দাহকালের কথা-মুক্তি by মাহমুদুজ্জামান বাবু

‘কৃষ্ণকলি’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখের যতই লাবণ্যমাখা বর্ণনা দেন না কেন, কালো ত্বকের যাতনা আমাদের পশ্চাৎপদ সামাজিক মনকে অবশেষে ব্যথিতই করে। গাঁয়ের লোকের নানা রকমের অকথা-কুকথা রবীন্দ্রনাথকেও ব্যথিত করেছিল, তাই বুঝি তিনি কালো মেয়ের পক্ষ নিয়ে লিখলেন, ‘আর যা বলে বলুক অন্য লোক’।...


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ১৩০৭ সালের শ্রাবণে। ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতাটিও সেখানেই অন্তর্ভুক্ত। এখন বাংলা ১৪১৭, ফাল্গুন। ইতিমধ্যে মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়েছে ১১০ বছর। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় নব নব আবিষ্কার, মানবসভ্যতার নানামুখী বিস্তার, গ্রাম ভেঙে শহুরে কোলাহল, সংস্কৃতির মঙ্গল শোভাযাত্রা ঝলমল করে উঠছে পরম্পরায়। মানুষ চাঁদে পা রেখেছে, এখন মঙ্গল, বুধ, শুক্রসহ তাবত গ্রহ ঘিরে তার বিজয়বাসনা, তারও আগে মহাশূন্যে উড়ে উড়ে চক্রাকারে ঘুরে আসা হয়েছে পৃথিবীকে। তবু, শুধু কালো ত্বকের কারণে ‘কৃষ্ণকলি’র মনোযাতনার শেষ হলো না। মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটল না ঘরে, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে। বিকাশ ঘটল কালো ত্বক ‘ফরসা’ করার ক্রিম কোম্পানির। আগে, মায়েরা হলুদ বেটে দিতেন শিল নোড়ায়, কালো মেয়ে তা মুখে মাখত সযত্নে—ও ছিল অন্তঃপুরের কাহিনি, লুকানো। এখন তা প্রকাশ্য। কালো মেয়ে সেদিন মায়ের মমতার আড়ালে অসম্মানিত হতো, এখন হয় বাহারি বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে, টিভি কমার্শিয়ালে ও ফ্যাশন সাময়িকীর পাতায়। সাড়ম্বরে।
কথাগুলোর সপক্ষে দু-একটি টিভি কমার্শিয়ালের কথা লিখি। ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’ নামের বিজ্ঞাপনচিত্রটি ভারতে নির্মিত হওয়ার পর এখন বাংলায় ভাষান্তরিত হয়ে বাংলাদেশেও দেখানো হয়। ও রকম কয়েকটা আছে। একটির চিত্রায়ণ এ রকম: একজন করপোরেট কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারের জন্য ভিড় করেছেন কজন টিভি সংবাদকর্মী। কর্মকর্তা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন। ফরসা ও সুন্দরী একটি মেয়ের দিকে চোখ আটকে গেল। কর্মকর্তা তার দিকে তাকিয়ে সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লে নারী সংবাদকর্মীটি এগিয়ে এলেন, নেপথ্যে ধারাভাষ্য গমগম করে উঠল: ফরসা হও, সবার আগে থাকো। আরেকটিতে: একজন মেকআপম্যান ক্যামেরার সামনে যাওয়ার আগে নায়িকার মুখের সৌন্দর্য ঠিকঠাক করে দিচ্ছেন। এমন সময় মেকআপম্যানের মেয়ে বাবার জন্য খাবার নিয়ে আসতেই নায়িকা তাচ্ছিল্যভরে বলে উঠল, মেকআপম্যান অন্য মেয়েদের সৌন্দর্য না বাড়িয়ে নিজের কালো মেয়েটির যত্ন নিলেই তো পারে। কালো মেয়েটির চোখ ছলছল। এবার বাবা তাঁর মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন কালো ত্বকের ফরসা হওয়ার ক্রিম।
বাংলাদেশে নির্মিত এ জাতীয় বিজ্ঞাপনচিত্রগুলোর একটি। গ্রামীণ পটভূমি। দুই বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। তাদের পরিচিত একজন সদ্য বিয়ে করা বউ নিয়ে সামনে দিয়ে চলে যেতেই দাঁড়িয়ে থাকা দুজনের খিকখিক হাসি। অশ্লীল ভঙ্গিতে একজন আর একজনকে বলে, ‘দেখেছিস, অমুকে কি একটা কালো মেয়েকে বউ করেছে!’ কয়েক দিন পর সেই কালো মেয়েটিই ফরসা মুখে আবার ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে কয়েক জোড়া চোখ বিস্ময়ে গোল। কালো বউটা ফরসা হলো কী করে?
এবার ইতিহাসের পাতা উল্টাই। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী বার এট ল শেষ করে আইনি পেশায় নিয়োজিত হবেন ভেবে বোম্বে (এখন মুম্বাই) ফিরেছিলেন। মাঝখানে একবার তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন সেখানকার এক অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত মুসলিমদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য। চলাচলের পথে গান্ধী একদিন একটি ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরায় উঠতে গেলে এক পুলিশ কনস্টেবল তাঁকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিয়েছিল। কারণ কী? কারণ, গান্ধীর গায়ের রং ছিল কালো। এটা ১৮৯৩ সালে। বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা গান্ধীকে অন্য জীবনদর্শন দিয়েছিল। মানুষ ও মনুষ্যত্বের পক্ষে শক্ত একটা অবস্থান নিতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। আজকে সমাজে আমরা নারী-পুরুষের যে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান ও স্বীকৃতি দেখি, খ্রিষ্টপূর্ব ৯০০ সালে মানুষ যখন যাযাবর জীবন যাপন করত, শ্রম বিভাজন খানিকটা থাকলেও নারী-পুরুষের বৈষম্য সেখানে ছিল না। দাসপ্রথার সমাজ বদলে সামন্তপ্রথা এল, অনেক যুগ পার হলো। ১৭০০ শতাব্দীতে শিল্পায়ন নারীর অবয়বে ‘গৃহবাসী’ তকমা লেপ্টে দিলে ১৭৮৯-এর ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম দাবি ছিল ‘নারী মুক্তি’। কারণ, নারীর তখন কাজ ছিল গৃহস্থালি বিষয় ঘিরেই। এরই মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বেড়েছে, মন ও মনন পাল্টেছে, অধিকার সচেতনতাও বেড়েছে। প্রথম পর্যায়ে নারী অধিকারের দাবি কেন্দ্রীভূত ছিল শিক্ষা, বিবাহবিচ্ছেদ, কর্মঘণ্টা, মজুরি ইত্যাদি ঘিরে। পরে আরও অনেকগুলো দাবি উচ্চকিত হয়েছে। বর্ণবাদের কারণে কৃষ্ণবর্ণের নারীরা যে আরও বেশি উপেক্ষিত এবং বৈষম্যের শিকার, সেসব প্রসঙ্গও আমাদের অজানা নয়।
জানা থাকলেও মুক্তি মিলছে না। কারণ হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি। পুঁজিবাদী সমাজে সুস্পষ্টভাবেই নারী-পুরুষনির্বিশেষে একটা পণ্য মানসিকতার ঘোর নিয়ে সবাই বাঁচি। সমাজ প্রতিদিন তা-ই শেখায়। গণমাধ্যম কিংবা অডিও-ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় প্রচারিত বিষয়ের পুনরাবৃত্তি মস্তিষ্কে শক্ত একটা ভিত্তিও তৈরি করে। যেকোনো মন্তব্যে, বক্তৃতায়, লেখায় বা বিজ্ঞাপনে নারীর প্রতি বা মানুষের কোনো রকমের অসম্মান সভ্যতা স্বীকৃত নয়। ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘে ‘বর্ণভিত্তিক সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ কনভেশন’ গ্রহণ করা হয়েছে। অনেক কথার মাঝে সেখানে এ-ও আছে, বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্তি মানুষ হিসেবে সবার অলঙ্ঘনীয় অধিকার, যে অধিকার থেকে কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা আইনগতভাবে কোনো অজুহাতে বিচ্যুতির আশ্রয় নিতে পারে না। এই বিধানটি কি কালো মেয়ের অসম্মানের বেলায় খাটবে?
কালো মেয়ের সব অসম্মান কাঁধে নিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস চলে গেল। জাতিসংঘ কী করল? আমরা কী করলাম?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.