মানুষের জন্য অলিম্পিক by ইকরামউজ্জমান

অলিম্পিকের সঙ্গে সারা বিশ্বের মানুষের পরিচিতি বলার অপেক্ষা রাখে না। অলিম্পিক মূলত খেলাধুলার বৃহৎ অনুষ্ঠান। 'গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ।' খেলাধুলার অনুষ্ঠান হলেও অলিম্পিকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নীতির মহিমা, দর্শন ও আদর্শ। আছে গতির কাব্য। শক্তি, শৈলী, বীরপনাও।


অলিম্পিক তার কল্যাণময়ী আবেদনে বিশ্বের বিবেকবান মানবসমাজকে সব সময় চুম্বকের মতো টানছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন হলো অলিম্পিক। অলিম্পিক একটি মতবাদ, একটি প্রতিশ্রুতি। অলিম্পিক বিশ্বভ্রাতৃত্ব, শান্তি, মৈত্রী, পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস ও সমঝোতা, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, শিক্ষা, পরিবেশ, সংস্কৃতি, মানবজাতির মেধা, সম্ভাবনা, তাদের অগ্রগতি ও যোগ্যতাকে তুলে ধরার পক্ষে বৃহৎ একটি 'প্ল্যাটফর্ম'। অলিম্পিক আন্দোলন মানুষের জন্য, তাদের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য। অলিম্পিক সুস্থ জীবনবোধসম্পন্ন বিশ্ব মানবসমাজের বিবেক। সভ্য সমাজে আলোকবর্তিকা। অলিম্পিক গেইমস থেকে অলিম্পিক আন্দোলন অনেক বেশি আবেদনময় ও গুরুত্বপূর্ণ। এটা ইতিমধ্যেই বাস্তবে প্রমাণিত হয়েছে। জাতিসংঘ যা পারেনি, অলিম্পিক আন্দোলন তা পেরেছে। ধর্মবর্ণ-জাতি নির্বিশেষ পুরো বিশ্বকে একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনে একই চত্বরে পেরেছে একত্র করতে। বিশ্ব মানবসমাজকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে চলার পাশাপাশি সব সময় সহমর্মিতাময়, সুখী ও সমৃদ্ধিশালী একক পৃথিবী গড়ার কথা বলছে। জয়গান গাইছে মানবতা, মনুষ্যত্ব, তারুণ্য ও যৌবনের।
অলিম্পিক বারবার নাড়া দিচ্ছে জাগ্রত বিশ্ব বিবেককে। চার বছর পর পর অলিম্পিক চত্বরে আমরা দেখছি দেশ ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন। দেখছি এগিয়ে চলা, পিছিয়ে পড়া আর আগামী দিনের সম্ভাবনা। পৃথিবীর সব যুব-জনতার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অলিম্পিক গেইমস চলাকালে সে নগরী একটি ক্ষুদ্র বিশ্বে পরিণত হয়। অলিম্পিক গেইমসে যেমন আছে তীব্র প্রতিযোগিতা, তেমনি আছে মৈত্রীর আকর্ষণ। একে অপরকে কাছে থেকে দেখার ও জানার সহজ সুযোগ। সত্যি, অলিম্পিক অনুষ্ঠান একটি অপরূপ উৎসব। এই চত্বরে সবাই দেন আর নেন, মেলেন- কেউ শূন্য হৃদয়ে ফিরে যান না।
আধুনিক অলিম্পিক আন্দোলনের সঙ্গে যে কীর্তিমান মানবদরদি, শিক্ষাব্রতী, মানবতাবাদী ব্যক্তিত্বের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে, তিনি হলেন পিয়ের দ্য কুবারতিন। আধুনিক অলিম্পিকের জনক। অলিম্পিককে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসা, নতুন জীবনদান, আধুনিক বিশ্বে মানবতার কল্যাণে সবচেয়ে শক্তিশালী আন্দোলনের জন্মদাতা হলেন ব্যারন পিয়ের দ্য কুবারতিন। একজন মানুষ তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য কত বেশি নিবেদিত, দায়বদ্ধ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে পারেন, পিয়ের দ্য কুবারতিনের কর্মময় জীবন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আধুনিক অলিম্পিক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ এখন নিরাপদ এবং নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল। আর তাই অলিম্পিকের জনক সব সময়ই স্মরণীয় ও আলোচিত হবেন। কুবারতিন নামটি একটি অনুপ্রেরণা এবং শক্তি হিসেবে সব সময়ই চিহ্নিত হবে।
মানবতাবাদে বিশ্বাসী, জ্ঞানপিপাসু, প্রচণ্ড আশাবাদী কুবারতিন মানুষকে সব সময় ভালোবেসেছেন। মানুষের কথা সব সময় ভেবেছেন। চেয়েছেন শিক্ষাকে ক্রীড়াক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে একটি সুস্থ যুবসমাজ গড়ে তুলতে। চেয়েছেন ক্রীড়া-চত্বরে তাদের একত্র করে শান্তি ও মৈত্রীর পক্ষে আন্দোলন সৃষ্টি করতে। খেলাধুলার মাধ্যমে দেশ-জাতি, বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষ সবাইকে একই চত্বরে একত্র করতে। বিশ্ব যুবসমাজের অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও সম্ভাবনাকে মানবতার কল্যাণে কাজে লাগাতে। হিংসা, দ্বেষ আর বিদ্বেষমুক্ত শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তুলতে। ১৮৮৯ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে পিয়ের দ্য কুবারতিন প্রথম প্রাচীন অলিম্পিক প্রতিযোগিতার অনুকরণে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা প্রবর্তনের মূল পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এরপর তিনি তাঁর চিন্তা ও পরিকল্পনার পক্ষে জনমত এবং সমর্থন লাভের জন্য ফ্রান্সের বিভিন্ন ক্রীড়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় ও আলোচনা আরম্ভ করেন। কুবারতিন সব সময় বিশ্বাস করেছেন তাঁর চিন্তার পক্ষে জনমত গড়ে উঠবে; তবে কিছুটা সময় লাগবে। ১৮৯০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের সেসন কলেজে ছাত্র-শিক্ষকদের এক সভায় আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আরম্ভের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বক্তব্য দেন। এরপর ১৮৯২ সালের ২৫ নভেম্বর প্যারিসের সোরবনের অ্যাম্বিথিয়েটারে 'ফিজিক্যাল এঙ্ারসাইজ ইন দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড' শীর্ষক আলোচনা সভা। এ সভায় প্রাচীনকাল, মধ্যযুগ ও বর্তমানকালের খেলাধুলার ভূমিকা নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা হয়। ইতিহাসে স্মরণীয় এ সভায় কুবারতিন অলিম্পিক গেইমসের পুনরুজ্জীবন সম্পর্কে উদাত্ত কণ্ঠে প্রথম আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কুবারতিনের এই আবেগময়ী ভাষণ উপস্থিত ক্রীড়া সংগঠকদের মনে কমবেশি নাড়া দিতে সক্ষম হয়। কুবারতিন বেরিয়ে পড়েন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে। লক্ষ্য একটাই, অলিম্পিক শুরু করার সম্পর্কে সমর্থন এবং আলোচনা। পাশাপাশি প্রিন্ট মিডিয়ায় চালালেন তাঁর প্রচার কার্যক্রম।
১৮৯৪ সালের জুন মাস। অ্যামেচার স্পোর্টসের নীতি নির্ধারণ এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রচারের জন্য প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক কংগ্রেস ডাকা হলো। এ কংগ্রেস ১৬ থেকে ২৩ জুন অনুষ্ঠিত হবে বলে স্থির ছিল। আশাবাদী কুবারতিন মনস্থির করলেন, এই কংগ্রেসে আবার অলিম্পিক গেইমসের পুনঃপ্রবর্তনের বিষয়টি আলোচনা করবেন। কংগ্রেসের শেষ লগ্নে (২৩ জুন) যখন অলিম্পিক গেইমস ফের প্রবর্তনের জন্য তিনি দ্বিতীয়বার আবেদন জানালেন, তখন সভাকক্ষ মুখরিত হলো হর্ষধ্বনিতে। কংগ্রেসের এজেন্ডায় না থাকা সত্ত্বেও উপস্থিত সব প্রতিনিধি অলিম্পিক গেইমস পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব একমত হয়ে সমর্থন করলেন। শুধু তা-ই নয়, পুনরুজ্জীবিত অলিম্পিক গেইমস পরিচালনার জন্য এই কংগ্রেসেই ১৬ সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি গঠিত হলো। প্রথম প্রেসিডেন্ট মনোনীত হলেন গ্রিসের ডিমিট্রিয়ার্স ভাইকেলাস। আর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কার্যকরী পরিষদের সম্মানিত সদস্য হলেন পিয়ের দ্য কুবারতিন। কয়েক শ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া অলিম্পিক গেইমসকে বর্তমানের আলোকে উদ্ভাসিত করার প্রাথমিক সাফল্য এলো ১৮৯৪ সালে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, ১৮৯৬ সালে এথেন্সে প্রথম আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে। ১৮৯৬ থেকে ২০১২। ১১৬ বছর। ১১৬ বছরে অলিম্পিক সভ্য মানবসমাজকে কী দিয়েছে? কতটুকু দিতে পেরেছে? অলিম্পিকের দর্শন-নীতি কতটুকু অটুট আছে এই দীর্ঘ পথ চলাতে? আধুনিক অলিম্পিকের জনক পিয়ের দ্য কুবারতিন যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে চিন্তা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন, তাঁর উত্তরাধিকারী অলিম্পিক আন্দোলনের সেনানীরা তা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন? অলিম্পিক তার চেতনা, নীতি ও আদর্শ থেকে কেন বিচ্যুত হয়েছে? কেন অলিম্পিককে ঘিরে বারবার বিভিন্ন ধরনের বিতর্কের জন্ম হচ্ছে? প্রশ্নগুলোর উত্তরে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথাই বলা যাবে।
দীর্ঘ অলিম্পিক আন্দোলনের সঙ্গে সময়ের ধারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১১৬ বছরে পুরো বিশ্বে, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটা বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পাল্টে গেছে সব কিছুর সঙ্গে মন-মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও আবেগ। পাল্টে গেছে বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্র। অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এসেছে বিরাট পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের প্রভাবের বাইরে তো অলিম্পিক আন্দোলন নয়। ১৮৯৬ সাল থেকে যে রথের যাত্রা শুরু হয়েছে (শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ছাড়া), তা গড়িয়েই চলেছে। চলার পথে বাধা-বিপত্তি, ঝড়-ঝাপটা এসেছে, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে ভুগেছেন অলিম্পিক আন্দোলনের সেনানীরা। তবু কখনো হাল ছেড়ে দেননি। পরিবেশ-পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন। আর এর জন্যই অলিম্পিক পরিচিত হতে পেরেছে বিশ্ব মানবসমাজে আলোর দিশারি হিসেবে।

লেখক : ক্রীড়া কলামিস্ট ও বিশ্লেষক; সহসভাপতি, এআইপিএস, এশিয়া।

No comments

Powered by Blogger.