বৈশাখে উদ্দীপ্ত নগর অর্থনীতি by আসজাদুল কিবরিয়া

বৈশাখী কেনাকাটা এখন ঈদুল ফিতরের পর সবচেয়ে বড় কেনাকাটার আসর। আর এই বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন বা পয়লা বৈশাখকে ঘিরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে প্রতিবছরই। আবহমান কাল থেকেই বৈশাখী মেলা ও বর্ষবরণের আয়োজন হয়ে আসছে বাংলাদেশে।


তবে দীর্ঘ সময় ধরে তা ছিল মূলত গ্রামকেন্দ্রিক, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে কিছুটা সমর্থন জোগাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বৈশাখ নগরকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈশাখী বাণিজ্যের বিস্তার দেশের ক্ষুদ্রশিল্প ও ব্যবসার জন্য বড় ধরনের উদ্দীপক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সর্বজনীন বাঙালি উৎসব পয়লা বৈশাখ সামনে রেখে সবচেয়ে বেশি কেনাকাটা হয় পোশাককেন্দ্রিক, যার প্রায় পুরোটাই দেশীয় কাপড়ের। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মাটি-কাঠের তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের গয়না, চুড়ি, মাটির তৈজস ও গৃহসজ্জাসামগ্রী এবং হস্তশিল্পজাত বিভিন্ন পণ্য।
বছরজুড়ে পোশাকসহ এসব বেচাকেনার অন্তত ১৫ শতাংশ বৈশাখকেন্দ্রিক হয় বলে জানা গেছে। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে হয়ে থাকে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। বাকিটা সারা বছরের। তাই বৈশাখী প্রস্তুতি নেওয়া হয় বেশ জোরেশোরেই।
আবার ঈদে যেখানে খাবারের মূল আয়োজনটা হয়ে থাকে ঘরোয়াভাবে, সেখানে পয়লা বৈশাখে ঘরে-বাইরে প্রায় সমানতালে খাবারের আয়োজন থাকে। এ আয়োজন বিভিন্ন ধরনের রেস্তোরাঁ-হোটেলের ব্যবসা বাড়িয়ে দেয়। এমনকি পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতেও থাকে নানা আয়োজন। আর মিষ্টির দোকানের বিকিকিনির বিষয়টি তো বহু আগে থেকেই পয়লা বৈশাখের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক নাজনীন আহমেদ এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমাদের তাঁতশিল্পের বড় ধরনের উজ্জীবন ঘটেছে। বিকাশ ঘটেছে দেশীয় পোশাকে দেশীয় ফ্যাশনের। আর আমাদের দেশীয় ফ্যাশন ও বুটিক হাউসগুলো এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।’
নাজনীন আরও বলেন, দেশীয় পোশাকের এ বিস্তারের পাশাপাশি হস্তশিল্পজাত বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর চাহিদাও বৈশাখের সময় বেড়ে যায়। আর এসব কিছুই ক্ষুদ্র ও কুটির বা ঘরোয়া শিল্পকে একধরনের উদ্দীপনা জোগাচ্ছে। তাঁতি তথা উৎপাদকেরা সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন। উৎসাহিত হচ্ছেন ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারাও। পরিমাণে অল্প হলেও তা কর্মসংস্থানে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতেও একটা প্রভাব ফেলছে।
বিআইডিএসের এই গবেষক এ জন্য দেশীয় ফ্যাশন ডিজাইনার ও শিল্পীদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এই ফ্যাশন ডিজাইনাররাই বৈশাখী পোশাক ও রঙের সম্ভারকে সামনে নিয়ে এসেছেন; প্রতিষ্ঠা করেছেন ফ্যাশন ও রুচির একটি নতুন ধারা। এ ধারা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে, যা বাড়াচ্ছে ব্যবসা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।’
বৈশাখী পোশাকে নামীদামি ব্র্যান্ড ফ্যাশন হাউসগুলোর পাশাপাশি ছোট ছোট বুটিক হাউস ঢাকাসহ দেশজুড়ে বেচাকেনায় নেমেছে। তবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে দাম বেড়ে গেছে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া প্রভৃতির।
এ প্রসঙ্গে ফ্যাশন হাউস রঙের অন্যতম কর্ণধার সৌমিক দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈশাখের কেনাকাটা এখনো অনেকটা শখের বিষয়। তাই দাম বেশি হলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ক্রেতারা নিরুৎসাহিত হন। অথচ এটা আমাদের ব্যবসার একটা ভালো সময়। তাই আমরা কয়েক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকি। আর কিছু ছাড় দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা করি।’
সৌমিকের মতে, প্রতিবছরই বৈশাখে সার্বিক বেচাকেনা বাড়ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে করে বেশির ভাগ মানুষই ইচ্ছানুসারে বৈশাখী কেনাকাটা করতে পারে না।
বৈশাখী বাণিজ্যের সুযোগ নিতে পিছিয়ে নেই আসবাব থেকে শুরু করে জমি-বাড়িও। নানা ধরনের ‘বৈশাখী ছাড়’ দেওয়া হচ্ছে ক্রেতাদের। এ তালিকায় আরও আছে মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক সামগ্রী। নানা রকম প্রসাধনীর বিক্রিও এ সময় কিছুটা বেড়ে যায়।
পয়লা বৈশাখের ব্যবসায় পিছিয়ে নেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও। তারা বাজার বাড়ানোর প্রয়াসের অংশ হিসেবে নানা ধরনের প্রচারণা ও উপহার বিতরণে নামে। প্রতিবারই এতে আনা হয় বৈচিত্র্য। সব মিলিয়ে বৈশাখে এখন উদ্দীপ্ত দেশীয় অর্থনীতি।

No comments

Powered by Blogger.