তরুণের জয়গান-বৈশাখী তারুণ্য by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

বৈশাখের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জন্মের যোগ ছিল, ছিল প্রাণেরও। আশি বছরে দেহত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু মৃত্যুর কয়েক মাস আগে ‘সভ্যতার সংকট’ নামে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাতে একজন বৃদ্ধের ভাবনা-চিন্তার পরিবর্তে একজন তরুণের ক্রোধ এবং প্রত্যয়ই ফুটে উঠেছে। একজন তরুণের দৃষ্টিতে তিনি সমাজকে দেখতেন, ইতিহাসকে


দেখতেন এবং কিছু মৌলিক পরিবর্তন কামনা করতেন। এই পরিবর্তন যে নিজ থেকে, প্রাকৃতিক নিয়মে আসবে না, তাও তিনি জানতেন। সে জন্য তিনি জোর দিয়েছেন তরুণদের নৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রস্তুতির ওপর, সমাজ বদলের শিক্ষিত অঙ্গীকারের ওপর। কল্পনার ‘বর্ষশেষ’ কবিতায় তাঁর প্রিয় ইংরেজ কবি শেলির ‘ঔড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’ কবিতার মতো প্রকৃতিকেও সঙ্গী করেছেন পরিবর্তন প্রয়াসে। ওই কবিতার নতুনের আবাহন করেছেন, বর্ষাশেষের ঝড়ের শক্তি যাতে তারুণ্যের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, সে কামনা করেছেন:
হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি
পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে—
ব্যাপ্ত করি, লুপ্ত করি, স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে
ঘনঘোর স্তূপে...
আর প্রতীজ্ঞা করেছেন, সেই নতুনদের পক্ষে:
চাব না পশ্চাতে মোরা, মানিব না বন্ধন ক্রন্দন
এবং,
মুহূর্তে করিব পান মৃত্যুর ফেনিল উন্মত্ততা
উপকণ্ঠ ভরি—
বর্ষশেষ তো একটি নতুন বছরের আগমনীও বটে। বছরের পর বছর যদি নতুনের অভিযাত্রা অব্যাহত থাকে, যদি প্রতিটি বৈশাখে তারুণ্য গ্রহণ করে দিনবদলের অঙ্গীকার এবং দিনবদলের সংগ্রামে পথে নামে, তাহলে এই বাংলার দুঃখ-দারিদ্র্য, অপমান-লাঞ্ছনা শিগগিরই অতীতের বিষয় হয়ে যায়।
বাংলাদেশ আজ বরণ করছে ১৪১৯ সালকে। ১৪১৮-এর অবসানে অনেকেই অতীতে ফিরে গেছেন, হিসাব কষেছেন বছরজুড়ে নানা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির। সে জন্য তাঁদের কণ্ঠে প্রাধান্য পেয়েছে খেদ এবং হতাশা। কিন্তু তারুণ্যের জন্য এই খেদ এবং এই হতাশা নয়, তারুণ্যের জন্য প্রধান হওয়া উচিত সংকল্প এবং আত্মবিশ্বাস।
বৈশাখ আমাদের আত্মবিশ্বাস শেখায়, সংকল্পবদ্ধ হতে শেখায়। অনেক আগে এক বৈশাখের প্রথম দিনে মাঝনদীতে আমাদের নৌকা পড়েছিল ঝড়ের কবলে। আমরা কয়েক বন্ধু নৌকার যাত্রী—আমাদের চোখে ঘনিয়ে এসেছিল শঙ্কা। কিন্তু মাঝির চোখে শঙ্কা ছিল না, ছিল ঝড়কে পরাজিত করার সংকল্প। তিনি দৃঢ়হাতে বৈঠা ধরেছিলেন, তাঁর মুখে ছিল প্রত্যয়ের কাঠিন্য। দক্ষহাতে তিনি নৌকাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। নৌকাটি তাঁরই বশ্যতা স্বীকার করেছিল, ঝড়ের নয়। তিনি যখন নৌকা চালাচ্ছিলেন, আমরা অবাক চোখ চাওয়া-চাওয়ি করছিলাম; ভাবছিলাম, যদি নৌকাটি হতো বাংলাদেশ এবং তিনি সেই দেশের কান্ডারি! আরেক দূরবর্তী বৈশাখ দিনে কালবৈশাখীতে লন্ডভন্ড হয়েছিল ডেমরার একটি গ্রাম। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলাম সেই গ্রামে। চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি ঝড়টার ধ্বংসযজ্ঞের, দেখি ঘর উঠছে, চাল বসছে, খোলা আকাশের নিচে রান্না হচ্ছে, শিশুরা খেলছে। কান্না ভেসে আসছে কোনো কোনো বাড়ি থেকে; কিন্তু কান্নাকে ছাপিয়ে উঠেছে জীবনের কলরব। এই জীবন আবহমান বাংলার। বাংলার কৃষকের, বাংলার শ্রমিকের এই হচ্ছে শক্তিশালী বৈশাখ যাপন, বর্ষাযাপন। এই চিত্রটি অভাবে-দুর্ভিক্ষে, শত দুর্ভোগেও মলিন হয় না।
যে তরুণেরা আগামীতে কান্ডারি হবেন দেশের ও জাতির, তাঁদের এই শক্তি এবং সাহসের জন্য যেতে হবে বিশাল বাংলার মানুষের কাছে, বৈশাখে ঘর হারানো গৃহস্থের কাছে, শিলাবৃষ্টিতে খেত তছনছ হওয়া কৃষকের কাছে, মেঘনা অথবা সাগরে জাল ফেলা মৎস্যজীবী ও মাঝির কাছে। এই শক্তি ও সাহস তাঁকে তাঁর শিক্ষাসনদ দেবে না, তাঁর রাজনৈতিক দল অথবা নেতানেত্রী দেবে না। এই অর্জনটুকুর জন্য আমাদের জনজীবন, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসে তাঁকে ফিরতে হবে।

২.
সংস্কৃতির কথায় বাংলাদেশজুড়ে বর্ষবরণ উৎসবের প্রসঙ্গটি উঠে আসে। পয়লা বৈশাখে সারা বাংলাদেশে বর্ষবরণ হয়—আড়ং হয়, মেলা হয়, হালখাতা খোলা ও মিষ্টিমুখ হয়, যেমন হয়েছে এক শ-দু শ বছর আগেও। এই উৎসবটি ধর্ম-জাত-পেশানির্বিশেষে সবার। এর উদ্যাপনটিও তাই সর্বজনীন। শহরের মানুষ পয়লা বৈশাখে স্মৃতিকাতর হতো, আড়ং-মেলার জন্য হাহাকার করত। পাকিস্তানিরা যখন আমাদের সংস্কৃতির মূলে কুঠার চালাচ্ছিল, তখন এই গ্রামীণ উৎসবটি শহুরেদের কাছে একটা শক্তিরূপে ধরা ছিল। ঢাকা শহর তখন কলেবরে বাড়ছে, দৈত্যের মতো হচ্ছে এবং দেশে পাকিস্তানি ধারার রাজনীতি ও সংস্কৃতিবিরোধিতা চলছে, সেই আশির দশকে, তখন এই নববর্ষের উৎসবটা একটা অস্ত্রের মতো হাতে তুলে নিল বাঙালি। ছাত্ররাই, তরুণেরাই এই পুনর্জাগরণের রূপকার হলো। তারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে, চারুকলাকে কেন্দ্র করে বাঙালি সংস্কৃতির প্রেরণাসঞ্চারি, আলোকিত আর অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রটিকে বর্ষবরণ উৎসবের কেন্দ্রে নিয়ে এল। শুরু হলো মুখোশমিছিল, রমনা পার্কে ভোরের সংগীতানুষ্ঠান। কালে কালে অনুষ্ঠানের সংখ্যা ও পরিধি বাড়ল। আজ তো দেখা যায়, সারা বাংলাদেশেই এই নতুন রূপের নববর্ষ উৎসব চলে সারা দিন ধরে। এই উৎসব হালখাতার মলাট থেকে, আমাদের পতাকা থেকে, গ্রীষ্মের কৃষ্ণচূড়া থেকে লাল রংটি নিল; সাদা নিল আমাদের পবিত্রচিন্তার প্রশান্তি থেকে। এখন বৈশাখের রং হচ্ছে তারুণ্যের লাল এবং পরিণত বয়সের সাদা; অথবা তারুণ্যের লাল এবং তার আলোকিত, স্থিতধী চিন্তার সাদা। বৈশাখ তার কড়ি ও কোমলে যে বৈপরীত্যকে মেলায়, লাল-সাদা সে রকম এক সমীকরণের ইঙ্গিত। সে জন্য, শুধু প্রচণ্ড হলে চলবে না, শান্তও হতে হবে; শুধু তীব্র হলে চলবে না, সুস্থিরও হতে হবে। তারুণ্যকে এ রকম অনেক বৈপরীত্যকে, বিপ্রতীপতাকে একখানে এনে মেলাতে হবে। ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটাকে মেলানোর মতো।

৩.
পয়লা বৈশাখে আমি তারুণ্যকে দেখি; তারুণ্যের শক্তি, স্পর্ধা আর সম্ভাবনাকে দেখি। বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় আমার বাসা। সারা দিন পাড়াটি অবরুদ্ধ থাকে—সারা বাংলাদেশ যেন ভেঙে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিন। কিন্তু রাস্তায় বেরোলে দেখি, সব তরুণ। নববর্ষ উৎসব এখন এমন ব্যাপক এবং বিশাল যে এর সামনে প্রতিক্রিয়াশীলতার একশটা ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়লেও সেগুলো গুঁড়িয়ে যাবে। যা ভালো লাগে এই উৎসবের আমার—এর উচ্ছল এবং অদম্য তারুণ্য, কিন্তু একই সঙ্গে এক নান্দনিক শৃঙ্খলা। উচ্ছ্বাস আছে, অসভ্যতা নেই। এটি সবচেয়ে বড় কথা।
বৈশাখী তারুণ্যকে আমি সারা বছরে পরিব্যাপ্ত হতে দেখতে চাই। বৈশাখের আগুন আর উত্তাপ, এর ঝড় এবং হঠাৎ বৃষ্টি আমি তরুণদের মনে সারা বছর জাগ্রত দেখতে চাই। বাংলাদেশটাকে অচলায়তন বানানোর প্রয়াস নিয়েছে অন্ধকারের অনেক গোঁসাই। অনেক তাদের নাম আর পরিচয়। তারা আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা, সভ্যতাকে বিকৃত করে, খর্ব করে, দখলে নিতে চায়। বাংলাদেশকে অচলায়তন বানাতে চায় বাজারের শক্তি, রাজনীতির অপশক্তি, দারিদ্র্য, শিক্ষাহীনতার কারবারিরা। আমাদের কুসংস্কার, অসহিষ্ণুতা আর নানান অন্ধ আবেগ। এগুলোর ওপর দিয়ে বৈশাখের আগুন আর ঝড় বইয়ে দিতে হবে এবং তা পারবে তরুণেরা। সেই তরুণেরা যারা একই সঙ্গে স্পর্ধিত এবং বিনয়ী, প্রত্যয়ী এবং দরদি; যারা অকারণ কলহে আত্মশক্তির অপচয় ঘটাবে না, বরং আত্মশক্তিকে জাগাবে সমষ্টিকে জাগাতে।
এ রকম অসংখ্য তরুণ নীরবে প্রস্তুত হচ্ছে। সারা দেশে, তাদের জন্য এই বৈশাখে আমার অভিবাদন এবং ভালোবাসা।

No comments

Powered by Blogger.