গোধূলির ছায়াপথে-কলকাতা আছে কলকাতাতেই by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

বহুদিন পর এসেছি পুরোনো পাড়ায়। বিমান মানেই দেরি, তবু ‘দের দুরস্ত’। এসির পাখা চলেনি বিধায় বিমানের পাইলট বললেন, অপেক্ষমাণ থাকুন। স্মার্ট মহিলা বিমান পাইলটের কাছে কৃতজ্ঞ, দেরি করায় বাড়তি লাভ, সুশীতল বিমান। কলকাতায় পৌঁছালে সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠেছে।


আলো ঝলমল সল্টলেকের পথে নতুন অট্টালিকা, ম্যাল, নতুন স্টেডিয়াম, নতুন হোটেল পেরিয়ে হঠাৎ কলকাতা।
হঠাৎ নয়, সেই পার্কসার্কাস মুকুল ফৌজ খেলার মাঠ, নিজ স্কুল মডার্ন স্কুল, তেমনি দাঁড়িয়ে। জলযোগ মিষ্টান্ন ভান্ডার, বেনেপুকুর লেনের ৬ নম্বর বাড়ি পার্কসার্কাস ট্রাম ডিপোর পেছনে, খ্রিষ্টানদের কবরস্থানে মাইকেল মধুসূদনের সমাধির সামনে মার্বেলে: ‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল’।
কাল থেমে নেই, অনেক বদলে গিয়েও ‘কলকাতা আছে কলকাতাতেই’।
স্মৃতি যাদের অমলিন, ভিড় করে দাঁড়ান অলক্ষ্যে বন্ধু, আত্মীয় ছাড়াও এই পথেই সেদিন অফিস, হাটবাজার করে ফিরতেন: শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, কাজী নজরুল, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, এস ওয়াজেদ আলী, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, জয়নুল আবেদিন, মুকুল ফৌজের কামরুল হাসান, বদরুল হাসান, সিরাজ ভাই, হাসান ভাই, জান ভাই, সব্যসাচী, অনিরুদ্ধ, কাজের ছেলে আমজাদ, পাড়া-প্রতিবেশী, দোকানের খদ্দের। ওরা আজ কেউ নেই। কলকাতা আছে, ওরা নেই।
বিশাল গঙ্গার তীরে সারা দিন কাটালে অনুভূতি অন্য। কিছুক্ষণের জন্য নদীতীরে সময় কাটানোর থেকে আলাদা। অনাস্বাদিত, অভূতপূর্ব, একদম নতুন। মেঘলা আকাশ, সকালবেলা থেকে টিপটিপ বৃষ্টি, দুটি নৌকা গঙ্গার মাঝখানে, আরোহী সম্ভবত দুজনই হবে। ওরা মাছ ধরছে; কী মাছ, জানতে ইচ্ছা করল। ইলিশ, পাঙাশ, রুই, কাতল? মৎস্যপ্রিয় বাঙালির মৎস্যচিন্তা। ইলিশ পেলে খুশি হতাম, পাঙাশও। দুপুরবেলার লাঞ্চের টেবিলে প্রায় সব মাছই উপস্থিত। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাব। এর পরও আছে শুক্তো, বড়ের সঙ্গে আলু দেওয়া নিরামিষ। চব্বিশ পরগনার ব্যারাকপুরে সুন্দর রেস্টহাউসটির বিশাল সুরম্য ঠান্ডাঘরে গঙ্গার মুখোমুখি হওয়ার জন্যই আমাদের আজ সকালের আমন্ত্রণ। গঙ্গা প্রাচীন ও আরাধ্য নদী, যার আরাধনাই অনেকের জীবন ঘিরে। গঙ্গা জীবনযাত্রী, জীবনসখা, জীবনতরী। আর আমার সামনে স্রোতস্বিনী, স্বপ্ন এঁকে চলেছে এই নদীর স্রোত।
কতক্ষণ দেখা যাবে এই নদী? যদি বলি সারা দিন, সারা রাত; জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে, বসন্তপ্লাবিত কাকভোরে, ডাহুক যখন খুঁজে ফেরে তার সঙ্গীকে, তখনো আমি গঙ্গার সহচর। কত কবি, কত লেখক এই নদীতীরে খুঁজে লিখেছেন জীবনপ্রবাহ, লিখেছেন তাঁদের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো। দুই চোখ ভরে দেখছি, চোখে ভরে নিচ্ছি নদীর স্বপ্ন, নীলাঞ্জন। কয়েকটি তালগাছ নদীর ধারে প্রহরীর মতো; তাল নেই, আছে শুধু পত্রপল্লব। একটি শুকনো শিরীষ, ডালপালা পত্রশূন্য, কয়েকটি নাম না-জানা পাখি এসে আশ্রয় নিয়েছে শীর্ষবিন্দুতে। ডাঁশা পেয়ারার গাছগুলোতে অনাঘ্রাত পেয়ারা, দুরন্ত হাওয়ায় দুলছে ফলগুলো। খাওয়ার মানুষজন ধারেকাছে নেই।
মঙ্গলপান্ডে ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্ল্যান্ট গঙ্গার ধারে। কলকাতায় এলে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিশিষ্টজনেরা বড় হোটেল, ক্লাব, ভিআইপি অট্টালিকা পরিহার করে আশ্রয় নেন এখানে। রাতে বিজয় সরকার স্মরণোৎসবে কুড়ি হাজার দর্শক-শ্রোতা। নড়াইলের গোমদন্ডি গ্রামের বিজয় সরকার আশ্রয় নিয়েছেন কনিষ্ঠ পুত্র কাজল অধিকারীর তত্ত্বাবধানে ফি বছর দুই দিনব্যাপী সংস্কৃতি সম্মেলনে। ‘সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে, ভাগ হয়নিকো নজরুল’, তেমনি বিজয় সরকার।
শ্রোতারা সামনের দিকে মেলে ধরেছে দুই বাহু, যখনই কৃষ্ণের নাম এল, যেন সামনে আবির্ভূত। যখন ধরি : ‘ঐ না মাধবী বনেতে বন্ধু ছিল, সইলো, বন্ধু আমার কোন বনে লুকাইল’, শ্রোতারা অনুভবে আনলেন কৃষ্ণকে, পার্শ্ববর্তী নড়াইলের গোমদন্ডি গ্রামের সবুজ পাসপোর্ট হাতে এই শ্মশ্রুধারী আপনজনের মাধ্যমে।
অনুভবটাই আসল, বাকিটুকু মিথ্যা। কেউটিয়া গ্রাম আর নড়াইলের গোমদন্ডি একাকার, হাজার শ্রোতা রাত অবধি খুঁজছে কৃষ্ণকে, হারানো বিজয়কে।
কলকাতার পথে পথে নেই আর ফুটপাত শপ, ডজন উড়ালপথে উড়ছে ট্যাক্সি, কার। মুহূর্তে ছুটে চলছে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে, নতুন মলের দিকে। ‘মলে’ বাঙালিরা অনুপস্থিত, দোকানি ও খদ্দের সবই অবাঙালি। ক্বচিৎ বাঙালির দেখা। আনন্দবাজার, বর্তমান—কোনো কাগজই কলকাতার বড় হোটেলে খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু রাজনীতির অঙ্গনে বেঁচে আছে বুদ্ধদেব-মমতা; অবাঙালিরা এসে ঢুকতে পারেনি এ চত্বরে। ভাবছিলাম, কাকে সাপোর্ট করা যায়। শুনেছি, মমতা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। আরও শুনেছি, উনি কোচবিহারে যাওয়ার জন্য নতুন রুট খুলে দেবেন। ‘ইলেকশন ওয়াচ’ অভাবিত খবর দিচ্ছে, ওরা বলছে, মমতা সুইপ করবে। কলকাতাবাসী অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষারত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের জন্য। জলপাইগুড়িতে ভাওয়াইয়া গায়ক সুখবিলাস বর্মা ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন। ‘ইলেকশন ওয়াচ’ আজ লিখেছে [প্রথম আলো], উনি নাকি বিরাট বড়লোক, কয়েক কোটি টাকার মালিক। হলে আমি খুশি হতাম। বলরামপুর গ্রামের কালজানি নদীর ওপারে তাঁর বাড়ি। নায়েব আলী টেপু, কেশব বর্মণ, প্যারিমোহন দাস সবার বাড়ি মাটির।
ভিখারি মুসলিমরাই, আশ্রয় নিয়েছে কলকাতার পড়ো-পড়ো মসজিদগুলোর ধারেকাছে। কলকাতায় নেই সুললিত আজান। ওদের বলেছি, আমাদের মন্দিরগুলো দেখে যেতে।
আরও খবর। গুজরাটকে হারিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। অবন্তিকা ঘোষ জানাচ্ছেন ২৩ মার্চ, আবু সালেহ শরীফ [ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাপ্লাইড রিসার্স]-এর বরাত দিয়ে: পশ্চিম বাংলার ২৫ দশমিক ২ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ২ দশমিক ১ শতাংশ সরকারি চাকরির আওতায়, ৫০ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলের বাইরে। গুজরাটের মুসলিম জনগোষ্ঠী ৯ দশমিক ১ শতাংশ, সরকারি চাকরির হার: ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ১৫ আগস্ট না হলে, অর্থাৎ আমরা একসঙ্গে থাকলে কী হতো, আমরা জেনে গেলাম।
রাধা-কৃষ্ণের গানের আসরে কাঁদলে কী হবে, বাঙালিরা কোণঠাসা হয়ে আছে দক্ষিণ কলকাতায়। বাঙালিরা ভালো নেই।
১৮ এপ্রিল, ২০১১
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.