আরও ৬ ‘রাজনৈতিক’ ব্যাংক

ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত মহাজোট সরকারের শরিক রাজনীতিবিদদের খুশি রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গতকাল রোববার দেশের বেসরকারি খাতে ছয়টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর মূল উদ্যোক্তারা হলেন মহাজোট সরকারের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নিকটাত্মীয়।


অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও এর আগে বলেছিলেন, নতুন ব্যাংক দেওয়া সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ২০১১ সালে তিনি জাতীয় সংসদে এ কথা বলেছিলেন। এরপর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) নতুন ব্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে লিখিতভাবে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল।
এর আগে গত বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের তিনটি এনআরবি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়। বুধবারের মুলতবি হওয়া বৈঠকটি গতকাল আবার অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান এতে সভাপতিত্ব করেন।
গতকাল অনুমোদন হওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের উদ্যোক্তা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। যদিও এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম রয়েছে শহিদুল আলমের। আর একসময় এরশাদের অর্থকড়ি সংরক্ষণ করতেন গোলাম মসি, যিনি জাতীয় পার্টির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদকও ছিলেন। তিনিও ব্যাংকটির উদ্যোক্তা তালিকায় আছেন।
ঢাকা-১২ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ ফজলে নূর তাপসের ব্যাংকের নাম মধুমতি ব্যাংক। অবশ্য এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম রয়েছে হুমায়ুন কবীরের।
সরকারি প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ফারমার্স ব্যাংকের প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান। এর আগে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরও অনুমোদন পেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আয়কর উপদেষ্টা এম মনিরুজ্জামান খন্দকারের ব্যাংকের নাম মিডল্যান্ড ব্যাংক।
সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান হচ্ছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থক, লকপুর ফিশারিজের এস এম আমজাদ হোসেন। উদ্যোক্তাদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা আবদুল মান্নান চৌধুরী। তবে জানা গেছে, ব্যাংকটিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একজনের নিকটাত্মীয় নেপথ্যে রয়েছেন।
আর মেঘনা ব্যাংকের প্রস্তাবিত চেয়ারম্যান হচ্ছেন রংপুর-৫ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ এইচ এন আশিকুর রহমান। আর পরিচালক তালিকায় আছেন ঢাকা-৩ আসনের সাংসদ নসরুল হামিদ।
আর গত বুধবার অনুমোদন পায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের তিনটি ব্যাংক। এর মধ্যে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের মূল উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আওয়ামী লীগের নেতা ও ব্যবসায়ী ফরাসত আলী। আর এনআরবি ব্যাংক লিমিটেড নামে একটি ব্যাংকের মূল উদ্যোক্তা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ব্যবসায়ী ও ইউএ করপোরেশনের চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী। একই নামে পাওয়া আরেকটি ব্যাংকের উদ্যোক্তা যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ব্যবসায়ী ও সিমার্ক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদ। নাম একই হওয়ায় একটির নাম পরিবর্তন করতে হবে।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদই এর আগে প্রবাসীদের অর্থায়নে একটি ব্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অথচ এই পর্ষদই কয়েক দিন পর এসে উল্টো সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনটির অনুমোদন দিল। এই তিনটিও রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পেয়েছে।
এই নিয়ে এ দফায় আওয়ামী লীগ সরকার নয়টি তফসিলি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আর ১৯৯৬-২০০১ সময়ে ক্ষমতায় থাকাকালে দলটি ১৩টি ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছিল। তখনো দলীয় বিবেচনায় ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে ২০০১-০৬ সময়ে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক চাপ থাকলেও সে সময়ের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্ত অবস্থানের কারণে তা হয়নি। দেশে বর্তমানে ৪৭টি তফসিলি ব্যাংক রয়েছে। আর এ দফায় নয়টি ব্যাংক যুক্ত হওয়ায় মোট তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৫৬টি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের এ সভায় (বুধবার ও গতকাল) অর্থসচিব মোহাম্মদ তারেক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা উপস্থিত হননি। বেশ কয়েক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, এই দুজন পরিচালক নতুন ব্যাংক অনুমোদনের সভাতে উপস্থিত হবেন না। তাঁরা নতুন ব্যাংক অনুমোদনের দায় নিতে চান না। একজন সদস্য স্পষ্ট ভাষায় পর্ষদ সভাতেই জানিয়ে দিয়েছেন যে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের দায় নেবেন না। যোগাযোগ করা হলে সনৎ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার যা বলার তা আমি পরিচালনা পর্ষদকেই জানিয়েছি।’ এর বাইরে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি। অপর একজন অর্থমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে কথা বলেন। এ নিয়ে অর্থসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।
মাত্র কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই পরিচালনা পর্ষদই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দেখা করে অভিমত দিয়েছিল—নতুন ব্যাংক এখন দেওয়া যাবে না। সে সময় পর্ষদ দেশজ উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ, বৈদেশিক বাণিজ্য, আমানত ও ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, লাভজনকতা, জিডিপিতে খাতভিত্তিক অবদান ইত্যাকার বিবেচনা এবং সম-আয়তনের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এখনই ব্যাংকের সংখ্যা ও শাখা বেশি বলে মতামত দিয়েছিল।
কিন্তু গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদেই নতুন ব্যাংক স্থাপনের যৌক্তিকতা ও লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া তুলে ধরা হয়। অর্থনীতির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও অগ্রগতি তুলে ধরে এতে বলা হয়, ‘এ সকল বিষয় পর্যালোচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একটি মধ্যম আকারের অর্থনীতি বলা যেতে পারে।’ আরও বলা হয়, নতুন ব্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ব্যাংক খাতের অবদান আরও বৃদ্ধি পাবে বলে প্রতীয়মান হয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কাছে শেষ পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদ নতজানু হয়ে এ অনুমোদন দিয়েছে। অথচ আইন অনুযায়ী নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার একমাত্র এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদের হাতেই রয়েছে।
এ দফায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনৈতিক লাভালাভ মোটেও বিবেচনাতে আনেনি। যে কারণে ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়ে কোনো কোনো রাজনীতিবিদ এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে ছয় থেকে আট মাস আগেই ফারমার্স ব্যাংকের অফিস খুলে বসেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। গুলশানের এই অফিসে কিছু নিয়োগ, নিয়োগের সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়। প্রথম আলোতে সে বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে ৪৭টি ব্যাংক রয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে এর বেশি ব্যাংক দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, ‘আমার সময়ও নতুন ব্যাংকের বিষয়ে আগ্রহ দেখানো হয়েছিল। কিন্তু আমরা বিশ্লেষণ করে বলেছিলাম, নতুন ব্যাংক দেওয়ার সুযোগ নেই। সরকারও বিষয়টি মেনে নিয়েছিল। কোনো চাপ আসেনি। আমরা সক্ষমতা দিয়ে তা বোঝাতে পেরেছিলাম।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখন নতুন ব্যাংক দিলে যদি তারা নতুন সব আর্থিক পণ্য আনে, সেবার মান বাড়ায় তাহলে বিবেচনা এক রকম। কিন্তু এখন ব্যাংক খাতের যে পরিস্থিতি, তাতে চটজলদি তা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ফলে অদূর ভবিষ্যতে নতুন এত ব্যাংক ইতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্রিফিং: বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, তিন স্তরে যাচাই-বাছাই শেষে পর্ষদ বেসরকারি খাতে ছয়টি তফসিলি ব্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন সম্মতিপত্র দেওয়া হবে। সম্মতিপত্র পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র দাখিল করে নতুন ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এসব ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ঢাকার বাইরে স্থাপনের জন্য বলা হবে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই কেন ব্যাংক পেল, এমন প্রশ্নের জবাবে সুর চৌধুরী বলেন, যথাযথ মূল্যায়ন করে ব্যাংক দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁরা সবাই এ দেশের নাগরিক। রাজনৈতিক পরিচয় এখানে মুখ্য নয়।
এ দফায় বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌক্তিকতা: গতকাল পর্ষদের বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়েছে, বিগত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে। ২০০০-০১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ, বর্তমানে তা ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। জিডিপিতে ব্যাংক খাতের অবদান প্রতিবছর বাড়ছে। নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ফলে নতুন গ্রাহক সৃষ্টি হবে এবং আমানত সংগ্রহের হার বাড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, দেশে নতুন বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে। ব্যাংকঋণের সুদহার কমতে পারে এবং সেবার মান বাড়বে। এ ছাড়া নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার, নতুন আর্থিক পণ্য আসবে।

No comments

Powered by Blogger.