শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে পারেনি সরকার by আসিফ নজরুল

খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের গুজব ছড়িয়ে পড়ে শুক্রবার সন্ধ্যার পর। যাঁরা গুজব শুনেছেন তাঁরা কারণও জেনেছেন। শুক্রবার আর শনিবার সুপ্রিম কোর্ট বন্ধ। খালেদা জিয়াকে এই দুই দিনের মধ্যে উচ্ছেদ করা হলে তাঁর আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টে ছুটে গিয়ে স্টে অর্ডার নিয়ে উচ্ছেদ বন্ধ করতে পারবেন না।


যাঁরা গুজবে বিশ্বাস করেননি, তাঁরা ভেবেছেন সরকার এতটা বাড়াবাড়ি করবে না হয়তো। তাঁদের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে। শনিবারেই খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
এ সম্পর্কে সরকার ও সরকারের পক্ষের লোকজনের ভাষ্য শুনলাম। তাঁদের যুক্তি, বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার যে আদেশ হাইকোর্ট দিয়েছেন, তা স্থগিত করার আবেদন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা করেননি। হয়তো সত্যি তাঁরা তা করেননি। কিন্তু আপিল বিভাগ ২৯ নভেম্বর আপিলের অনুমতি দেওয়া হবে কি না, এর শুনানির দিন তো ঠিক করেছিলেন। এর আগেই তাঁকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হলে ২৯ তারিখের শুনানি কি অর্থহীন বা আইনের ভাষায় ইনফ্র্যাকচুয়াস হয়ে যায় না? ২৯ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করলে এবং রায় সরকারের পক্ষে গেলে অনভিপ্রেত ঘটনার কোনো সুযোগ আর থাকত না। খালেদা জিয়াকে তখন নিজে থেকেই বাড়ি ছেড়ে দিতে হতো। ২৯ তারিখ বা অন্তত রোববার ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করলে খালেদা জিয়ার পক্ষে আপিল বিভাগের কাছে গিয়ে উচ্ছেদ স্থগিত রাখার সুযোগও থাকত। সরকার খালেদা জিয়াকে সেই আইনি সুযোগ দিতে চায়নি কেন?
আইন আর বিচারব্যবস্থার অন্যতম দার্শনিক মূলনীতি জনস্বার্থ। ২৯ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করে খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়তে আইনগতভাবে বাধ্য করা হলে কি জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হতো? হতো না। যে দেশে বহু দুর্নীতিবাজ, ভূমিদস্যু, ঘৃণিত ব্যক্তির অবৈধ দখল উচ্চ আদালতের স্টে অর্ডারে কিংবা সরকারের শৈথিল্যে অব্যাহত থাকে, সে দেশে এত অত্যুৎসাহী হয়ে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধী দলের নেত্রীকে প্রায় ৪০ বছরের বাসভবন থেকে উৎখাত স্বাভাবিক বিষয় নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, হাইকোর্ট সরকারকে বলেছিলেন খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়তে কমপক্ষে ৩০ দিন সময় দিতে। কমপক্ষে ৩০ দিন মানে ৩২তম দিনেই কাজটি করার বাধ্যবাধকতা নয়। সরকার বরং আরও কিছুদিন অর্থাৎ আদালতের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করার শুভবুদ্ধি দেখাতে পারত। দেশ তাতে অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাত আর অনিশ্চয়তা থেকে বেঁচে যেত। সরকারের আচরণ ও নিয়ত থাকত অনেকাংশে প্রশ্নমুক্ত।
সরকারের একজন মন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, সরকার কিছু করেনি, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্ছেদ করেছে। কিন্তু এমন বক্তব্য হাস্যকর। ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড সরকারের অধীন এবং সরকারেরই একটি অংশ। একজন প্রতিমন্ত্রী অশালীন ভঙ্গিতে এটিএনকে বলেছেন, ‘খালেদাকে উচ্ছেদ করা হলে তিনি সাজুগুজু করার সময় কোথায় পেলেন?’ তাঁর বক্তব্যও গ্রহণযোগ্য নয়। উচ্ছেদ হতে পারেন, বহু ঘণ্টা আগে এটি জেনে একজন ভদ্রমহিলা আলুথালু ভঙ্গিতে মিডিয়ার কাছে হাজির হতে পারেন না। এসব আলোচনা এখানে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে এটি প্রমাণ করে সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যের সারবত্তা নেই কিংবা সারগর্ভ বক্তব্য দেওয়ার যোগ্যতা তাঁদের নেই। যে দুজন মন্ত্রীর কথা বললাম, তাঁরা কেউই বড় রাজনীতিক নন, একজন এমনকি জনপ্রতিনিধিও নন। আমার ধারণা, খালেদা জিয়ার বাড়ির বিষয়টি যদি আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া রাজনীতিকদের সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হতো তাহলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না দেশে।
খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের সঙ্গে শেখ হাসিনার গণভবন ত্যাগ করার তুলনা টেনেছেন কেউ কেউ। কিন্তু আসলে দুটি ঘটনা অবিকল নয়। শেখ হাসিনাকে গণভবন বরাদ্দ দিয়েছিল তাঁরই সরকার, খালেদাকে অন্য একটি সরকার। খালেদা জিয়ার বরাদ্দ বাতিল করেছে হাসিনার সরকার। আর শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। পরে খালেদা সরকারের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে গণভবনের বরাদ্দ বাতিল করা হয়। ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি মূলত একটি বাসভবন, গণভবন কোনো বাসভবন নয়। তাই বলে আমি বলছি না, ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি নিজ দখলে রাখার সংকল্প সমর্থনীয় এ কারণে। পরিবারে সচ্ছলতা আসার পর ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি নিজেই ছেড়ে দিতে পারতেন খালেদা জিয়া। সেটি বড় মাপের মানুষ ও নেতার পরিচায়ক হতো।
এ ক্ষেত্রে বড় মাপের পরিচয় দিতে না পারা খালেদা জিয়ার ব্যর্থতা, কিন্তু অন্যায় নয়। খালেদা জিয়ার অন্যায় অন্য জায়গায়। তাঁর আমলে শেখ হাসিনার প্রাণনাশের নির্মম ও ভয়াবহ প্রচেষ্টা হয়েছিল। তিনি বলতে পারেন এ সম্পর্কে তিনি আগে জানতেন না। কিন্তু এর দায়, বিশেষ করে এর হাস্যকর তদন্তের দায়, তিনি সরকারপ্রধান হিসেবে এড়াতে পারবেন না। বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানার নামে বরাদ্দ করা জায়গায় নিজে উপস্থিত হয়ে থানা উদ্বোধনের অনভিপ্রেত আচরণের দায়ও তিনি বিস্মৃত হতে পারেন না।
দুই নেত্রী এভাবেই পরস্পরকে আঘাত করে চলেছেন। হয়তো তাঁদের মধ্যে কাজ করে এক ধরনের অবজ্ঞা ও প্রতিশোধস্পৃহা। কিন্তু এর মূল্য তো দিতে হয় তাঁদের দুজনকেই! এর মাশুল দিতে হয় জনগণকেও। সর্বশেষ ঘটনায় তা-ই ঘটেছে। শেখ হাসিনার সরকার খালেদাকে শান্তিতে ঈদ করতে দিলেন না, তাঁর সম্মান ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেন না। বিক্ষুব্ধ খালেদা জিয়ার দল হরতাল ডেকে জনগণের নির্বিঘ্নে ঈদের প্রস্তুতি নিতে দিল না। দেশের অর্থনীতি, জনগণের নিরাপত্তা, এমনকি কোমলমতি শিশুদের পরীক্ষার মারাত্মক বিঘ্ন ঘটার মূল দায় এই দুই নেত্রীর।
হতে পারে দুজনের আশপাশে সুপরামর্শ দেওয়ার লোক নেই। হতে পারে পরিকল্পিতভাবে সংঘাত সৃষ্টি করে দেশে আরও একবার এক-এগারো ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে তাদের আশপাশের কোনো কোনো মহল। কিন্তু দুই নেত্রী যদি সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারেন, যদি কারও উসকানি বা যড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেন, তাহলেও তা তাঁদের ব্যর্থতা। দুঃখ হচ্ছে, এই ব্যর্থতার মূল্য শুধু তাঁদের দুজনকে নয়, সারা দেশকে দিতে হচ্ছে, দিতে হবে।
 আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.