ভাষা ও শিক্ষা-বাঙালির ভাষার লালিত্য বনাম কর্মপ্রবাহ by মোহীত উল আলম

আজকাল প্রায়ই এ কথা শুনি যে বাংলা ভাষার মান রক্ষা করা হচ্ছে না। বিভিন্ন আলোচনা সভায় বক্তারা কয়েকটি এফএম রেডিওসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে শুদ্ধ বাংলার বিকৃত উচ্চারণসহ ইংরেজি শব্দ মেশানোর নানা উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা বলার কায়দার কথাও তাঁরা বলেন।


‘রবি’-কে ‘ড়বি’ উচ্চারণ করছেন, তা আমি নিজের কানে শুনেছি। পুরোপুরি আঞ্চলিক ভাষায় রচিত ধারাবাহিক নাটক পরিবেশিত হতেও কতিপয় চ্যানেলে দেখছি। লিখিত বাংলায় আঞ্চলিকতাদুষ্ট বাংলার ব্যবহার কম হলেও কথ্য বাংলায় আঞ্চলিকতার প্রাধান্য আগের চেয়ে বহু পরিমাণে বেড়ে গেছে। একান্ত আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্র ছাড়া কেউ আর শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলেন মনে হয় না। অর্থাৎ, যে বাংলা ভাষার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি করেছি, সে দেশে এখন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষিত হচ্ছে না। তার ফলে বাংলা ভাষা ব্যবহারের আদর্শগত অবস্থানের সঙ্গে বাস্তব অবস্থানের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সমস্যাটি নিয়ে আলোকপাত করতেই এ লেখা।
প্রথমে একটা মিথ বা প্রচলিত ধারণা ভাঙা দরকার। অমর একুশের ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত বাংলা ভাষার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হলেও এটার অর্থ এ ছিল না যে দেশের সব লোক শুদ্ধ বাংলায় লিখবে বা কথা বলবে। বরং এ ছিল যে বাঙালিমাত্রই ইচ্ছে করলে রাষ্ট্রীয় কাজে তার মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতে বা লিখতে পারবে। কিন্তু সে শুদ্ধভাবে লিখতে বা বলতে পারছে কি না, সে তাগিদ ভাষা আন্দোলনের কর্মচেতনায় ছিল না। নিজ মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকার বা স্বাধীনতা অর্জন একটি রাজনৈতিক সাফল্য, কিন্তু মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, সেটা যতটা না রাজনৈতিক প্রশ্ন, তার চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রশ্ন। কাজেই এখনকার বাংলা ভাষার ভ্রষ্ট ব্যবহারের পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে অমর একুশের ভাষাগত অধিকার আদায়ের চেতনা বা বাংলাদেশের সৃষ্টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে মনে করলে ভুল হবে। কিংবা পয়লা বৈশাখের গুরুত্বও সংকটে পড়েছে ভাবলে ভুল হবে।
ভাষার ভুল ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনীতি ও সমাজ কীভাবে জড়িত সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি। আমাদের সময়, অর্থাৎ ষাটের দশকে স্কুলের বেলায় সব শিক্ষার্থী মোটামুটি জানত যে নিত্য বর্তমান কালে ইংরেজিতে ‘হি গৌজ’, ‘করিম গৌজ’ এবং ‘আই গো’ হয়। এটা ছিল প্রায় সাধারণ জ্ঞান। সবাই জানত। কিন্তু শিক্ষকতায় ঢুকে গত তিন দশকের অভিজ্ঞতায় দেখছি যে যত সাম্প্রতিক সময়ে আসছি, ততই তেমন শিক্ষার্থী পাচ্ছি, যারা ‘হি গো’ এবং ‘করিম গো’ লিখছে। ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের এ সামান্য জ্ঞানের বিলোপের কারণ বহুবিধ।
কিন্তু যে কারণটি মৌলিক, সেটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। এবং এটি শুধু ইংরেজি বলে কথা নয়, বাংলার ক্ষেত্রে এবং সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রেও শিক্ষার মানের সঙ্গে জনসংখ্যার বৃদ্ধি বা হ্রাসের সম্পর্ক আছে। অর্থনীতির আলোচনায় প্রায় গর্হিত অর্থনীতিবিদ টমাস ম্যালথাস সব অর্থনৈতিক সমস্যার মূলে জনসংখ্যার সম্বন্ধটা খুঁজে পেতেন। যদিও আমরা জানি যে লোকসংখ্যা সমস্যা নয় কোনো দেশের জন্য, সমস্যা হলো লোকসংখ্যাকে শিক্ষাব্যবস্থা ও উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে না পারা। তবু বলব, ম্যালথাসের ধারণার সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ও জনসংখ্যার সম্পর্কের বিষয়টা মেলে। প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান প্রায় এক দশক আগে বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি মা-ই চান, তাঁর ছেলে বা মেয়ে এমএ পাস করুক। শিক্ষা গ্রহণের এ বর্ধিত আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে চাকরির সম্পর্ক আছে। কিন্তু ম্যালথাসের সূত্র অনুযায়ী বলতে হয়, বাংলাদেশের জনসংখ্যা যে হারে বেড়েছে সে হারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বইপত্র ও শিক্ষক বাড়েনি। ফলে যে শ্রেণীকক্ষে ৩০ জন শিক্ষার্থী থাকার কথা, সে শ্রেণীকক্ষে ৫০ জনের অধিক শিক্ষার্থী ঢুকে পড়ছে। পাঠাগার থাকে অব্যবহূত। শুদ্ধ বাংলায় লেখা বা বলা শুদ্ধভাবে শেখানো তো দূরের কথা, সাধারণভাবে শিক্ষা গ্রহণও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মফস্বল অঞ্চলের ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি চালু আছে এমন কিছু কলেজের ইংরেজির শিক্ষকেরা আমাকে বলেছেন, এক এক সেকশনে তাঁদের দুই শ থেকে আড়াই শ শিক্ষার্থী পড়াতে হয়।
শিক্ষাব্যবস্থার অপ্রতুলতার সঙ্গে উল্টো দিক থেকে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে অর্থনৈতিক প্রবাহের জোয়ার। যখন আমরা শিক্ষাজীবন কাটিয়েছিলাম, ষাট এবং সত্তরের দশকে, তখন কর্মক্ষেত্র ছিল সংকুচিত। সে জন্য লেখাপড়ার ক্ষেত্রে উন্নতি করা ছাড়া ডিগ্রি লাভ এবং প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্রে ঢোকার অবকাশ ছিল না। সে জন্য তখন ধৈর্য ধরে বাংলা ও ইংরেজি শব্দ, উচ্চারণ, বানান, বাক্য গঠন শেখা—এসব দক্ষতা অর্জনের সঙ্গে ভবিষ্যতের কর্মজীবনের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে লোকসংখ্যা খুব দ্রুত বেড়েছে এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বেসরকারি খাতে পুঁজির বিনিয়োগ। আগে চাকরির জগৎ ছিল সীমিত, কিন্তু এখন হয়েছে বহুবিধ এবং সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান না বাড়লেও পরিমাণ বেড়েছে। আগে প্রকৌশলী হলে ধরে নেওয়া হতো বুয়েট থেকে পাস, কিন্তু এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও প্রকৌশলী তৈরি করছে এবং তারা চাকরিও পাচ্ছে। সে রকম চিকিৎসকও বের হচ্ছে বেসরকারি চিকিৎসা কলেজ থেকে। বেসরকারি খাতে শিক্ষাব্যবস্থা সম্প্রসারিত হওয়ায় শিক্ষার চাহিদা বেড়েছে এবং ডিগ্রিও আগের চেয়ে সহজলভ্য হয়েছে।
গুণ ও পরিমাণের মধ্যে যখন বিরোধ তৈরি হয়, তখন দ্বিতীয়টি অবশ্যই প্রথমটিকে পরাজিত করবে। এটিই সামাজিক বৈশিষ্ট্য। সব সমাজেই। আর গুণের ব্যাপারে যে আপসরফা তৈরি হচ্ছে তার কারণটি হলো বেসরকারি খাতে বৈধ ও অবৈধভাবে লাগামহীন পুঁজি বিকাশের ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি যানমাধ্যম এবং বেসরকারি গণমাধ্যম (পত্রপত্রিকা ও টিভি) ইত্যাদি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ আরও কিছু অনির্ধারিত প্রতিষ্ঠান (যেমন এমএলএম) গড়ে উঠেছে, যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবশ্রেণী যেমন নিয়োগ পাচ্ছে, তেমনি পাচ্ছে অপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও। জনসেবামূলক প্রচারধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডে সংস্কৃতিসংলগ্ন থাকার একটি প্রয়োজনীয়তা থাকেই, যেটি আবার মূল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোতে থাকে না। যেমন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে একজন চাকরিপ্রাপ্ত নবীন যুবক কীভাবে খবর পড়ল বা এফএম বেতারে রেডিও জকি কীভাবে বাংলা বলছে, সেটা জাতীয়ভাবে চিন্তার একটি অংশ হয়ে যায় এবং এর পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত তৈরি হয়। কিন্তু মৌলিক উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলোতে যেমন কৃষিক্ষেত্র, কলকারখানা, ইটের ভাটা, অর্থাৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলোতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাষা শুদ্ধভাবে বলার বা লেখার চেয়েও প্রয়োজন পড়ে ভাষার মাধ্যমে কাজ চালিয়ে নেওয়ার। সেখানে ভাষার লালিত্যের প্রশ্নটি থাকে গৌণ। কিন্তু এ বিষয়টি জাতীয়ভাবে আমাদের চেতনায় থাকে না।
আরেকটি বিষয় হলো, বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার ধীরগতির সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের দ্রুত বিকাশের মধ্যে একটি ফাঁক তৈরি হয়েছে। ভালো উচ্চারণ, ভালো ভাষা জ্ঞানসম্পন্ন তরুণ চাকরিজীবীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত এবং ক্রমবিকাশমান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বসে নেই। তারা ব্যবসা খুলেছে, তাদের আশু প্রয়োজনে লোক দরকার। এ জন্য সেবা ও বিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহু প্রশিক্ষণহীন বা অল্প মেধার তরুণ-তরুণীরা চাকরি পাচ্ছে। স্বাভাবিক কারণে এ উঠতি তরুণ চাকরিজীবী শ্রেণী চাকরির সহজলভ্যতার কারণে ভাষার যত্ন বা লালিত্যের ব্যাপারে মনোযোগী হতে আর সময় ব্যয় করে না। অর্থাৎ, যে প্রমিত ভাষা আগে ছিল প্রতিযোগিতা করার একটি মাপকাঠি, সে ব্যাপারে এখনকার প্রজন্মকে আর সজাগ হতে হয় না।
ফলে বাংলাদেশে এখন যে পরিমাণ কর্মপ্রবাহ চলছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সে পরিমাণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হয়নি। উপরন্তু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্ররাজনীতিতে বিপুলভাবে রাজনৈতিকীকরণ ও সন্ত্রাসের অস্তিত্ব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মক্ষেত্রের ফিডিং সেন্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না।
আরেকটি ব্যাপারও আছে, ভালোভাবে বলতে পারা এবং লিখতে পারা শিক্ষার মৌলিক একটি উদ্দেশ্য বটে, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এ দক্ষতাকে ছাড়িয়ে যায় এমন সব গুণের মধ্যে আছে বিষয়ের প্রতি ঝোঁক ও বিষয়ের ওপর দক্ষতা ও বুঝ, অবিরাম নিষ্ঠা, মানবিক বোধ ও দেশপ্রেম। এখনকার বাংলাদেশ ও শুরুর বাংলাদেশের মধ্যে চরিত্রগত তফাত আছে। যখন বাংলাদেশের উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলো খোলেনি এবং খুললেও বিকশিত হয়নি, যখন আমাদের সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পারতাম না, তখন আমাদের ক্ষেত্রগুলো পরিচালিত হতো বিদেশি শিক্ষার ভাবধারায় লালিত কিছু তাত্ত্বিক জ্ঞানসম্পন্ন পেশাজীবীর দ্বারা। কিন্তু দেশটাকে উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যতই আমরা চিনতে পারছি, ততই এ সত্যটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে প্রমিত ভাষায় লিখতে এবং বলতে পারার চেয়েও দরকার হলো শস্যখেতে ঢ্যাঁড়স ও শিম যে হচ্ছে, সেটা কোন মৌসুমে, কীভাবে হয়, সে জ্ঞান। যে এ ক্ষেত্রে কাজ করছে, তার কাছে ভাষার ব্যবহারের সৌন্দর্য অমূলক, উৎপাদনজাত জ্ঞানটাই বেশি প্রয়োজনীয়।
তাই মনে হয়, ভাষার লালিত্য রক্ষা নিয়ে উদ্বেগ এবং চিন্তা আসলে একটি শ্রেণীবদ্ধ চিন্তা, হয়তো শিক্ষিত পেশাজীবী সংস্কৃতিমনা নগরকেন্দ্রিক একটি মহলের এটি বিশেষ শিরঃপীড়ার কারণ হতে পারে, কিন্তু দেশব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মপ্রেরণা ও প্রবাহের মুখে এটি একটি পোশাকি চিন্তা বলে প্রতীয়মান হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো আস্ফাালন-ভারাক্রান্ত এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শিক্ষাব্যবস্থা আরও মৌলিকভাবে বহুবিস্তৃত, স্বচ্ছ, প্রায়োগিক ও ফলবান না হলে চাকরির জগতে গুণের ক্ষেত্রে আপস করতেই হবে, ফলে ভাষার মান রাখাও সম্ভব হবে না।
 ড. মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি, ইউল্যাব, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.