বিপন্ন নদনদী-লিজ প্রদান, দখল ঠেকাতে হবে

নদীমাতৃক বাংলাদেশের পরিচয়ই যেন ঘুচে যেতে বসেছে। যে নদনদী ছিল একদিন এই ভূখণ্ডের জনজীবন ও অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ, আজ সেই নদনদীই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে উঠছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শঙ্কাও। গত ৩০ মার্চ সহযোগী একটি দৈনিকে এ-সম্পর্কিত দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।


ওই প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, যমুনা-ব্রহ্মপুত্রে পানিপ্রবাহ বর্তমানে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। উত্তরাঞ্চলে সেচ ও পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব, নাব্যতা সংকট আর কিছু মানুষের অপতৎপরতা এবং অপরিকল্পিত বাঁধসহ নানা কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদনদী এবং এগুলোর শাখা-প্রশাখা শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে একদিকে শুষ্ক মৌসুমে দেখা দিচ্ছে পানিশূন্যতা, অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে দেখা দিচ্ছে অকালবন্যা। এ দুই-ই জনজীবন ও অর্থনীতির জন্য দুঃসংবাদ।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানিপ্রবাহের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ৭৪ কিউসেক, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। একদিকে নদীর বক্ষজুড়ে দেখা দিচ্ছে বালুচর, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির এই দেশে কৃষি উৎপাদনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ পানি। তা ছাড়া যেসব নৌরুটে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনে নৌযান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল, ক্রমেই তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার বিভিন্ন জনপদে এর চরম বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল গঙ্গাবিধৌত। গঙ্গার প্রধান চারটি শাখানদী মাথাভাঙ্গা, গড়াই, মধুমতী ও ভৈরব। এই নদীগুলোর শাখা-প্রশাখা জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ওই অঞ্চলে। ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার বড় অংশ নদনদীর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু নদনদীর নাব্যতা সংকট এতটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে কৃষিসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপরও। উদ্বেগজনক হলেও সত্য, কোনো কোনো নদীর অস্তিত্ব মানচিত্রে থাকলেও বাস্তবে তা এখন খুঁজে পাওয়া ভার। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ এবং দখলের কারণে নদনদীর গতিপথ যেমন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, একই সঙ্গে পানিপ্রবাহও উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সরকারের তরফে নদনদীর নাব্যতা সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা হলেও এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। তা ছাড়া রয়েছে ড্রেজার সংকট।
নদনদীর এই বিপন্ন দশা এক দিনে সৃষ্ট নয়। বিষয়টি নিয়ে এ পর্যন্ত যত কথা হয়েছে, এর বিপরীতে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে এই যে উদাসীনতা কিংবা অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের মহড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা বিপদাশঙ্কাই প্রকটতর করে তুলছে। পরিবেশ ও মানুষের সার্বিক প্রয়োজনেই দ্রুত দেশের সব নদনদী বাঁচানোর দূরদর্শী পদক্ষেপ নিতে হবে। অবাধ পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিকল্পিত নদী খনন এবং প্রবহমান নদীগুলোর লিজ প্রদান বন্ধ করা জরুরি। ঠেকাতে হবে নদী দখলের মতো অপরিণামদর্শী সব কর্মকাণ্ডও।

No comments

Powered by Blogger.