কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

দিনে দিনে রাজনীতিক হওয়ার সংস্কৃতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। তৃণমূল পর্যায় থেকে কর্মদক্ষতা, ত্যাগ, সাহস, আদর্শ ইত্যাদি বিষয়ে জনসম্পৃক্ততার চরিত্র নিয়ে বড় হয়ে ওঠা রাজনীতিকের সংখ্যা জাতীয় পর্যায়ে এখন কম। জাতীয় নীতিনির্ধারণী রাজনৈতিক নেতৃত্বে এখন হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসার সংখ্যাধিক্য।


সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সামরিক-বেসামরিক অবসরপ্রাপ্ত আমলারা। দ্য ডেইলি সানের ২৭ মার্চ সংখ্যা থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী গত চার দশকে জাতীয় সংসদে সার্বক্ষণিক রাজনীতিকের সংখ্যা দ্রুত কমতে কমতে হাতেগোনা অবস্থায় এসে ঠেকেছে এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে দেওয়া তথ্য মতে বর্তমান নবম জাতীয় সংসদে সার্বক্ষণিক রাজনীতিকের সংখ্যা মাত্র ১২ জন। বাকি সবাই ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা এবং অন্যান্য পেশা থেকে আসা। নির্বাচন কমিশনে প্রদত্ত তথ্য থেকে দ্য ডেইলি সান বর্তমান জাতীয় সংসদে ১৬৯ জন ব্যবসায়ী সংসদ সদস্যের কথা উল্লেখ করেছে, যা অষ্টম সংসদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ডেইলি সান পত্রিকাটি রাজনীতি বিশ্লেষকদের অভিমতের ভিত্তিতে বলেছে, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিনষ্টি এবং ঘন ঘন সামরিক শাসনের হস্তক্ষেপের কারণেই সুযোগ হয়েছে রাজনীতিবহির্ভূত বলবানদের অনুপ্রবেশ। জনগণের স্বার্থের চেয়ে তাঁরা নাকি নিজেদের স্বার্থটাই বড় করে দেখেন এবং 'ক্লাব সংস্কৃতি'র দর্শনে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের কোণঠাসা করে ফেলেছেন। ব্যাপারটা হতাশার। ব্যাপারটা ভয়েরও। আশৈশব জেনে এসেছি, এই ভূখণ্ডের সত্যিকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব উঠে আসে তৃণমূল পর্যায় থেকে। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে আপন স্বার্থ ত্যাগ ও শুভ দর্শনের পথেই গড়ে ওঠে সত্যিকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। বিপদে সবাইকে নিয়ে বুক টান করে দাঁড়ানোর সাহস যার থাকে না তার হাতে জনগণ তাদের অধিকার আদায়ের ভারও তুলে দেয় না। এ ভূখণ্ডের মানুষের কাছে প্রিয় নেতা তিনি, যিনি শত প্রতিকূলতায় সাহসী ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধু এই প্রক্রিয়ায়ই সব সময় নেতা হিসেবে মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন। হয়েছেন অবিসংবাদিত নেতা। এটা সত্য, পদ্মা-মেঘনা-যমুনার কূলে কূলে বেড়ে ওঠা জনপদে মানুষ তাঁকেই নেতা মেনেছে যিনি আত্মত্যাগী ও অসীম সাহসী। যাঁকে তারা দুর্দিনে সব সময় কাছে পেয়েছে। ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের রাজনৈতিক জীবনে অনেকেরই এ পর্যায়টি অনুপস্থিত। হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এ বিষয়টি ফাঁকা থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তৃণমূল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা-প্রত্যাশার অনুভূতি নব্য নেতাদের স্পর্শ করে না। হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধনবান ও বলবানদের কাছে গুরুত্বহীন হলেও শত সহস্র বছরের জীবন এবং সমাজদর্শনে এ ভূখণ্ডে বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শরীরে মাটির গন্ধ মেখে বেড়ে ওঠা সত্যিকারের রাজনীতিকদের সঙ্গে তাদের বিশাল ফারাক। দেশের তৃণমূল মানুষ স্বভাবগতভাবে তাঁকেই নেতা মানতে পছন্দ করে 'যিনি আছেন মাটির কাছাকাছি।' অথবা যিনি তাঁর কর্মকৃতি দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করে বলতে পারেন 'আমি তোমাদেরই লোক।' মানুষ তাঁকে বিশ্বাসও করে। এ দেশের রাজনীতিক হয়ে ওঠার আরেক ভিত্তিভূমি হচ্ছে প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতি। ছাত্রাবস্থায় যে যুবক মিছিলের মুখ হয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊধর্ে্ব তুলে প্রতিবাদী স্লোগান দেয়নি, সে ভীরু, কাপুরুষ। ভীরুর হাতে যে ভুবনের ভার দেওয়া যায় না, সে কথা কবি বলেছেন। বর্তমানকালের নীতিনির্ধারক রাজনীতিকদের অনেকেরই এ অধ্যায়টি অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাই বোধ হয় জাতীয় সমস্যাগুলো রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার চেয়ে আপসে মিটিয়ে ফেলার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ বেশি। দৃষ্টান্ত টানার প্রয়োজন নেই, শুধু এটুকু বলি, এ ক্ষেত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরাও তাদের আপস ফর্মুলায় প্রশ্রয় পায়। এটা দুঃখজনক। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সব অর্জনের আঁতুড়ঘর। একাত্তরে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ছিনিয়ে এনেছি বাঙালি জাতির মুক্তি। আমাদের সব কর্মযজ্ঞে তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্পৃক্ততা অনিবার্য। পাকিস্তানি বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সোনার বাংলা গড়ার কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে স্বাধীনতার অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা ধ্বংস করা শুরু করল আমাদের সব গৌরবের অর্জন। রাজনীতি দখল করল অরাজনীতিকরা, যাদের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্কই ছিল না। সামরিক শাসক জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হলো মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধীরা। দ্য ডেইলি সান অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত জিয়ার কেবিনেটে মন্ত্রী ও উপদেষ্টা হয়েছে ১৯ জন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত বেশ কিছু বাঙালি অফিসার, যাঁরা ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণও করেছিলেন, তাঁরা পুনর্বাসিত হন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে। জিয়ার কেবিনেটে ২১ জন সামরিক ও বেসামরিক আমলার পাশাপাশি ১৮ জন শিল্পপতিও মন্ত্রী অথবা উপদেষ্টা হয়েছিলেন, যাঁদের বিন্দুমাত্র জনসম্পৃক্ততা ছিল না। জিয়ার দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর এরশাদও ক্ষমতায় বসে পূর্ববর্তী শাসকের ধারাকেই অব্যাহত রাখলেন। জিয়া দেশের রাজনীতিকে 'ডিফিকাল্ট' করতে চেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, 'মানি ইজ নো প্রবলেম।' এরশাদ সেই তত্ত্বকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন অনৈতিকভাবে বিত্তবৈভব অর্জনের পথে। জুটেও গেল অনেক লোভী ফেউয়ের দল। কলুষিত হলো রাজনীতি এবং সমাজজীবনের অনেক শুদ্ধধারা। বিনষ্ট হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দর্শন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠল একাত্তরের দালালরা। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে মেধাশূন্য করতে জিয়া-এরশাদের অভিন্ন লক্ষ্যে চালানো হলো ছাত্ররাজনীতিকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করার নোংরা ষড়যন্ত্র। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে অসীম ক্ষমতাধর স্বৈরশাসক এরশাদ সরে গেলে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের সময় ১৫ বছরে সৃষ্ট নষ্ট রাজনীতিকে শুদ্ধ করার চেষ্টা তো হলোই না, বরং অনৈতিকতাকে সর্বক্ষেত্রে প্রশ্রয় দেওয়া হলো। '৯২-৯৩ সালে একটি দৈনিকের নির্বাহী সম্পাদক থাকাকালে এসব নিয়ে একটা উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম। লিখেছিলাম যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দর্শনে ফিরে না গেলে ভবিষ্যতে রাজনীতি আবহমান বাংলার মূলধারা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাবে, যা হবে সমগ্র জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। লিখেছিলাম প্রকৃত রাজনীতিকদের হাতেই রাজনীতির নেতৃত্ব থাকা উচিত। লিখেছিলাম, গণতান্ত্রিক রাজনীতি কোনো বিশেষ প্রকল্প নয়, এটি চলমান প্রক্রিয়া। ঐতিহ্যবিচ্ছিন্ন, শেকড়চ্যুত রাজনীতিচর্চায় দেশ ও মানুষের মঙ্গল হয় না। রাজনীতিক, বিশেষ করে জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারক যাঁরা, তাঁদেরও হতে হবে জনবান্ধব। ভোটের নামে কেবল নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা করলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ক্রমেই দূরতর দ্বীপ হয়ে যাবে।
আজ প্রায় কুড়ি বছর পর আবারও প্রায় একই ধরনের কথাই লিখতে হলো। পেশি ও অর্থে বলবানরা সত্যিকার অর্থে রাজনীতিমনস্ক না হলে কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হবে না। জয় বাংলা।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.