সপ্তাহের হালচাল-যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু by আব্দুল কাইয়ুম

কিছু মন্ত্রী-আমলা-উপদেষ্টা মাঝেমধ্যে এমনসব কথা বলে বসেন যে এর ব্যাখ্যা দিতে দিতে সরকার নাস্তানাবুদ হয়ে যায়। শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাদের কারসাজি উদ্ঘাটনে সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করলেও প্রতিবেদন প্রকাশ করল না। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। তবে কিছু বিষয়ে আরও তদন্ত দরকার।
কিন্তু মানুষ তো অত ঘোরপ্যাঁচ বোঝে না। তারা ধরে নিয়েছে, প্রভাবশালী টাকাওয়ালাদের রক্ষা করতে চায় সরকার। যারা শেয়ার মার্কেটে চক্রান্ত করে ধস নামিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পথে বসাল, সরকার কিনা তাদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক! এখন সরকারকে বারবার ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে যে তারা নাকি প্রকৃত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না। অথচ এখনো পর্যন্ত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটিই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হলো না। কত কথা উঠছে, সরকারের বিকার নেই।
আরেকজন উপদেষ্টা বললেন, ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার জন্য ফি চাওয়াটা নাকি সভ্যতার মধ্যে পড়ে না! অথচ একটি কমিটি ট্রানজিট ফি কত হতে পারে, তা নিয়ে কাজ করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ২ ডিসেম্বর ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে ট্রানজিট-সংক্রান্ত কোর গ্রুপ গঠন করে। তারা সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। ভারত, নেপাল, ভুটানসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে ট্রানজিটের জন্য মাশুল আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশে নিয়োজিত ভারতীয় হাইকমিশনার নিজেও বলেছেন, তাঁরা ট্রানজিট ফি দেবেন, তবে তা অবশ্যই ‘যৌক্তিক’ হতে হবে। সবাই বলছেন, ট্রানজিট ফি অবশ্যই নেওয়া হবে। আর প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা বলছেন, ওটা নাকি চাওয়া উচিত হবে না। তিনি হয়তো কথাটা ওভাবে বলতে চাননি। কিন্তু বলা তো হয়ে গেছে। তিনি এখনো উপদেষ্টা পদে আছেন। এটাই আশ্চর্যের বিষয়!
নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতায় নেমেছেন ফজলুল হক আমিনী। দেশের অর্ধেক নারী। তারা সমান কাজ করে সমান মজুরি দাবি করতে পারবে না, এটা হতে পারে না। অথচ আমিনী-গোষ্ঠী ধর্মের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইছে। সাধারণ মানুষ এটা সমর্থন করে না। মানুষই তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। এ অবস্থায় হঠাৎ আমিনীর ছেলেকে সরকারি লোকজন গুম করেছেন বলে অভিযোগ উঠল। এত দিন হয়ে গেল, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কথা নেই। এরই মধ্যে একজন মন্ত্রী বললেন, আমিনী নিজেই ছেলেকে লুকিয়ে রেখে সরকারকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে! মন্ত্রী যদি এটা নিশ্চিতই জানেন, তাহলে কেন সব ফাঁস করে দিচ্ছেন না? সরকারের পুলিশ, গোয়েন্দা সব আছে। লুকিয়ে রাখা ছেলেকে উদ্ধার করা তো কোনো সমস্যাই না। কেন সেটা তিনি বা তাঁরা করছেন না? তার মানে, আসলে মন্ত্রীর ওই দাবির পেছনে শক্ত ভিত্তি নেই।
এসব ঘটনার যোগফল হলো সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা নেমে যাওয়া। সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টারাই সরকারের জনপ্রিয়তা কমিয়ে দিচ্ছেন।
মাত্র কয়েক দিন আগে জ্বালানিসচিব সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গ্যাস উৎপাদন কম বলে বাসাবাড়িতে পাইপলাইনে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া বন্ধ থাকবে। এখন গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হবে। দৈনিক ২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন না হওয়া পর্যন্ত এই নীতি চলবে। গ্যাস কম, সেটা সবাই জানে। কিন্তু সচিব মহোদয় তো বলতে পারতেন, যদিও কম, তা-ও দুর্নীতি-অপচয় নিয়ন্ত্রণে এনে কিছু গ্যাসের ব্যবস্থা করা হবে। যেসব ভবন আগে থেকেই তৈরি হয়ে গেছে, তাদের সংযোগ দেওয়া হবে, নতুন ভবন করতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। এটা খুবই সম্ভব। কারণ বাসাবাড়িতে গ্যাসের ব্যবহার হয় পুরো গ্যাসের মাত্র সাড়ে ১১ শতাংশ। এর মধ্যে নতুন কিছু ফ্ল্যাটে যেটুকু গ্যাস অতিরিক্ত লাগবে, তা মাত্র পৌনে এক শতাংশ।
২০০৯ সাল থেকে গ্যাসের নতুন সংযোগ বন্ধ রাখায় অনেক শিল্পকারখানার মালিক পথে বসেছেন। তাঁরা প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র নিয়েই শিল্প স্থাপনের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশ থেকে মেশিন আমদানি করেছেন। এখন বলা হচ্ছে, গ্যাস দেওয়া হবে না। দেড় বছর ধরে তাঁরা ব্যাংকের ঋণের সুদ গুনছেন। তাঁরা ঋণখেলাপি হতে চলেছেন। এ রকম প্রায় ১৫১টি শিল্পকারখানা রয়েছে। যেহেতু তাদের আগে জানানো হয়নি যে কারখানা গড়ার পর গ্যাস দেওয়া হবে না, তাই অন্তত তাদের গ্যাসসংযোগ দিলে কী এমন ক্ষতি? হিসাব করে দেখা গেছে, এতে লাগবে অতিরিক্ত মাত্র ১ শতাংশ গ্যাস। মন্ত্রণালয় যদি বলত, দেশের শিল্পোন্নয়ন অব্যাহত রাখার স্বার্থে ওই কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করা হবে, কিন্তু নতুন কোনো কারখানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তাহলে ক্ষোভ অনেকটা কমানো যেত। ওষুধ তো কর্তাদের হাতেই। গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে এক ধাপ দুর্নীতি-অনিয়ম কমালেই ওই পৌনে দুই শতাংশ গ্যাসের সাশ্রয় হয়। তা ছাড়া পেট্রোবাংলা নিজেই দাবি করেছে যে তারা ২০০ এমএমসিএফটি গ্যাস উৎপাদন বাড়িয়েছে। তার মানে অন্তত ৬ শতাংশ গ্যাস উৎপাদন বেড়েছে। তাহলে মানুষকে আশার কথা শোনানোর সুযোগ তো সরকারের রয়েছেই।
সরকার এখন গ্যাস দেবে না, মানুষ হতাশ হবে। দুই বছর পর তারা বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আর ভোট দিবে কি না, ভেবে দেখবে। খুব সহজ হিসাব। আমলারা না-হয় এতসব হিসাব করেন না। তাঁরা ভাবেন, সত্য কথা বলতে অসুবিধা কোথায়। কিন্তু সত্য কোনটা? গ্যাস কম, এটাই কি একমাত্র সত্য? দুর্নীতি-অপচয় কমালে যে গ্যাসস্বল্পতা কিছুটা সামাল দেওয়া যায়, সেটা কি সত্য নয়? কিন্তু এসব কে দেখবে?
এনবিআরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সম্প্রতি সম্পত্তি কর আরোপের কথা বলেছেন। ৫০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের জমি-বাড়ি ও সহায়-সম্পদ থাকলে এই কর দিতে হবে। মনে পড়ে, সত্তর-আশির দশকে এ ধরনের ‘আরবান প্রপার্টি ট্যাক্স’ ছিল। হঠাৎ হঠাৎ কিছু লোক বাসাবাড়িতে গিয়ে হাজির হতো। তারপর ওই সম্পত্তি কর কত হবে, তা নিয়ে দর-কষাকষি করে একটা কিছু ঠিক করা হতো। পরে তা বাতিল করা হয়। এখন আবার সেই যুগে ফিরে যেতে হবে? এর মানে, দুর্নীতির আরেকটা দরজা খুলে দেওয়া?
অবশ্য অর্থমন্ত্রী এ ধরনের কর আরোপের বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনার কথা বলেছেন। কারণ একজন করদাতা আয়কর দেন, বাড়িভাড়া দিলে সেই আয়ের ওপরও আয়কর দেন, পৌর এলাকায় বাসাবাড়ি থাকলে পৌর কর দেন, সম্পদ হস্তান্তর করলে মূলধনি মুনাফাজনিত আয়কর (গেইন ট্যাক্স) দেন। তারপর আবার সম্পত্তি কর আরোপের যৌক্তিকতা কতটা, তা ভেবে দেখা দরকার।
দেশে কিছু লোক হঠাৎ অগাধ সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছে। তাদের গাড়ি-বাড়ির জৌলুশ চোখে পড়ার মতো। আরেক দিকে কিছু লোক হতদরিদ্র হয়ে পড়ছে। এই বৈষম্য কমানোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। দেশের উন্নতির জন্য দারিদ্র্য কমিয়ে আনা দরকার। কিন্তু এর পদ্ধতিটা কী হবে? জরিপে দেখা গেছে, দারিদ্র্যের হার গত পাঁচ বছরে ৪০ থেকে ৩২ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা যথেষ্ট নয়। আরও দ্রুত এগোনো দরকার। কিন্তু এর মানে এই নয় যে মানুষের ওপর কেবল কর চাপাও! এতে বিপত্তি ঘটতে পারে। অবাস্তব পদক্ষেপ মানুষকে খেপিয়ে তোলে। নির্বাচনে এর ফল ফলে।
সম্পত্তি কর আরোপ করে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কী উপকারটা হবে? এর চেয়ে মানুষকে যে পদে পদে ঘুষ দিতে হয়, সরকার সেটা বন্ধের ব্যবস্থা নেয় না কেন? তাহলে তো মানুষের অনেক উপকার হয়। পদে পদে ঘুষ দেওয়াটা যে কী জিনিস, তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। আপনি ভূমি অফিসে যান, উপরি লাগবে। যান চাকরির জন্য, টাকা ছাড়া কথা নেই। গত ২৩ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে টিআইবি পরিচালিত জাতীয় খানা জরিপে দেখা যায়, জরিপভুক্ত খানাগুলোর প্রায় ৭১.৯ শতাংশ বছরে প্রায় ৯৫৯১.৬ কোটি টাকা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদানে বাধ্য হয়েছে, যা খানাপ্রতি বার্ষিক গড় ব্যয়ের প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ। ঘুষ দিতে দিতে মানুষ কাহিল, আর সরকার বলে কিনা আরও ট্যাক্স চাপাও!
মানুষ উপকার পাবে, ট্যাক্স দেবে। কিন্তু ঘুষ-দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে তো সরকারের ভালো পদক্ষেপও মানুষ সন্দেহের চোখে দেখবে।
সরকারের মন্ত্রী, নেতা-কর্মীরা যদি ভেবে থাকেন, তাঁরা বেশ ভালোভাবেই দেশ চালাচ্ছেন, তাহলে ভুল করবেন। সেই ভুলের খেসারত দেশ ও দেশবাসীকে দিতে হবে। সরকারও বাদ যাবে না। কারণ সরকারের বিভিন্ন মহলের এসব কথা ও কাজ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মন বিষিয়ে তুলছে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.