অবিশ্বাস্য! ‘অকস্মাৎ মৃত ব্যক্তি চেপে বসে আমার বুকে’ by মাহাবুবুর রহমান

বাংলানিউজের নিয়মিত পাঠক চট্টগ্রাম আদালতের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহাবুবুর রহমান। সাহিত্যপ্রেমী মাহাবুবুর রহমান পেশাগত দায়িত্ব বিচারকার্য পরিচালনার পাশাপাশি পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন, তবে অনিয়মিত। নানা বিষয়ে তার অভিজ্ঞতার বিচিত্র ভাণ্ডার থেকে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য অতিপ্রাকৃতিক এ ঘটনাটি লিখেছেন।

লাশ বহনকারী গাড়ির এক চালকের কাছ থেকে শোনা গল্পটি বক্তার জবানিতেই উপস্থাপ করেছেন তিনি... 

‘রাত তখন এগারটা। ফোন পেয়ে আমি অফিসে গেলাম। বলা হল একটি ক্লিনিক থেকে লাশ নিয়ে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি যেতে হবে। খুব দ্রুত গাড়ি বের করে সেই ক্লিনিকে পৌঁছে গেলাম। মৃত ব্যক্তির বয়স প্রায় ৯০ বছর। তার মরদেহ গাড়িতে তুলে নানুপুর, ফটিকছড়ির দিকে রওনা দিলাম। কাপ্তাই রাস্তার মাথা পার হয়ে নোয়াপাড়া ধরে গাড়ি চালাতে থাকি। আমার সঙ্গে হেলপার ছিল না। তবে মৃত ব্যক্তির বড় ছেলে আমার পাশের সিটে বসেছিল। অন্য কেউ ছিল না গাড়িতে। শহর থেকে নোয়াপাড়া পর্যন্ত বেশ ভালভাবেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম, কোনো ধরনের অসুবিধা হচ্ছিল না।

চৌমুহনী পৌঁছে নানুপুরের দিকে রওয়ানা দিতেই হঠাৎ মনে হল গাড়ি যেন সামনে এগুতে চায় না। গাড়ি কেমন জানি ভারী হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে এরকম হয়। পাঁচ বছর ধরে লাশের গাড়ি চালাচ্ছি। এটা আমার জন্য নতুন কিছু নয়। কোনো কোনো লাশ বহন করলে গাড়ি সামনে যেতে চায় না। আবার কোনো কোনো লাশ বহনের সময় খেয়াল করেছি- গাড়ি বেশ দ্রুত এগোয়। তাই বিষয়টা নিয়ে তেমন কিছু ভাবিনি। হঠাৎ মৃত ব্যক্তির ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘গাড়ী আস্তে চলছে কেন?’
আমি তাকে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা না বলে কেবল বললাম, “ ভারি রাত তো তাই গাড়ি আস্তে চলছে।’ জবাব দিয়ে আমি আগের মতোই গাড়ি চালাচ্ছিলাম।

আমাকে অবাক করে তিনি সন্দেহের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি রানিং ঘণ্টা বেশি দেখানোর জন্য গাড়ি আস্তে চালাচ্ছো?’

তাঁকে ¯স্পিড মিটার দেখিয়ে বললাম, ‘দেখেন, আমি শুরু থেকে একই গতিতে গাড়ি  চালাচ্ছি।’ ওইসময় স্পিড মিটারে ঘণ্টায় পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগ শো করছিল। মনে মনে ভাবলাম, ‘আহারে! কত ভালবাসার এই জগৎ! জন্মদাতা পিতা মারা গেছে সেই চিন্তা না করে গাড়িতে বেশি বিল আসবে সেই চিন্তায় মগ্ন আদরের সন্তান! সবই মায়া! সবই ছলনা! হায়রে দুনিয়া!...”
   
রাত দেড়টার দিকে আমরা মৃত ব্যক্তির গ্রামে পৌঁছে যাই। মূল রাস্তার পাশে একটি কবরস্থান। কবরস্থানের পাশ দিয়ে ছোট একটি পথ বাড়ির দিকে চলে গেছে। পথটি সরু হওয়ায় গাড়ি বাড়ির উঠোনে নিতে পারিনি। কবরস্থানের পাশে অন্ধকার রাস্তার ওপর গাড়িটি রাখতে হল।

মৃত ব্যক্তির ছেলেকে বললাম, ‘আমার গাড়িতে তো কোনো হেলপার নেই। গাড়ি ও লাশ পাহারা দেওয়ার জন্য লোক দিতে হবে। আমার একার পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়বে।’

 ‘আমি লোক পাঠাচ্ছি।’ বলে তিনি বাড়ি চলে যান।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাশে কবরস্থান। আশেপাশে কেউ নেই। লাশ নিয়ে কেবল আমিই রইলাম। একটু অস্বস্তি লাগলেও ভয় পাচ্ছিলাম না। কারণ লাশের সাথে থাকতে থাকতে এ ধরনের পরিস্থিতর মোকাবেলায় আমি অভ্যস্ত। মৃত ব্যক্তির বাড়ি থেকে লোক আসছে ধরে নিয়ে আমি ড্রাইভিং সিটের দরজা বন্ধ করে দিলাম। ড্রাইভিং সিটে হেলান দিয়ে পাশের সিটে পা এলিয়ে দিয়ে বিশ্রাম নিতে শুরু করলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, ঘড়ির কাঁটা রাত আড়াইটা পার হয়ে পৌনে তিনটা ছুঁই ছুঁই করছে। কিন্তু কোনো লোক আসার লক্ষণ দেখছি না। কিছুটা বিরক্তি লাগছিল। শেষে ক্লান্তির কারণে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম নিজেই টের পাইনি।

মৃত ব্যক্তির হাহাকার- কেউ নেই আমার পাশে
‘অকস্মাৎ অনুভব করলাম, মৃত ব্যক্তি আমার বুকের ওপর চেপে বসে আছে। ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমার নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি জোরে চিৎকার করছিলাম। কিন্তু কেউ আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছিল না। নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। ওই লোক আমাকে বলছে, ‘আমি একা গাড়িতে পড়ে আছি। আমার পাশে কেউ নেই। তুমি তাদেরকে আমার পাশে আসতে বল। তারা কেন আমার পাশে আসছে না? তাদেরকে ডাক। তুমি কেন ঘুমাচ্ছ? ডাক তাদেরকে।’

তার কথা মত আমি চিৎকার করে বলতে থাকি, ‘তোমরা কেন তোমাদের বাবাকে একা ফেলে রেখেছ? তোমরা আসছ না। আর তোমাদের বাবা আমার বুকের উপর চেপে ধরে রেখেছে।’ আমি হাত পা নাড়াতে পারছিলাম না। কেবল জোরে জোরে চিৎকার করছিলাম। কিন্তু আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না- মৃত ব্যক্তি এমনভাবে চেপে ধরে রেখেছিলেন!
অকস্মাৎ ফজরের আযানের ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি কানে আসে। ঠিক তখনি আমার সমস্ত শরীর হালকা হয়ে আসে। লোকটিও উধাও হয়ে যায়। আমি জেগে উঠি। নিজের শরীরে গুঁতো মেরে পরীক্ষা করি। হাত পা নাড়াতে পারছি। বুঝলাম এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম। ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে দেখি- লাশটি গাড়ির মধ্যে আগের মতই একাকী পড়ে আছে। কোথাও কেউ নেই।  চারপাশটা চেক করে আমি আবার গাড়িতে উঠে বসি।

কিছুক্ষণ পর বড় ছেলেটি আসলে আমি তাকে রাগত স্বরে বলি, ‘আপনারা কেউ আসলেন না কেন? আপনার বাবা তো আমার বুকের ওপরে চেপে বসে আমাকে মেরেই ফেলেছিল।’ আমি তাকে রাতের সমস্ত ঘটনা খুলে বলি। তিনি আমাকে বলেন, ‘ভাই আপনি এসব কথা কাউকে বলবেন না। আমি আপনার কাছে মাফ চাইছি।’

পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে আসে। পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনরা আসতে থাকে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে লাশটি নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জানাযা পড়ানোর জন্য। আমিও শহরের পথে রওনা দিই। মনে মনে ভাবতে থাকি, জীবিতদের ফাঁকি দেওয়া যায়, কিন্তু মৃতদের ফাঁকি দেওয়া যায় না। প্রবীণদের কাছ থেকে শোনা এ কথাটি যারপর নাই সত্যি!’

মাহাবুবুর রহমান, মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট, সিএমএম কোর্ট, চট্টগ্রাম

No comments

Powered by Blogger.