থাইল্যান্ড-ইংলাকের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠা by সুভাষ সাহা

তবে তিনি রাজনীতির একনিষ্ঠ ছাত্রী। উদেষ্টারা সে কারণেই তাকে গড়েপিঠে জনতার চোখে একজন উপযুক্ত নেত্রী করে তুলতে পেরেছেন। সময় গড়িয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে তার বক্তব্য অনেক পরিশীলিত হয়েছে এ কারণেই। মানুষের মধ্যে আবেগ সঞ্চারেও তিনি সমানভাবে সফল হয়েছেন।


এভাবেই ইংলাক ক্ষমতার দৌড়ে প্রথম অবস্থানে চলে আসেন

মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজনীতিবিমুখ মধ্যবয়সী মহিলা ব্যবসায়ী ইংলাক সিনাওয়াত্রা কী করে একজন উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী, আস্থাশীল রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন? নারীসুলভ শান্ত স্বভাবের মানুষটিকে ঘিরে এখন থাইল্যান্ডের ভবিষ্যৎ রাজনীতির আবর্তন শুরু হয়েছে। রোববার অনুষ্ঠিত থাইল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত ও বিদেশে স্বেচ্ছানির্বাসিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সাত ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বোন ইংলাকের নেতৃত্বে বিরোধী থাই পুয়ে পার্টি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। রাজনীতিতে একেবারে আনকোরা হয়েও কীভাবে তিনি থাইল্যান্ডের বিভাজিত রাজনীতি ও সমাজের ফাটলগুলো জোড়া লাগান বা কয়েক বছর ধরে চলা রাজনৈতিক সংকটের কারণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়াজনিত সমস্যা কাটিয়ে থাইল্যান্ডকে আবার আগের স্থিতিশীল ও দ্রুত উন্নয়নমুখী দেশের সারিতে ফিরিয়ে আনেন, তা দেখার জন্য অনেক বিশ্লেষক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
দেশের সাংসদদের মধ্যে সাধারণত যেসব গুণাবলি দেখা যায়, তার মধ্যে এখনও সেগুলো দৃশ্যমান নয়। তার পরও তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনতার চোখে যোগ্য প্রতিপন্ন করা গেছে তার উপদেশদাতাদের সচেতন প্রচেষ্টার কারণে। তারাই তার প্রতিটি বক্তৃতাকে ঘাষামাজায় জনগণের বোধ ও সমর্থন উপযোগী করে তুলেছেন। তাদের নির্দেশিত প্রচারণা কৌশলটা এমন ছিল যে, যাতে তার দুর্বলতাগুলো ঢাকা পড়ে যায় এবং সবলতা মানুষের সামনে উপস্থাপিত হয় চমৎকারভাবে।
উপদেষ্টাদের মধ্যে সর্বাগ্রে তার ভাই থাকসিনের কথা বলতে হয়। প্রতি সপ্তাহে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে কৌশল ঠিক করার মাধ্যমে তার এ শান্ত বোনটিই যে থাইল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম, সেটা তিনি প্রতিপন্ন করে ছেড়েছেন।
নির্বাচনের মাত্র দুই মাস আগেও তিনি থাই পুয়ে পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বানকে উপেক্ষা করেছেন। শেষ পর্যন্ত বৃহৎ রাজনৈতিক পরিবারটির স্বার্থে তিনি ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে বলি দিয়েছেন। কৌশলগত কোনো বিষয়ে যেন ইংলাক ভুল করে না বসেন, সে জন্য তার উপদেষ্টারা ওসব ব্যাপার এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ, একবার মানুষের সামনে তার অনভিজ্ঞতার দৃশ্যটি ধরা পড়ে গেলে তা তার ও তার দলের জন্য নির্বাচনে বুমেরাং হতে পারত। মানুষের কাছে বার্তা পেঁৗছে দেওয়া, জাতীয় বিষয়ে ঐকমত্যের ওপর জোর দেওয়া ও জনগণের দুর্দশার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ছিল তার বক্তৃতার মূল উপজীব্য। নিজের দলের অবস্থানকে সবসময় ঊধর্ে্ব তুলে ধরতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। কৃষক, উচ্চশিক্ষিত, শহুরে গরিব, জীবন-জীবিকা নিয়ে হিমশিম খাওয়া মধ্যবিত্তশ্রেণীর মন জয় করার মতো দলীয় কর্মসূচি নিয়েই তিনি সবসময় নির্বাচনী সভা-সমাবেশ এবং সংবাদ সম্মেলনগুলোতে হাজির হতেন। এর সঙ্গে বিগত দুই বছরে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা এবং জনগণের জীবনমান উন্নয়নে ব্যর্থতাকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।
তবে তিনি রাজনীতির একনিষ্ঠ ছাত্রী। উদেষ্টারা সে কারণেই তাকে গড়েপিঠে জনতার চোখে একজন উপযুক্ত নেত্রী করে তুলতে পেরেছেন। সময় গড়িয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে তার বক্তব্য অনেক পরিশীলিত হয়েছে এ কারণেই। মানুষের মধ্যে আবেগ সঞ্চারেও তিনি সমানভাবে সফল হয়েছেন। এভাবেই ইংলাক ক্ষমতার দৌড়ে প্রথম অবস্থানে চলে আসেন। মৃদুভাষী এ মহিলা শেষ পর্যন্ত নিজেকে মানুষের হৃদয়ের রানীতে পরিণত করতে সমর্থ হন।
লার্ট ও ইনডি সিনাওয়াত্রা দম্পতির নয় সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ইংলাক ১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চিয়াং মাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করেন। পরের দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণরূপে পারিবারিক ব্যবসা সূত্রে। সিনাওয়াত্রা ডিরেক্টরিজ কোম্পানি দিয়ে তার ব্যবসাজীবন শুরু। ২০০২ সালে ভাই থাকসিন থাইল্যান্ডের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে সিনাওয়াত্রা পরিবারের বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন কোম্পানির প্রেসিডেন্ট পদে তিনি আসীন হন। তার সাবেক সহকর্মীরা মনে করেন, তিনি একজন মার্জিত, উজ্জ্বল ও চমৎকার মানুষ। তার রয়েছে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এ জন্য তার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক রয়েছে, তারা সবাই তার গুণে মুগ্ধ।
পালাং ধর্ম পার্টিতে থাকসিনের সঙ্গে একসময় কাজ করা প্রবীণ সুদারত কেয়ুরাফান তাকে স্টেম্যানশিপের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। আইটিভির সাবেক প্রধান নিওয়াথামারং বংসংপাইসাল পালন করেন মিডিয়া সম্পর্ক ও সভা-সমাবেশের দায়িত্ব। সাবেক শিল্পমন্ত্রী মিংকাওন সায়েংসুয়ান ও সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী ওলারন চাইপ্রভাতকে দেওয়া হয় অর্থনৈতিক নীতি ও স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণের দায়িত্ব। টেলিকম নির্বাহী আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রচারণা ও কূটনীতিকদের নিয়ে কাজ করেন। চলচ্চিত্র নায়ক ও রাজনীতিবিদ ইউরানন সাংবাদিকদের সঙ্গে ইংলাক কীভাবে কথা বলবেন, তার ব্যবহার কী রকম হবে_ এসব ঠিক করতেন। প্রতি সোমবার এ চার উপদেষ্টাকে নিয়ে থাকসিন কাজের অগ্রগতি নিয়ে টেলিকনফারেন্স করতেন।
আলোচনায় যাতে কোনো দুর্বলতা ধরা না পড়ে, সে জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী অভিজিতের সঙ্গে তার মুখোমুখি বিতর্ককে বাতিল করে দেন ইংলাক। তিনি জনসভা ও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমেই তার পরিকল্পনা ঘোষণা করতেন। এমনকি ২০২০ সালের ভিশনও এ পদ্ধতিতেই প্রকাশ করা হয়। থাইল্যান্ডে রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দল থাই পুয়ে পার্টি বিজয়ী হওয়ায় তিনি দেশের ২৮তম ও প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
তবে ক্ষমতা পরিচালনায় তাকে যে অনেক বেগ পেতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নির্বাচনে তার দল বিজয়ী হওয়ায় রাতারাতি থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক কলহ মিটে যাবে, তা কিন্তু নয়। তার বিরোধীরা প্রথম দিকে চুপচাপ থাকলেও কিছুদিন যেতে না-যেতেই তারা রাস্তায় নেমে আসতে পারে। কারণ তারা কোনোভাবেই চাইবে না, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধামন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা নির্বাসন থেকে মুক্ত অবস্থায় ফিরে আসুক এবং দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করুক।
সেনাবাহিনী, শহরের উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণী ও বিশেষ সুবিধাভোগী অভিজাতবর্গ বরাবরই থাকসিনের জনদরদি কর্মসূচির বিরুদ্ধে ছিল এবং এখন তারা তা-ই আছে।
ইংলাক তার ভাইয়ের গৃহীত আগেকার বিভিন্ন গরিববান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেই বেতন একলাফে এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে বিপুল বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছেন। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অর্থ কোত্থেকে আসবে, বিরোধীরা সে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছে।
তবে থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে দেশের বাইরে রেখে ইংলাকের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে সাধারণ মানুষের আস্থা ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। তাই থাকসিনের মাথার ওপর দুই বছরের যে সাজা ঝুলছে, সেটা তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে মওকুফ করবেন, নাকি এটিকে রিকনসিলিয়েশনের অংশ হিসেবে করবেন, সেটাই দেখার বিষয়। রিকনসিলিয়েশনের অংশ হিসেবে আন্দোলনের সময় তার দলের যেসব নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন এবং যেসব সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি ক্যু ঘটিয়ে থাকসিনের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছিলেন, তাদের সবার প্রতি ক্ষমা ঘোষণার অংশ হিসেবে থাকসিনসহ তার দলের সবার ওপর থেকে সাজা তুলে নেওয়ার প্যাকেজ ঘোষণা করলে সম্ভবত তিনি থাইল্যান্ডের ইতিহাসে একজন বিরল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সম্মানে ভূষিত হবেন।
বস্তুত এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে থাইল্যান্ডের রাজনীতি ও সমাজের বিভক্তি রেখাটা তিক্ততার পর্যায় থেকে সহনীয় অবস্থায় নেমে আসবে কি-না, তার ওপর নির্ভর করছে থাইল্যান্ডে নতুন করে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার ভবিষ্যৎও। নতুন অভিযাত্রা বললাম এ কারণে যে, অভিজিতসহ ২০০৬ সালে থাকসিন সরকারকে উৎখাতের পর থেকে চলা সরকারগুলো কার্যত সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারেরই রকমফের ছিল।
ইংলাক রাজনীতিতে নবাগত হলেও তিনি কয়েক সপ্তাহে প্রমাণ করেছেন, রাজনীতির কঠিন পাঠ নিতে তার কোনো অসুবিধা হবে না। তিনি সফল হোন, থাই গণতন্ত্র মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়াক_ এটা থাইল্যান্ডের জনগণের মতো আমাদেরও প্রত্যাশা।

সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.