ঘুষ কেলেঙ্কারি-রেলমন্ত্রীর পদত্যাগই শ্রেয়

রেলের নিয়োগ বাণিজ্যের ৭০ লাখ টাকা নিয়ে রেলমন্ত্রীকে জড়িয়ে যে নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে তাতে রাজনীতি এখন তোলপাড়। শুধু রাজনীতিই নয়, এ ঘটনায় দেশের সাধারণ মানুষও স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ। সোমবার মধ্যরাতে বিজিবির সদর দফতরে রেলের একটি 'কালো বিড়াল'কে (সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ভাষায়) এপিএসের গাড়ির ড্রাইভার ধরিয়ে দিল।


এরপর চমৎকারিত্বে ভরপুর ঘটনার ঘনঘটা। সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় এই মহা কেলেঙ্কারির বিস্তারিত বর্ণনা পাঠ করে পাঠকের ক্ষুব্ধ মতামত ব্লগ, অনলাইন, ফেসবুক ছেয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের যে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা সাধারণ মানুষের কাছে 'ভালো লোক' বলে গণ্য, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাদেরই একজন। সরকারি দলে থেকেও তার তীক্ষষ্ট শরে তার সতীর্থও প্রায়শই বিদ্ধ হয়েছেন। সেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখন জনতার আদালতে বিচারের কাঠগড়ায়। তার প্রতিই নিক্ষিপ্ত এখন তীক্ষষ্ট শর। তার প্রিয় এপিএস ওমর ফারুক, রেলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা যে গভীর রাতে ৭০ লাখ টাকার একটি বড় বস্তা নিয়ে রেলমন্ত্রীর জিগাতলার বাড়িতে যাচ্ছিলেন, তা নিয়ে আর ধূম্রজাল তৈরি করা যাবে না। ফারুক সেই ৭০ লাখ টাকা নিজ অ্যাকাউন্টে ব্যাংকে জমা করেছেন_ 'এক্সক্লুসিভ' এই খবর গতকালের সমকালের শীর্ষ খবর ছিল। গতকাল সমকালসহ দেশের অধিকাংশ দৈনিকে রেলমন্ত্রীর যে বিশদ বিবরণ ছাপা হয়েছে তাতে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেছেন। পুরো ঘটনার সঙ্গে তিনি 'ষড়যন্ত্রের' গন্ধ পেয়েছেন। এহেন পরিস্থিতিতে নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করবেন কি-না_ এ প্রশ্নের জবাবে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছেন প্রবীণ এই রাজনীতিক। তিনি বরাবরই এ কথা বলার চেষ্টা করেছেন যে, মধ্যরাতে গাড়িভর্তি টাকা তার বাড়ির দিকে যাচ্ছিল না। তাহলে কোথায় যাচ্ছিল? সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এ কথা না জানার কোনো কারণ নেই যে, আর যা-ই হোক শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। তিনি যে 'ষড়যন্ত্রের' কথা বলছেন, তাও খোলাসা করছেন না কেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। তদন্ত কমিটির নামে তিনি যে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করেছেন তাও প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে অচিরেই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত। এত বড় দুর্নীতির ঘটনা_ আশা করি দুদকও এ ক্ষেত্রে তার ভূমিকা পালন করবে। একটি 'কালো বিড়াল'ই নয়_ বহু কালো বিড়ালের কালো ছায়া রেল ভবনে, এতে সন্দেহ নেই। টাকা ছাড়া সরকারি চাকরি নেই_ এ ধ্রুব সত্য কথা সকলেরই জানা। তবে এ ব্যাপারে সব মন্ত্রণালয়কে শত যোজন পেছনে ফেলে যে রেল মন্ত্রণালয় এগিয়ে গেছে তা জিএম ইউসুফ আলী মৃধার আমলনামা পড়েই নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। রেল মন্ত্রণালয়ে রীতিমতো দুর্নীতির হাট বসেছিল। সেই হাটে বহু কালো বিড়ালই পেট ভরে কীভাবে দুধ খাচ্ছিল তার খণ্ড খণ্ড বিবরণ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। এর কিছুই মন্ত্রীর নজরে আসেনি তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় বৈকি। পুরো ঘটনায় সুরঞ্জিত সেন শুধু নিজেই নন, তার দল ও সরকারও চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে_ এ সত্য রেলমন্ত্রী যত দ্রুত অনুধাবন করবেন ততই মঙ্গল। রেলমন্ত্রী প্রধান বিরোধী দল বিএনপির হাতে আরও একটি ইস্যু তুলে দিলেন। বিএনপি নেতৃবৃন্দ তো সুযোগ পেয়ে শুধু রেলমন্ত্রীরই নয়, প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো ক্যাবিনেটেরই পদত্যাগ দাবি করে বলেছেন, এত বড় দুর্নীতির পর এই সরকারের অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত। তবে এ দাবি করার আগে বিএনপিকে তার সরকারের আমলের কথা অনেকেই স্মরণ করিয়ে দিতে চাইবেন। মনে আছে তাদের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একেএম মোশাররফ হোসেনের দুর্নীতির কথা। 'নাইকো' থেকে তিনি একটি মূল্যবান জিপ উপঢৌকন নিয়েছিলেন। কানাডার এক আদালতে নাইকো কর্তৃপক্ষ বলেছে, কাজটি পাওয়ার জন্য তারা জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীকে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছিল। এ খবর প্রকাশিত হলে প্রচণ্ড জনবিক্ষোভের মুখে মোশাররফ হোসেন পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো ক্যাবিনেট তখন পদত্যাগ করেনি। একই প্রেক্ষাপটে যখন তারা পদত্যাগ করেনি, এখন পুরো ক্যাবিনেটের পদত্যাগ দাবির পক্ষে বিএনপি নেতৃবৃন্দ কোনো যুক্তি দেখাতে পারবেন বলে মনে হয় না।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনৈতিক জীবন বর্ণিল, বর্ণাঢ্য। তারপরও আমরা একান্ত বিনয়ের সঙ্গেই বলব, নিজের, দলের ও সরকারের ভাবমূর্তির কথা বিবেচনায় এনে ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে তার পদত্যাগ করাই শ্রেয়। আশা করি, রেলমন্ত্রী এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

No comments

Powered by Blogger.