদ্দিন  প্রথম পরামর্শ হলো, প্রসিকিউটর ও তদন্তকারী সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তদন্তকারীরা তদন্ত করবেন প্রসিকিউটরদের এবং আইনের প্রয়োজন অনুযায়ী। তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট সমন্বয় থাকতে হবে। একজন তথ্য সংগ্রহ করবেন এবং আরেকজন তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে আইনের সঙ্গে মানানসই হচ্ছে কি না, তা দেখে আদালতের সামনে উপস্থাপন করবেন। উভয়ের মধ্যে খুবই সহযোগিতামূলক সম্পর্ক যাতে থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তদন্ত যাতে সরকারি তদন্ত না হয়ে যায়, মিডিয়া তদন্ত না হয়ে যায়, সেটা দেখতে হবে। বিচারপ্রক্রিয়ার সফলতা নির্ভর করবে তদন্তকারীদের পেশাদারির ওপর। কারণ, তাঁদের তথ্যের ভিত্তিতে, তাঁদের দক্ষতার ভিত্তিতেই কিন্তু আদালত বিচার করবে।
প্রথম আলো  আন্তর্জাতিক মান অর্জনের জন্য যে চাপ রয়েছে, তা ব্যাখ্যা করবেন কি?
আহমেদ জিয়াউদ্দিন  যে প্রক্রিয়ায় বিচার এগোচ্ছে, সেটা ঠিকই আছে। যেভাবে আইন তৈরি করা হয়েছে এবং যেভাবে আইনের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালকে স্বাধীন করে দেওয়া হয়েছে, রুল তৈরি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তার ফলে আদালত একটা উচ্চমান অর্জন করেছে। এই আদালতের বিচারকদের দুজন হলেন উচ্চ আদালতের বর্তমান বিচারক এবং আরেকজন উচ্চ আদালতের বিচারক হওয়ার যোগ্য বিচারক, যিনি জেলা আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক। এখান থেকে আপিল যাবে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে। তার মানে এটা হচ্ছে উচ্চ আদালতের সমর্পায়ের আদালত এবং যেখানকার বিচারকেরা হলেন উচ্চ আদালতের বিচারক। এ ছাড়া আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার, আইনজীবী নিয়োগের অধিকার, ক্রস একজামিন করার অধিকার এবং আপিলের অধিকারসহ আসামিদের যেসব অধিকার দেওয়া হচ্ছে, তাতে নিশ্চিতভাবে এই আদালতের মান বাংলাদেশের মানের চেয়ে নিচে হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের মধ্যেও উচ্চ আদালত সম্পর্কে একটা ধারণা আছে, এখানে এলে অন্তত বিচার পাওয়া যাবে। কাজেই উচ্চ আদালতের সমমর্যাদা এবং উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের মাধ্যমেই কিন্তু মান নিশ্চিত করা হয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, যে বিচার হবে, তা বাংলাদেশের বিচারের মানের সমান কিংবা তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। বিচারপ্রক্রিয়া কেবল শুরু হলো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবংএর প্রসিকিউটর-ইনভেস্টিগেটরদের মুক্তভাবে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.