তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে গণতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব by এমাজউদ্দীন আহমদ

গভীর সংকটকালে জিয়াউর রহমানের ওপর শাসনক্ষমতা অর্পিত হয়। তখন দেশে কোনো সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল ছিল না। ছিল না সুসংহত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সামরিক বাহিনীও ছিল খণ্ডবিখণ্ড। মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত হলে একাত্তরের শেষ দিকে দেশে ফেরার আগেই প্রবাসী সরকার ডানপন্থী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।


পঁচাত্তরে বাকশাল গঠনের আগে বিদ্যমান সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৫ আগস্টের পর বাকশালেরও সমাপ্তি ঘটে। অন্য কথায়, জিয়াউর রহমান যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন দেশে কোনো রাজনৈতিক দল অক্ষত ছিল না। অন্য পক্ষে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য পুলিশ ও প্যারা-মিলিটারি বাহিনী তখনো সুসংহত ও সুশৃঙ্খল হয়ে ওঠেনি। মুক্তিযুদ্ধে অনেকে শহীদ হয়েছিলেন। নতুন রাষ্ট্রের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নতুনভাবে এই বাহিনীকে গড়ে তোলার কোনো সার্থক ব্যবস্থা তখনো গৃহীত হয়নি। সামরিক বাহিনী তখন ছিল অন্ততপক্ষে চার ভাগে বিভক্ত। এক গ্রুপ দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ছিল বিভোর। অন্য গ্রুপের লক্ষ্য ইসলামিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। আর একটি গ্রুপের লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যম। এমনি করুণ অবস্থায় তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
যেকোনো জনপদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিদ্যমান থাকে তিনটি নিয়ন্ত্রণকারী চ্যানেল। যেখানে রাজনৈতিক দল বিদ্যমান থাকে সেখানে দলই হয় নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশদানের প্রথম প্রধান চ্যানেল। রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্ব দুর্বল হলে পুলিশ বাহিনীর হাতে এই দায়িত্ব এসে পড়ে। পরিস্থিতি আরো জটিল হলে সামরিক বাহিনী সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসে এইড টু সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ফরম্যাটে। ১৯৭৫ সালের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশে কোনোটি তেমন কার্যকর ছিল না। কিন্তু তখনকার অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখুন, ১৯৭২-৭৫ সময়কালে দেশে আইনশৃঙ্খলার যে বেহাল অবস্থা ছিল, ১৯৭৫ সালের পরে তা কত সহজে নিয়ন্ত্রিত হয়। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি, চাঁদাবাজি, খুন-জখম-ধর্ষণ কত সহজে নিয়ন্ত্রণে আসে এবং কত অল্প সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। পুলিশ বাহিনীকে নতুনভাবে মোটিভেট করা হয়। প্যারা-মিলিটারি বিডিআরকে সীমান্ত রক্ষায় নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়। সামরিক বাহিনীতে ঐক্য ফিরে আসে। আরো পরে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। সব কিছুর ঊধর্ে্ব কিন্তু ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়ার মেধাবী ও সহৃদয় নেতৃত্ব। তাঁর অনুধাবনে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করাই হলো যেকোনো রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি হলো রাষ্ট্রের আদিমতম দায়িত্ব। যে কারণে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে তার সবচেয়ে প্রধান হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা। তাই তিনি পুলিশ বাহিনীর বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির মাধ্যমে এর সূচনা করেন এবং নিজেই এর তদারকির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশের বিভিন্ন ইনটেলিজেন্স এজেন্সিকে তৎপর করে, প্রশাসকদের এই বিষয়ে সজাগ রেখে এবং প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের মাধ্যমে প্রায় অসম্ভব বলে তখন যা মনে হতো, সেই অসম্ভবকে তিনি সম্ভব করেন। অনেকে তাঁর কাছাকাছি থেকে তখন লক্ষ করেছেন, রাত ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত তিনি নিজে কথা বলতেন বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসন এবং পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে। জানতে চাইতেন দূরবর্তী জেলাসমূহে জনগণ শান্তিতে ঘুমাতে পারছে কি না। একজন জেলা প্রশাসক বা জেলার এসপি যখন রাত ১টার দিকে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানের কণ্ঠস্বর শুনতে পান সেই জেলায় অপরাধের বিস্তৃতি হয় কিভাবে? তা ছাড়া নিজস্ব উৎস থেকেও তিনি বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং এসব বিষয়ে প্রশাসকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। নির্দেশ দিতেন কিভাবে অপরাধ নির্মূল করতে হবে। এভাবে দায়িত্ব গ্রহণের বছরখানেকের মধ্যে দেশে অপরাধের মাত্রা কমে আসে অকল্পনীয়ভাবে। তা ছাড়া ১৯৭৭ সালের পর থেকে যখন তিনি দেশের বিভিন্ন স্থান সফর করা শুরু করেন, কোনো কোনো স্থানে অকস্মাৎ উপস্থিত হয়ে খবরাখবর নেওয়া শুরু করেন, তখন থেকে আইনশৃঙ্খলার অবস্থা আরো উন্নত হয়ে ওঠে। যে ব্যুরোক্র্যাসি স্থবির বলে জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল, তাও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে আশাতীতভাবে, বছরখানেকের তদারকির ফলে।
দেশে সৎ, দক্ষ, কর্মঠ লোকেরও অভাব ছিল না। এসব সৎ, দক্ষ বিশেষজ্ঞকে খুঁজে বের করে যথাস্থানে তাঁদের বসানো অর্থে 'হেড হান্ট' শব্দ দুটি আমি ব্যবহার করেছি। এমন কিছু যোগ্য ব্যক্তি দেশে রয়েছেন যাঁরা মোসাহেবি না করে, যে কথা শুনে আমি খুশি হব তা না বলে সত্য কথনে অভ্যস্ত, শুধু অনুগত না হয়ে সঠিক তথ্যদানে নির্ভীক, সেই সব ব্যক্তির সেবা সিঙ্গাপুরের জন্য অপরিহার্য করে তুলি।' এদিক থেকে বিবেচনা করলে রাষ্ট্রপতি জিয়াকে সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউয়ের সঙ্গে তুলনা করা যথার্থ। তিনি যেসব উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে যেসব মন্ত্রী নিয়োগ করেন তাঁদের দিকে দৃষ্টি দিলেই চলবে। আনুগত্য সবাই পছন্দ করেন, কিন্তু অনুগত শুধু দয়ার পাত্র। কোনো কঠিন দায়িত্ব পালন তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই তিনি রাষ্ট্রপতির মুখের ওপর তাঁর ভুল যাঁরা ধরিয়ে দিতে পারেন তাঁদেরই বেশি পছন্দ করতেন। এভাবেই তিনি তাঁর শাসনব্যবস্থা সাজিয়েছিলেন।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অপরিসীম দক্ষতা। কোনো একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তিনি নিজে ভাবতেন। ভিন্ন মতের কিছু ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতেন ফাঁকে ফাঁকে। তারপর অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন। কোনো কোনো সময় তিনি ওই স্থানেই তাঁর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতেন। সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর শত্রুরাও কোনো সময় উত্থাপনের সাহস পায়নি। হাজারো সমস্যার দেশে, যেখানে প্রতিনিয়ত অসংখ্য সমস্যা ফণা উদ্যত করে রয়েছে, সেখানে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে সিদ্ধান্তের জন্য অফিস ফাইলে তা দিতে থাকলে সমস্যা যে শুধু জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে তাই নয়, একটি সমস্যা হাজারে রূপান্তরিত হয়। এই সত্য তিনি অনুধাবন করেছিলেন সঠিকভাবে। মনেপ্রাণে একজন গণতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমান অনুধাবন করেছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু রাষ্ট্রপতির সচিবালয় বা প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় হতে পারে না। সমস্যা যেমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে জাতীয় জীবনের সর্বত্র, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত হতে হবে দেশের সর্বত্র, বিশেষ করে সব মন্ত্রণালয়ে। যোগ্যতর ব্যক্তিদের হাতে ন্যস্ত থাকবে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এবং তাঁরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন; রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর প্রধান কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বয় সাধন; তার বেশি কিছু নয়। গণতন্ত্রের আকাশে একক চন্দ্রের কোনো সুযোগ নেই। অসংখ্য তারকারাজি শোভিত আকাশ হলো গণতন্ত্রের। সমস্যা সমাধানই বলুন, আর সিদ্ধান্ত গ্রহণই বলুন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কারো কোনো একক আধিপত্যের স্থান নেই। এই সত্য অনুধাবনের জন্যই জাতীয় নেতা জিয়াউর রহমান হতে পেরেছিলেন জাতীয় সম্পদ।
যে জনপদে জিয়াউর রহমানের মতো জাতীয় নেতা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন আমাদের চরম দুর্ভাগ্য, সেই জনপদ আজ দুর্নীতিকবলিত। একবার নয়, গত চার বছর ধরে বাংলাদেশ দুর্নীতিপরায়ণ দেশ হিসেবে বিশ্বে শীর্ষস্থানে ছিল। এ যে কত বড় জাতীয় অপমান জিয়ার অনুসারীরা একবার যদি অনুভব করতেন। অথচ রাষ্ট্রপতি জিয়া সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতেন দুর্নীতিকে। তাঁর জীবদ্দশায় দুর্নীতি বাংলাদেশকে স্পর্শ করার সাহস পায়নি। তিনি দুর্নীতির শত ছিদ্র বন্ধ করেছিলেন। দুর্নীতি যেন জাতীয় অর্জনকে গ্রাস করতে না পারে সে জন্য তিনি ছিলেন সদাজাগ্রত। এই সত্য তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল যে রাষ্ট্রপ্রধান যদি নির্মল থাকেন, যদি তাঁর চারপাশ দুর্নীতিমুক্ত থাকে, যদি তাঁর আত্মীয়স্বজন ও অনুসারীরা দুর্নীতিকবলিত না হয়, তাহলে সমগ্র রাজনৈতিক সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা সম্ভব। তাঁর সততা সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। কোনো কোনো নিকটাত্মীয়কে তিনি তাঁর বাসভবনে প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সরকারি গাড়ি তিনি নিজের সন্তানদের পর্যন্ত ব্যবহারের অযোগ্য ঘোষণা করেন। আত্মীয়ের বাড়ি থেকে যেন কখনো খাবার না আসে সে বিষয়েও তিনি সচেতন ছিলেন। লক্ষ্য একটাই এবং তা ছিল বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থাকে তিনি যেন দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারেন। এও সত্য, তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও তাঁর বিরুদ্ধে এই অপবাদ আজও উত্থাপনে অপারগ। অথচ আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে দুর্নীতিতে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে।
এই মহান জাতীয় নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো, তিনি যা চেয়েছিলেন তার দিকে দৃষ্টি রেখে পথ চলা। তিনি যা করেছিলেন তাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে সেভাবে দায়িত্ব পালন করা। তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন তাকে সযত্নে ধারণ করা। তিনি যেভাবে দেশ-জনতার সঙ্গে একাত্মতা স্থাপন করে জনকল্যাণে ব্রতী হয়েছিলেন তাকে কাম্য পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করা। জুনিয়াস কর্তৃক লিখিত কয়েকটি লাইন এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্যযোগ্য : 'একটি দৃষ্টান্ত আর একটি জন্ম দেয়।/সেগুলো একত্রিত হয়ে আইনে পরিণত হয়।/গতকাল যা ঘটনা ছিল, আজকে তা তত্ত্বে রূপান্তরিত।'
আমাদের পরম দুর্ভাগ্য, জিয়াউর রহমানের মতো জাতীয় নেতার অনুসারী হয়েও দেশটাকে আমরা তাঁর স্বপ্নের দেশরূপে সাজাতে ব্যর্থ হয়েছি। রাজনীতির এই সংকটে তাঁর কথা মনে পড়ে এবং তাঁর প্রয়োজন বড় হয়ে ওঠে।

লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.