চারদিক-হাওরজলে পাখির খোঁজ by গাজী মুনছুর আজিজ

এখলাছ মিয়া, বয়স প্রায় ৫০। জন্ম হাওর অঞ্চলের গ্রাম বাদে দেউলিতে। পড়াশোনার দৌড় সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। ছোটবেলাতেই বাবাকে হারান। তাই সংসার চালাতে বাবার দায়িত্ব নেন নিজের কাঁধে। বইখাতা রেখে হাতে নেন লাঙল-জোয়াল। শুরু করেন হাওরে নতুন অধ্যায়। সারা দিন বিশাল হাওরে কৃষিকাজ আর মাছ ধরেই কাটে তাঁর।


তখন থেকেই ভালো লাগে হাওরের প্রকৃতি। আর বেশি ভালো লাগে শীতকালে হাওরে আসা নানা রঙের ছোট-বড় পাখির ঝাঁক। এসব দেখতে দেখতেই প্রেমে পড়ে যান হাওরের পাখি ও প্রকৃতির। তাই হাওরে কেউ পাখি শিকার করলে কিংবা হাওরের প্রকৃতির কোনো ক্ষতি করলে তার প্রতিবাদ করতেন তখন থেকেই। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন হাওরদরদি।
এই হাওরদরদিকে সঙ্গে নিয়েই হাওরে পাখির খোঁজ করেছি সারা দিন। সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি ও বিশ্বব্যাপী পাখি নিয়ে গবেষণাকারী ওয়েটল্যান্ডস ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া অঞ্চলের সংগঠন এশিয়ান ওয়াটার বার্ড সেনসাসের বাংলাদেশের জাতীয় সমন্বয়ক ইনাম আল হক। প্রতিবছরের মতো এবার তাঁর নেতৃত্ব্বেই গত ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি সিলেটের হাকালুকি হাওরে জলচর পাখির শুমারি হয়ে গেল। সমন্বিত রক্ষিত এলাকা সহব্যবস্থাপনা (আইপ্যাক) প্রকল্পের আয়োজনে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের একদল পাখি পর্যবেক্ষক এই পাখিশুমারি করেছেন।
ঢাকা থেকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে আমরা মাইক্রোবাসে রওনা হই মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার উদ্দেশে। বিকেলে পৌঁছাই কুলাউড়ার গোবিন্দপুর কাজলধারা সিআরপির রেস্টহাউসে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এই রেস্টহাউসের চারপাশেই বন। রেস্টহাউসে উঠেই দলনেতা ইনাম আল হক সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বনের পাখি দেখার জন্য। কয়েক প্রজাতির পেঁচাসহ কিছু পাখির ডাক শুনে এবং কিছু পাখি দেখে সন্ধ্যায় সবাই এক হলাম রেস্টহাউসে। চা খেতে খেতে দলনেতা সবাইকে জানিয়ে দিলেন আগামী তিন দিনের কর্মসূচি ও শুমারির নানা তথ্য।
১৯ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ছয়টায় আমরা দুটি দলে ভাগ হয়ে রওনা হই হাওরপারের দিকে। আমরা বড়লেখার কানোনগো বাজার হয়ে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে প্রবেশ করি হাকালুকি হাওরে। পথেই হাওরপারের বাসিন্দা জামাল আমাদের সফরসঙ্গী হন। তিনি আমাদের হাওরের পথপ্রদর্শক। সারা দিন হেঁটে বিভিন্ন হাওর ও বিলে গিয়ে টেলিস্কোপ ও দুরবিন দিয়ে আমরা পাখি গুনি এবং সেসব পাখির নাম, প্রজাতি ও স্থানের জিপিএস মান খাতায় লিখে রাখি। এভাবে আমরা এক বিল থেকে আরেক বিলে যাওয়ার জন্য হেঁটেছি প্রায় ১০ কিলোমিটার। কখনো ছোট নৌকায় খাল পার হয়েছি। প্রথম দিন হাকালুকির জলাবিল, বালুজুড়ি, মাইসলা, কুকুরডুবি, ফুয়ালা, পোলাভাঙ্গা, হাওরখাল, কোয়ার কোনা ও মালাম বিলে পাখি দেখি। সন্ধ্যায় ফিরি রেস্টহাউসে।
পরের দিন ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ছয়টায় রওনা হই। আমরা এবার যাই হাকালুকির অন্য পাশে। আজ আমাদের পথপ্রদর্শক এখলাছ মিয়া। তিনি বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সঙ্গে সাত বছর ধরে হাওরে পাখি দেখার কাজ করে আসছেন। তাই হাওরের প্রায় সব পাখির নাম তিনি জানেন। বলা যায়, হাওরের পাখিপ্রেমী। এই দিন আমরা পাখি দেখি হাকালুকির গোয়ালজুড়, চাড়ুয়া, তেকোনা, ভাইয়া, হাওরখাল, গজুয়া, রঞ্চি, হারাম ও বিড়ালখাল বিলে। সন্ধ্যায় ফিরি রেস্টহাউসে।
সব মিলিয়ে এবার হাকালুকি হাওরের প্রায় ৩০টি বিলে ৬১টি প্রজাতির ৬৪ হাজার ২৮২টি পাখির দেখা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের জন্য নতুন একটি পাখির সন্ধানও পেয়েছি আমরা। নতুন এই পাখির নাম ‘ছোট ধলাকপাল রাজহাঁস’। শুমারির প্রথম দিন পল থমসন নামা তুরোল বিলে পাখিটি দেখেছেন।
এ ছাড়া শুমারিতে দেখা অন্য পাখির মধ্যে রয়েছে: ছোট ডুবুরি, বড় খোঁপাডুবুরি, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, উদয়ী গয়ার, দেশি কানিবক, ধুপনি বক, লালচে বক, বড়বগা, ছোটবগা, মাঝলাবগা, গোবগা, এশীয় শামখোল, কালামাথা কাস্তেচরা, পাতি সরালি, মেটে রাজহাঁস, খয়রা চখা-চখি, পাতি চখা-চখি, তিলিহাঁস, পিয়াং হাঁস, সিঁথিহাঁস, ফুলুরিহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, উত্তুরে খুন্তেহাঁস, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস, গিরিয়া হাঁস, পাতি ভুতিহাঁস, বেয়ারের ভুতিহাঁস, টিকি হাঁস, মরচেরং ভুতিহাঁস, কোড়া, ধলাবুক ডাহুক, পাতি মানমুরগি, বেগুনি কালেম, পাতি কুট, নেউ পিপি, দল পিপি, কালাপাখ ঠেঙ্গি, মেটেমাথা টিটি, হট টিটি, উত্তুরে টিটি, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, ছোট নথজিরিয়া, কেন্টিশ জিরিয়া, ছোট ধুলজিরিয়া, ছোট বাবু বাটান, পাতি চ্যাগা, ল্যাঞ্জা চ্যাগা, কালালেজ জৌরালি, তিলা লালপা, পাতি লালপা, পাতি সবুজপা, বিল বাটান, বন বাটান, পাতি বাটান, লালনুড়ি বাটান, গুলিন্দা বাটান, ছোট চাপাখি, টেমিকেংর চাপাখি, খয়রামাথা গাঙচিল ও কালামাথা গাঙচিল।
দুই দিনে জলচর পাখি দেখে ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রবেশ করি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। সারা দিন বনের পাখি দেখে শ্রীমঙ্গলের কুটুমবাড়ি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা হই ঢাকার উদ্দেশে।
শুমারির দলনেতা ইনাম আল হক জানান, এবারের শুমারির নতুন পাখিসহ বাংলাদেশের পাখির তালিকা দাঁড়ালো ৬৫৪টিতে। ২০০৯ সালের আগস্টে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের পাখিবিষয়ক খণ্ডে বাংলাদেশের পাখির তালিকা দেওয়া ছিল ৬৫০টি। এর মধ্যে ৩৫০টি আবাসিক ও ৩০০টি পরিযায়ী। এরপর আরও চারটি পাখির সন্ধান পাওয়া গেছে। ফলে এখন বাংলাদেশে পাখির প্রজাতির সংখ্যা হলো ৬৫৪।

No comments

Powered by Blogger.