ধর্ম-নারী ও শিশু পাচার রোধে গণসচেতনতা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

নারী ও শিশুদের ওপর যেসব উপায়ে নির্যাতন করা হয়, তন্মধ্যে পাচার অন্যতম। নারী ও শিশুকে অন্যায় ও অবৈধভাবে তাদের বাসাবাড়ি থেকে দেশের অভ্যন্তরে বা দেশের বাইরে পতিতাবৃত্তি বা শ্রমকাজের জন্য অর্থের বিনিময়ে পাঠিয়ে দেওয়ার নাম নারী ও শিশু পাচার। ইসলাম যেকোনো রকম নির্যাতন প্রতিরোধে সোচ্চার।


তাই নারী ও শিশু পাচার রোধে ইসলামের ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ। মানব পাচারকারী চক্র জনগণের বিশ্বাসের চরম অবমাননা ও অবমূল্যায়ন করে থাকে। এর চেয়ে বড় প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি আর কী হতে পারে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এর চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা আর কিছুই নেই যে তুমি এমন ব্যক্তির সঙ্গে মিথ্যার আশ্রয় নেবে, যে তোমাকে বিশ্বাস করে।’ (আবু দাউদ)
বর্তমান যুগে অর্থ উপার্জনের সহজ মাধ্যম হিসেবে একদল ঘৃণ্য অপরাধী মানব পাচার করার কাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। পাচারের জন্য নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করে তারা নারী ও শিশু পাচারের মতো ইসলামপরিপন্থী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এমন অনেক বিষয়ের প্রলোভন দেখায়, যাতে নারী বা শিশুর অভিভাবক নিজেদের সন্তানকে স্বেচ্ছায় তাদের হাতে তুলে দেন। কখনো কখনো অপহরণ করে বা চুরি করে পাচার করে দেয় তারা। পাচারকারীরা নারী ও শিশুদের পাচার করার জন্য বিভিন্ন সুযোগের অপেক্ষায় থেকে পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে নানা অপকৌশল গ্রহণ করে। নারী ও শিশু পাচারের পেছনে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য জড়িত নেই। অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনই পাচারকারীদের মূল লক্ষ্য। তা ন্যায় পথে হচ্ছে কি অন্যায় পথে, সেটিকে তারা বড় করে দেখে না।
দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও বেকারত্বের কারণে যেকোনো অসচেতন নারী-পুরুষ, শিশু বা যেকোনো মানুষই পাচারকারীর কবলে পড়তে পারে। সাধারণত অতিদরিদ্র শিশু-কিশোর-কিশোরী, নারী, বিশেষ করে অনাথ ছিন্নমূল, বিচ্ছিন্ন পরিবারের সদস্য বা শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়ির কাজে নিয়োজিত শিশু ও গৃহপরিচারিকা, বিধবা বা বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া নারী এমনকি ভালো কাজের প্রত্যাশী পুরুষেরাও পাচার হয়ে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে পতিতাবৃত্তি, বাধ্যতামূলক শ্রম ও বিভিন্ন ধরনের দাসত্বের উদ্দেশ্যে, বিশেষ করে নারী ও শিশু বিপুলসংখ্যক পাচার হচ্ছে। মানব পাচার কম-বেশি সারা বিশ্বেরই সমস্যা। নারী ও শিশু পাচারের মতো জঘন্য অপরাধ প্রবণতা প্রাক-ইসলামি যুগেও ছিল। তবে নারী ও শিশুরাই অধিক পরিমাণে পাচারের শিকার হয়।
পাচারের শিকার হওয়া মানুষগুলোকে পাচারকারীরা দেশের মধ্যে অথবা দেশের বাইরে বিভিন্ন অমানবিক কাজে নিয়োগ করছে। যেখানে পাচারকৃত ব্যক্তির মানবাধিকার বা কোনো স্বাধীনতা থাকে না। পাচারকারীরা নারী ও শিশুদের সাধারণত যেসব অবৈধ কাজে নিয়োজিত করে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শরিয়তসম্মত নয়। পাচারকৃত মানবসন্তানকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করা হয়, নারীদের পতিতাবৃত্তি বা অশ্লীল ছবি তৈরির অসৎ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম, যেমন—উটের জকি, অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, ছিনতাই, মাদক, অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করা হয়। এসব কাজ ইসলামে অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
নারী ও শিশু পাচার একটি মহা অন্যায় ও হারাম কাজ। ইসলাম নারী ও শিশুকে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করেছে। কন্যা, জায়া ও জননী—এর যেকোনোটিই নারীর পরিচয় হোক না কেন, ইসলাম তাদের সব অধিকার সংরক্ষণ করেছে। শিশু নির্যাতন ও অবহেলাই মানবপাচারের অন্যতম কারণ। অথচ ইসলাম শিশুসন্তান, বিশেষ করে কন্যাশিশুর যত্ন নেওয়া ও তাদের অধিকার আদায়ের ওপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেছে। শিশুদের লালন-পালন ও স্নেহ করা মুসলমানদের ঈমানি দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া-স্নেহ করে না, সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়।’ (বুখারি)
ইসলাম নারী ও শিশুর যে মর্যাদা দিয়েছে, তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না থাকার ফলে সমাজে নারী ও শিশু আজ চরম অবহেলিত, নির্যাতিত। ইসলাম নারী জাতিকে হীনজ্ঞান করা, তাদের যথাযথ মানবিক, সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদা না দেওয়া, তাদের অধিকার হরণ করা ও অকারণে অত্যাচার-নির্যাতন চালানো প্রভৃতির বিরুদ্ধে দুর্লঙ্ঘ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তাই নারীসমাজের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবহেলা অবাঞ্ছিত। ইসলাম নারীদের শিক্ষা গ্রহণ বা চাকরি করতে নিরুৎসাহিত করেনি। অথচ আমাদের সমাজে বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত নারীদের অবহেলা, অমর্যাদার কারণে একশ্রেণীর অসৎ মানুষ তাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে বা ফুসলিয়ে উন্নততর জীবনযাপনের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে দেশ-বিদেশে পাচার করে দেয়।
ইসলাম যেহেতু নারী ও শিশু পাচারকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে এবং পাচারকারীদের কঠিন শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে, সেহেতু পাচারের মাধ্যমে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের জীবন রক্ষায় আত্মনিয়োগ করা প্রতিটি মুসলমানের ওপর অবশ্যকরণীয়। ইসলাম নারী ও শিশু পাচারকারীদের আদৌ ক্ষমা করবে না, তাদের অবশ্যই ইহকাল ও পরকালে কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ভোগ করতে হবে। সুতরাং নারী ও শিশু পাচার ইসলামের দৃষ্টিতে কী জঘন্য অপরাধ, তা সহজেই অনুমেয়। নারী ও শিশু পাচার যাতে না হয়, সে জন্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং নারী ও শিশু পাচার হয়ে গেলে তাদের মুক্ত করার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের কী হলো যে তোমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছ না? অথচ দুর্বল নারী, পুরুষ ও শিশুরা চিৎকার করে বলছে যে হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের জালিমের জনপদ থেকে উদ্ধার করুন। আপনি আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থকে সাহায্যকারী পাঠান।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-১৭৫)
সমাজের শৃঙ্খলা বিধানের জন্য নারী ও শিশু পাচারের মতো জঘন্য অপরাধ দমনের জন্য প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের যে বিধান রাখা হয়েছে, তা ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। মানব পাচার অপরাধ দমনের জন্য এ মুহূর্তে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং সামাজিক প্রতিরোধ অত্যন্ত প্রয়োজন। নারী ও শিশু পাচার রোধে জাতীয় পর্যায়ে সভা, সমাবেশ, সেমিনার, আলোচনা অনুষ্ঠানে মসজিদের ইমাম, খতিব, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের জনসচেতনতা সৃষ্টিতে পাচারের মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করা অতীব প্রয়োজন। এমতাবস্থায় ইসলাম প্রদত্ত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে পাচারকারীরা দরিদ্র লোকদের আর অসৎ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবে না। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী নারী ও শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করতে পারলে পাচারকারীদের অপতৎপরতাও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: শিক্ষক, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.