বাংলাদেশের অনন্য দায়মুক্তি by হারুন হাবীব

স্বাধীনতার ৪১ বছর পর ৮৩ জন বিদেশি বন্ধু ও সংগঠনকে মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের প্রভূত অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে এক বিরল সম্মাননা জানানো হয়েছে। এ সম্মাননা সেই সব মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতা, যাঁদের কাছে এ দেশ বিশেষভাবে ঋণী। বিলম্ব যতই হোক, এ কৃতজ্ঞতার গুরুত্ব অনেক।


কারণ এসব মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের কাছে আমাদের অপরিসীম ঋণ। চার দশক পর হলেও বাংলাদেশ সে ঋণ স্বীকার করে অনেকটাই দায়মুক্ত হতে পারল বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস যেমন বেদনাদায়ক, তেমনি আনন্দ ও গর্বের। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল সারা বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষের লড়াই। এতে অবদান রেখেছে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ, নানাভাবে। সেই সব পরীক্ষিত বন্ধুকে সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানানোর ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় জীবনের একটি বড় দায় ছিল, যা বর্তমান সরকারের হাতে সমাধা হলো। ২৭ মার্চ ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের অনুষ্ঠানটি ছিল সে কারণেই ঐতিহাসিক। মুহুর্মুহু করতালির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সব বিদেশি ব্যক্তি ও সংগঠনকে যখন 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা' এবং 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা' প্রদান করছিলেন, তখন সত্যি সত্যি গর্ববোধ করেছি আমরা মুক্তিযোদ্ধারা- যাঁদের অনেকেই সেদিন আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। অন্য দেশের নাগরিক হয়েও তাঁরা আমাদের নানাভাবে সাহায্য করেছেন, পাকিস্তানি সৈন্য ও তাঁদের এ দেশীয় দালালদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, নারী ধর্ষণ ও বর্ণনাতীত বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন, ভারতের মাটিতে এক কোটি শরণার্থীর পাশে দাঁড়িয়েছেন, এমনকি অনেকে তাঁদের সরকারের নীতি-অবস্থানের বাইরে গিয়েও স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতা জুগিয়েছেন। কাজেই তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ব্যাপারটি ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য একটি বড় দায়। মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক অবদান রাখায় ২০১১ সালের ২৫ জুলাই ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্মাননা' (মরণোত্তর) পদক দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো বিদেশি নাগরিককে দেওয়া এটিই সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান। ভারতের কংগ্রেস প্রধান ও ইন্দিরার পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী এ সম্মাননা গ্রহণ করেন। যে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে যুক্ত, তাঁর ঐতিহাসিক অবদান স্বীকার করে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ইতিহাসকেই সম্মানিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। বৃদ্ধ বয়সে সশরীরেও এসেছিলেন কেউ কেউ। এসেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল (অব.) জে এফ আর জ্যাকব, যিনি ১৬ ডিসেম্বরের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বড় ভূমিকা রেখেছেন। আরো ছিলেন ত্রিপুরার মহারানি বিভু কুমারী দেবী, যিনি রাজপ্রাসাদ খুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য। এসেছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের সাবেক মুখ্যসচিব আই পি গুপ্তা এবং ড. রথীন দত্ত- তাঁরা শরণার্থীদের দেখাশোনায় যে ভূমিকা রেখেছেন, তা ভোলার নয়। সশরীরে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের লিয়ার লেভিন, ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টিম, ডেভিড উইসব্রড। দেখলাম, ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিংয়ের নামটা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড কড়তালিতে ফেটে পড়ল সম্মেলনকক্ষ। এ ছাড়াও সম্মাননা নিতে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়েছিলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, জাপানের সুয়োসি নারা, তাকায়াসি সুজুকি, ডেনমার্কের ড. ক্রিস্টেন ওয়েস্টারগার্ড, জার্মানির বয়োবৃদ্ধ বারবারা দাশগুপ্ত, সুনীল দাশগুপ্ত, ব্রিটিশ সমাজকর্মী জুলিয়ান ফ্রান্সিস, বিমান মলি্লক এবং আয়ারল্যান্ডের ব্যারিস্টার নোরা শরিফ। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের মিত্রবাহিনীর অবদান আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই মিত্রবাহিনীর পক্ষে সম্মাননা নিতে উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী পালাম রাজ।
ভারতীয় হাইকমিশনার পংকজ শরণ গ্রহণ করেছেন ভারতীয় জনগণের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা। সম্মাননা গ্রহণ করা হয়েছে জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থা ইউএনএইচসিআর, বিবিসি, ভারতীয় আকাশবাণী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতি, সেবা সংস্থা অক্সফাম এবং আইসিআরসির পক্ষ থেকে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছেও বাংলাদেশ ঋণী। আমি জানি না, যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার নামটা প্রথম তালিকায় কেন আসেনি। তাঁর কাছেই পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে। তবে সম্মাননাপ্রাপ্তদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান প্রয়াত ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ, ইন্দিরা গান্ধীর দুই বিশেষ সহকারী- প্রয়াত ডিপি ধর এবং প্রয়াত পি এন হাকসার, বিএলএফ প্রশিক্ষণের মূল নায়ক মেজর জেনারেল এস এস উবান, শহীদ ল্যান্স নায়েক এলবার্ট এক্কা, ত্রিপুরার প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ, ভারতের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, প্রয়াত বিচারপতি সৈয়দ সাদাত আবুল মাসুদ, আকাশবাণীখ্যাত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, প্রয়াত ওস্তাদ আলী আকবর খান, প্রয়াত অন্নদা শঙ্কর রায়, প্রয়াত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা, ত্রিপুরার প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেববর্মণ এবং সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড. করণ সিং ও প্রয়াত সরদার শরণ সিং। এ ছাড়াও আছেন ভুটানের প্রয়াত রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক, সাবেক যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল জোসেফ ব্রোজ টিটো, যুক্তরাজ্যের প্রয়াত স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড জর্জ হিথ, রাশিয়ার প্রয়াত সাবেক প্রেসিডেন্ট লিওনিড ব্রেজনেভ, নিকোলাই পদগোর্নি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এলেক্সি কোসিগিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিচার্ড কে টেলর, আনা ব্রাউন টেলর, প্রয়াত মার্কিন কূটনীতিক আর্চার কে ব্লাড, খ্যাতিমান প্রয়াত চিকিৎসক ড. জোসেফ গ্রাস্ট, যুক্তরাজ্যের প্রয়াত লর্ড পিটার ডেভিড শোর, ইতালির শহীদ ফাদার মারিও ভেরোনাইস, জাপানের প্রয়াত তাকাসি হায়াখাওয়া, প্রয়াত নাউকি উসুই, সুইডেনের প্রয়াত গানার মিরদালসহ অনেকেই। ফ্রান্সের বিশ্বখ্যাত দার্শনিক প্রয়াত আন্দ্রে মালরো, যিনি যুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে এসেছিলেন, সম্মাননা জানানো হয়েছে সেই জগদ্বিখ্যাত মানুষটিকেও। সম্মাননা পেয়েছেন আয়ারল্যান্ডের প্রয়াত শিয়ান ম্যাকব্যাইড। প্রয়াত রওশন আরা বেগম সাংমার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেছেন তাঁর ছেলে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা। এই মহীয়সী নারী বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া আমপাতি এলাকার বিশাল একটি জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন, যেখানে হাজার হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। সেই রিফিউজি ক্যাম্পটির কথা আজও আমার মনে পড়ে। এইসব মানুষের কাছে বাংলাদেশ ঋণী। এইসব মানুষের অসীম মহত্ত্ব, অদম্য সাহস এবং দৃঢ় চেতনা আমাদের জাতির হৃদয়ে চিরস্মরণীয়। লক্ষ করেছি, এই কৃতজ্ঞতায় বিদেশি বন্ধুরা অভিভূত হয়েছেন, আবেগাপ্লুত হয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা ফুটে উঠছিল তাঁদের চোখেমুখে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল (অব.) জে এফ আর জ্যাকব বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননার এই উদ্যোগকে অনন্য আখ্যা দিয়ে বলেন, এ ধরনের সম্মাননার উদ্যোগ বিশ্বে বিরল। এ সম্মাননা পেয়ে একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রামের দিনগুলোতে দুঃসময়ের অকৃত্রিম সুহৃদ সায়মন ড্রিং বলেন, আজ আমি গর্বিত। কারণ আমি বাংলাদেশের গৌরবময় বিজয়ের অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র পরিচালক লিয়ার লেভিন চোখে আনন্দাশ্রু নিয়ে বলেন, এ দেশের মানুষ যে সম্মান ও ভালোবাসা দেখাল, তা চিরদিন মনে থাকবে। ভারতের মিত্রবাহিনীর পক্ষে সম্মাননা গ্রহণকারী সে দেশের প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশের এ উদ্যোগকে 'এক বিশাল নজির' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। জাপানের অধ্যাপক সুয়োশি নারা বলেন, আমি গর্ববোধ করছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়া মাইকেল বার্নস জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেন, স্মরণ করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে। যত দূর জানি, সরকার প্রাথমিকভাবে ৫৬০ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। ওই তালিকা আরো সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। কথা বলে জেনেছি, সঠিক ঠিকানা না জানায়, অনেকেই বেঁচে না থাকায় কিংবা পরিবারের কেউ আসার মতো না থাকায় সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো যায়নি। তবে পর্যায়ক্রমে সবাইকে সম্মানিত করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে ঘোষণা করেছেন।
আশা করব, পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, ত্রিপুরার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী, মুক্তিযুদ্ধের অমর কিছু গানের রচয়িতা গোবিন্দ হালদার; দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁর লেখা কথিকা পড়ে সম্মাননা লাভ করলেন- সেই বাংলাদেশপ্রাণ প্রণবেশ সেন ও ত্রিপুরার প্রয়াত সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য, আগরতলায় যাঁর মেলার মাঠের বাড়িটি ত্রিপুরাকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধ কর্মকাণ্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঠিকানা হয়ে উঠেছিল এবং টাইম ম্যাগাজিনের সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক ডেন কগিনসহ আরো যাঁদের নাম বাদ পড়েছে তাঁদের অবশ্যই সম্মাননা জানানো হবে। আমার বিশ্বাস, বিদেশি বন্ধুদের জাতীয়ভাবে সম্মাননা জানানোর এই প্রয়াস বর্তমান প্রজন্মকে তাদের গৌরবোজ্জ্বল ও ত্যাগদীপ্ত ইতিহাস সম্পর্কে অবগত করবে, তাদের আত্মপরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করতে উদ্দীপ্ত করবে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.