চরাচর-মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত তেলিয়াপাড়া ডাকবাংলো by কেয়া চৌধুরী

বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার তৎকালীন মহকুমায় অবস্থিত তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ডাকবাংলোটি মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি অন্যতম স্মারক। অবস্থানগত দিক দিয়ে এটি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও ৪ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। সিলেটের এ অঞ্চল প্রাকৃতিক দিক দিয়ে পাহাড়-নদীনালা বেষ্টিত দুর্গম এলাকা।


তাই সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল গেরিলাযুদ্ধের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত কেন্দ্র। অন্যদিকে দুর্গম পথের জন্য হালকা অস্ত্র নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে অধিক নিরাপদ বলে বিবেচিত হতো। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন নবগঠিত সদর দপ্তর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ গ্রেপ্তার হওয়ার আগ মুহূর্তে টেলিগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার যে দিকনির্দেশনা দিকে দিকে পাঠিয়েছিলেন, তাঁর সেই দূরদর্শী দিকনির্দেশনায় বাঙালির প্রতিরোধ-সংগ্রামকে একটি সম্মানিত, সুসংগঠিত ও সফল প্রতিরোধ-গণযুদ্ধ হিসেবে বাস্তবায়ন করার জন্য '৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তার পাশাপাশি পাকিস্তানি জান্তা কর্তৃক বাঙালির ওপর আরোপিত যুদ্ধকে সামরিক দিক দিয়ে সুশৃঙ্খল, সুসংগঠিত রণকৌশলগত বিচার-বিবেচনায় প্রশিক্ষিত এক দক্ষ মুক্তিবাহিনী তৈরির জন্য 'বীর বাঙালি' কিছু সামরিক অফিসার প্রথমবারের মতো মিলিত হন তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ডাকবাংলোয়। ঘটনার মূল্যায়নে এ দিনটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা সেদিন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে তেলিয়াপাড়ায় বৈঠকে বসেছিলেন কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী, লে. কর্নেল (অব.) এম এ রব, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর মইনুল হোসেন, মেজর কাজী নূরুজ্জামান ও মেজর জিয়াউর রহমান। ওই বৈঠকে গোটা মুক্তিবাহিনীকে অর্থাৎ নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনীকে একটি নিয়ন্ত্রিত পন্থায় সফল গণসংগ্রামের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আলোচনা করা হয়। এ ছাড়াও বৈঠকে রাজনৈতিক ও সামরিক নানা দিক নিয়ে আলোচনাসহ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রামকে সফল করার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। এ প্রসঙ্গে মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বীর-উত্তম বলেন, '১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল আমরা বাঙালি স্বাধীনতাকামী অফিসাররা তেলিয়াপাড়া বৈঠকে বসি। উদ্দেশ্য আমাদের একটাই, কমান্ড স্ট্রাকচার তৈরি করা। আমরা এ বিষয়ে একমত হই যে, যেহেতু আমরা সামরিক বাহিনী হতে বিদ্রোহী সৈন্য, তাই আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে প্রস্তাব রাখা উচিত যেন তারা দ্রুত সরকার গঠন করেন। কারণ এখন আমাদের দরকার পলিটিক্যাল আমব্রেলা।' তেলিয়াপাড়ায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিবেচিত হতে থাকে। সবুজে ঘেরা তেলিয়াপাড়া আজও সেই স্মৃতি বহন করে চলছে। ডাকবাংলোর সামনে বুলেট আকৃতির একটি স্মৃতিসৌধ দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এর গুরুত্বের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যেন নতুন প্রজন্মের আমরা প্রকৃত ইতিহাসের টানে শুধু সত্যের দিকেই ধাবিত হই।
কেয়া চৌধুরী

No comments

Powered by Blogger.