তরুণের জয়গান-অন্য যুগের ভোরে by সাজ্জাদ শরিফ

আমরা যারা শহরে থাকি, তারা কি ঋতুর পরিবর্তন টের পাই? বছরের দুয়েকটা সময় যে টের পাই না, তা অবশ্য নয়। শীত এলে বছর ধরে তুলে রাখা গরম কাপড়গুলো বের হতে থাকে বাক্স-পেটরা থেকে। লেপ, কাঁথা, কম্বল নতুন করে রোদ পোয়াতে শুরু করে। আর যে ঋতুটিকে টের না পেয়ে উপায় থাকে না, সে হলো বর্ষা।


বর্ষা আসে ছোটদের জন্য আনন্দ হয়ে। স্কুল বাদ দাও, বৃষ্টিতে ভেজো। আর যদি মায়ের মন-মেজাজ ভালো থাকে, তা হলে খিচুড়িও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অঝোর বৃষ্টি বড়দের জন্য আসে আপদ হয়ে। পথে তখন গাড়ি-ঘোড়াও বিশেষ থাকে না। থাকলেও ভাড়া হাঁকে দশ গুণ। বৃষ্টি-কাদা ঠেঙিয়ে এর মধ্যেই কাজে ছোটো।
এইটুকুর বাইরে নগরজীবনে ঋতু কোথায়?
গ্রামের চিত্রও দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। বাঙালির ঋতুর অবসরকালীন ছুটি আসন্নপ্রায়। কেবল যাঁদের জীবিকা কৃষিনির্ভর, এখনো তাঁদের সক্রিয় যোগ রয়ে গেছে ঋতুচক্রের সঙ্গে। ফসলের জীবনের সঙ্গে জড়ানো তাঁদের জীবন। তাঁরা বোঝেন হাওয়া কোন দিক থেকে বইলে তার মানে কী? কখন ঘটছে ঋতুর অবসান। কখনই বা জেগে উঠছে নতুন কোনো ঋতু। কারণ তারই চক্রে বাঁধা তাঁর ফসলের উন্মেষ আর পরিপক্বতা। ঋতুর চাকায় বাঁধা বলে তাঁদের সময় বৃত্তাকার। বছর শেষে পুরো সময়চক্র আবার ফিরে আসে। আমাদের শহুরে জীবনে সময় চলে সরলরেখায়।
আমাদের সবার এই সরল জীবন বেঁকে যায় শুধু একটি সময়ে। পয়লা বৈশাখে। পয়লা বৈশাখ আসে নতুন বছরের বার্তা সশব্দে ঘোষণা করে। ধীরে ধীরে এই দিনটি হয়ে উঠেছে ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালির সবচেয়ে বড় উদ্যাপনের ক্ষণ।
গ্রামবাংলায় উদ্যাপনের সময় হিসেবে চৈত্রই ছিল প্রধান। বছরের শেষ দিনে তেতো খাবার খেয়ে শরীর শুদ্ধ করো। নির্মল চিত্তে প্রস্তুত হও নতুন বছরে নতুনতর জীবনে প্রবেশ করার জন্য। বৈশাখ আমাদের প্রত্যক্ষে এসেছে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের হাত ধরে। ষাটের দশকে পাকিস্তান যুগের বাঙালিবিরোধী আবহাওয়া রমনার বটমূলে বৈশাখযাপন ছিল বাঙালি হিসেবে নিজের আত্মঘোষণার অনুষ্ঠান। এর পরে বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটল পয়লা বৈশাখের।
কী সেই উত্থানের মানে? মানুষ যেখানে অনন্য, তার সেই আত্মপরিচয়। গতানুগতিকের বাইরে উঠে দাঁড়িয়েছে মানুষের সৃষ্টিশীলতার যে নবতর ইশারা, তাকে গ্রহণ করা। ঠিক এই জায়গাটিতে বাংলার কবিদের বৈশাখবন্দনা এখনো বাতিল হয়ে যায়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বলেছেন, ‘হূদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে,/বেড়া ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে।’ বা কাজী নজরুল ইসলাম, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর,/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়।’ বৈশাখ যেন বাঙালির সেই নবীন উত্থানেরই প্রতীক। পুরোনো থেকে ইতিহাস ও মানবপ্রবাহের ভবিষ্যৎযাত্রা।
বৈশাখে তাই আমরা অভিষিক্ত করি আমাদের সৃষ্টিশীল নবীনদের। তাদের সৃষ্টিশীল অগ্রযাত্রাই এ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের স্বপ্ন জাগিয়ে রাখে। কত না দিকে এখন ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের তরুণেরা। বাড়িয়ে চলেছে আমাদের সম্ভাবনার কত না অজানা দিগন্ত। কেউ জয় করেছেন শারীরিক সীমাবদ্ধতা, কেউ জয় করেছেন পর্বত। কেউ উদ্যোক্তা, কেউ ক্রীড়াবিদ। কেউ উন্মোচন করছেন অ্যানিমেশনের নতুন জগৎ, নাট্যচর্চার মধ্য দিয়ে কেউ সঞ্জীবিত করছেন একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মন। ক্রিকেটে যখন আমরা অপেক্ষা করছি ধারাবাহিক সফলতা দেখানো একজন খেলোয়াড়ের, নাসির হোসেন তখনই এলেন ক্রীড়ামোদীদের চিত্ত জয় করে। বিপিএলে সবচেয়ে দামি বাংলাদেশি খেলোয়াড় হয়ে চমকে দিলেন সবাইকে। নারী ক্রিকেটকে উজ্জীবিত করে তুললেন জাতীয় দলের কনিষ্ঠতম সদস্য খাদিজাতুল কুবরা। দুজন তরুণের পর শিখরজয়ী নারী হিসেবে ওয়াসফিয়া নাজরীনকে অতি দ্রুতই আমরা পেয়ে গেলাম। কিলিমানজারো ও অ্যাকোনকাগুয়া পর্বত জয় করেছেন তিনি। স্বপ্ন এখন এভারেস্টকে পদানত করা। মণিপুরি তরুণ শুভাশিস সিনহা ঢাকায় পড়াশোনা শেষ করে ফিরে গেছেন শ্রীমঙ্গলে তাঁর নিজের সম্প্রদায়ে। গড়ে তুলেছেন থিয়েটার গোষ্ঠী, নিজেদের নাট্যমঞ্চ ও নাট্য আন্দোলন। আনিসুল হক চৌধুরী-সামিহা আলম দম্পতি উদ্যোক্তা ইকো-ট্যুরিজমের ধারণায় কক্সবাজার-ভ্রমণকে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে। নানা পুরস্কার জিতে এবং একের পর এক জনপ্রিয় টিভিনাটক বানিয়ে সবার চোখ কেড়েছেন ইফতেখার আহমেদ।
এঁদের চোখ বাংলাদেশের সুদূর ভবিষ্যতে প্রসারিত। বাংলাদেশের আগামী দিনের পথ গড়ে উঠবে এঁদেরই মতো আরও বহু স্বপ্নবান তরুণের অধ্যবসায়ে।
মনে পড়ছে ফেদেরিকো ফেলিনির স্যাটায়ারিকন সিনেমাটির শেষ দৃশ্যটির কথা। সমুদ্রের মাঝখানে এক দেশ। মারা গেছেন সে দেশের রাজা। মরার আগে একটি অদ্ভুত উইল করে গেছেন তিনি। লিখে গেছেন, যারা তার মৃতদেহের মাংস খাবে, তারা হবে তার সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী। আর যারা তা খাবে না, তারা তার সম্পদের কানাকড়িও পাবে না। তবে একটি জিনিস পাবে। পাবে এই দ্বীপরাজ্য ছেড়ে যাওয়ার অধিকার। ছবির শেষে আমরা দেখি, রাজ্যের সব অশীতিপর বৃদ্ধেরা রাজসম্পদের আশায় রাজার মাংস খুবলে খুবলে খাচ্ছে। কিন্তু তরুণেরা বেরিয়ে পড়ছে পথে। সমুদ্রের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বাতাসে পাল উড়িয়ে তারা যাবে নতুন কোনো দেশে। তরুণের এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রাকে শুধু নতুন বছরে নয়, স্বাগত জানাই নতুন যুগের ভোরে ।

No comments

Powered by Blogger.