রমনা বটমূলে বোমা হামলা-১১ বছর কাটল তবু বিচার হলো না by আশরাফ-উল-আলম

রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার আরো একটি বছর পার হচ্ছে আজ। ১১ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই নৃশংস ঘটনার বিচার এখনো শেষ হয়নি। রাষ্ট্রের ব্যর্থতা এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
২০০১ সালের পহেলা বৈশাখ রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলাটির


বিচার চলছে। একই ঘটনায় বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলার বিচার নিয়ে গত তিন বছরেও সুপ্রিম কোর্টের মতামত না পাওয়ায় থেমে আছে ওই মামলার বিচার কার্যক্রম।
প্রতিবার বৈশাখ এলেই সংবাদকর্মীদের দৌড়ঝাঁপে রাষ্ট্রপক্ষের সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা দুটি মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে আশার বাণী শোনালেও কার্যত তা আর হয় না। সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব না দেওয়ায় এক এক করে ১১টি বছর পার হয়ে গেছে। এবারও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, অন্তত হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে শেষ হবে।
ঢাকা মহানগর দায়রা আদালতের সরকারি কেঁৗসুলি (পিপি) আবদুল্লাহ আবু বলেন, হত্যা মামলায় ৮৪ জন সাক্ষীর মধ্যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৫২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। আরো কয়েকজন প্রয়োজনীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলেই বিচারকাজ শেষের দিকে যাবে। আশা করা যায়, আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে বিচারকাজ শেষ হবে। তবে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশের অপেক্ষায় থাকার কারণে বিস্ফোরক মামলার বিচারকাজ থেমে আছে। বিস্ফোরক মামলাও দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
বর্তমান সরকারের মেয়াদ তিন বছর পার হলেও এমন একটি লোমহর্ষক ঘটনার বিচার শেষ হয়নি। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। অথচ এই আদালতের বিচারক নেই গত সাত-আট মাস ধরে। মামলার সাক্ষীরা বারবার আদালতে এসেও ফিরে যাচ্ছেন বিচারক না থাকায়। এই আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক মামলার বিচার শেষ করার ইচ্ছা পোষণ করলেও আসামিদের কারা কর্তৃপক্ষ আদালতে হাজির না করার কারণেও মামলার শুনানি বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, এই মামলায় মুফতি হান্নানসহ আসামিরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সদস্য ও নেতা। তাদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় মামলা রয়েছে। ওই সব আদালতে আসামিদের পাঠিয়ে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। রমনা বটমূলের মামলাকে গুরুত্ব না দিয়ে আসামিদের অন্য আদালতে পাঠানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার একজন আসামিকে চট্টগ্রামের একটি আদালতে পাঠানোর কারণে ঢাকার আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ আইনের বিধানমতে কারাগারে থাকা আসামির অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য নেওয়া যায় না।
হত্যা মামলার তদারককারী ওই আদালতের অতিরিক্ত পিপি এস এম জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই মামলা নিষ্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষ যথেষ্ট আন্তরিক। নিয়মিত সাক্ষী হাজির হচ্ছেন। কিন্তু এই আদালতের বিচারক না থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার আসামিদের প্রায়ই বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। এ কারণেও ভারপ্রাপ্ত বিচারকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না।'
অতিরিক্ত পিপি আরো বলেন, এমন একটি চাঞ্চল্যকর মামলা যে আদালতে বিচারাধীন সেই আদালতের বিচারক সাত-আট মাস যাবৎ নেই। আগের বিচারক বদলি হওয়ার কারণে এই আদালতের বিচারকের পদ শূন্য বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই আদালতে সাড়ে ছয় হাজার মামলার বিচার ঝুলে আছে। তিনি আরো বলেন, বিচারক থাকলে এবারের পহেলা বৈশাখের আগেই হত্যা মামলাটি নিষ্পত্তি হতো। তিনি জানান, এ পর্যন্ত যে সব সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে তাতে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণ হবে বলে তিনি আশা করেন। তিনি এ-ও আশা করেন, এ মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।
২০০১ সালের পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ ব্যক্তি নিহত হন। আহত হন অনেকে। এ ঘটনায় রমনা থানায় মামলা হয়। একটি হত্যা মামলা এবং অপরটি বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলা। সাত বছরেরও বেশি সময় মামলার তদন্ত হয়। ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর একই সঙ্গে মামলা দুটির অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়। বিচারের জন্য মামলা দুটি ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়। ওই আদালতে একই বছরের ১৬ এপ্রিল পৃথকভাবে মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এ এবং বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঠানো হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার শেষ করতে না পারলে মামলা দায়রা আদালতে ফেরত যাবে এবং পরে সেটাই হয়। হত্যা মামলাটি আবার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা আদালতে স্থানান্তর হয়।
হত্যা মামলায় মুফতি আবদুল হান্নান, চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা মো. তাজউদ্দিনসহ ১৪ জনকে আসামি করা হয়। অপর আসামিরা হলেন আরিফ হাসান সুমন, শাহাদত উল্লাহ জুয়েল, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মুফতি মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা আকবর হোসেন ওরফে হেলাল উদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, শেখ ফরিদ ওরফে মাওলানা শওকত ওসমান, মুফতি শফিকুর রহমান, মাওলানা আবদুল হান্নান সাবি্বর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া ও মুফতি আবদুল হাই ওরফে আবু নাঈম।
বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলায়ও ওই ১৪ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেওয়া হয়। হত্যা মামলায় যে ৮৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে, বিস্ফোরকের মামলায়ও তাদেরই সাক্ষী দেখানো হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হত্যা মামলার চার্জশিটের সঙ্গে প্রমাণ হিসেবে আদালতে যে আলামত দাখিল করেন, সেই আলামত বিস্ফোরক মামলায়ও দেখানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ দুটি মামলায় জব্দ তালিকা, সূচি ও মানচিত্র অভিন্ন।
বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলা : বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় কয়েকজনের সাক্ষ্যগ্রহণের পরই মামলার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন অবস্থায় ২০০৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক মাসদার হোসেন মন্তব্য করেন, উভয় মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা, আসামির সংখ্যা, মামলার জব্দ তালিকা ও আলামতগুলো অভিন্ন হওয়ায় উভয় মামলা পাশাপাশি রেখে একই আদালতে বিচার করা আবশ্যক। এরপর ওই বিচারক তাঁর মতামত দিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি আবেদন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠান। এখন পর্যন্ত রেজিস্ট্রারের দপ্তর থেকে ওই আবেদনের সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট আদালতে পেঁৗছেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.