দাহকালের কথা-ক্রাচ by মাহমুদুজ্জামান বাবু

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার ইদুরহাটি গ্রামের কলেজছাত্র এবং অভাব-অনটনের কারণে কখনো কখনো ইটভাটার শ্রমিক, চলমান এইচএসসি পরীক্ষার্থী লিমনের বাঁ পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে, র‌্যাব সেই পায়ে গুলি করার পর। সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়া লিমন যখন পঙ্গু হাসপাতালে শুয়ে প্রায়ান্ধকার একটি ভবিষ্যতের


দিকে তাকিয়ে আছে, সেই সময়েই, ১১ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মহাপরিচালক গণমাধ্যমের কর্মীদের সামনে বললেন, লিমন আসলে ঘটনার শিকার। তাঁর বেদনাহীন ভাষ্য এ রকম...‘আমরা তো আর লিমনকে ধরতে যাইনি। তার অপরাধ খুঁজতেও যাইনি। লিমন একটি ছোট ছেলে। আমরা তো বলছি না যে, সে খারাপ বা সন্ত্রাসী ছেলে। এ রকম কিছু দেখছিও না...’ (প্রথম আলো, ১২ এপ্রিল)। তো, কিছু না দেখেই কালো চশমায় চোখ ঢেকে একটি ছোট ছেলের পায়ে গুলি করে তার জীবনে এত বড় সর্বনাশ জড়িয়ে দিলেন কেন? লিমনের জীবনের বাকি দিনগুলোতে অনেকবার ‘প্রথম দিনের সূর্য’ প্রশ্ন করবে কঠোর কঠিন মুখে। উত্তর মিলবে? কোথায় মিলবে? সংবাদ সম্মেলনে মহাপরিচালক একটিবারও বলেছেন কি, এটা তাঁদের অন্যায়? ভুল? টেলিভিশন সংবাদের সচিত্র প্রতিবেদনে নিজের বক্তব্যের সময় তাঁর মুখে আমি কোনো অনুতাপ কিংবা বেদনা দেখিনি। সাবলীল হেঁটে চলা একটি পায়ের মূল্য কত, লিমন তা অনুভব করছে এখন। এখন থেকে যাপিত জীবনের সব বিষয়েই অন্যের ওপর নির্ভর করতে হবে এই তরুণকে। এইচএসসি পরীক্ষায় আর কখনো সে অংশ নিতে পারবে কি না, আমরা তা জানি না। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার তৈরি করা অভাব-অনটন রুখে দিতে লড়েছিল সে প্রাণপণ। জীবন নির্বাহে কোদাল হাতে মাটি কাটত ইটভাটায়। স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বাঁচে। অতিক্রান্ত হয় পাহাড়সমান বাধা। সেই স্বপ্নভুক চোখের লিমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কোথায়? পঙ্গু হাসপাতালের জানালা দিয়ে কি আকাশ দেখা যায়? আকাশে তো এখন বৈশাখী মেঘ! মেঘ কি কথা বলতে পারে?
আমাদের মনে পড়ে যায়, ২০০২ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর প্রায় ৪০ হাজার সদস্য নিয়ে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে সন্ত্রাস দমন অভিযান শুরু করেছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। কমপক্ষে ১০ হাজার জন গ্রেপ্তার হয়েছিল তখন এবং তা হয়েছিল অভিযান শুরুর ৪৫ দিনের মধ্যে। এদের অন্তত ৫০ জন মৃত্যুবরণ করেছিল নিরাপত্তা হেফাজতে আর মৃত্যুর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এরা প্রত্যেকেই হূদেরাগী ছিল, হূদেরাগে আক্রান্ত হয়েই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে কোনো অনুসন্ধান বা আলোচনার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় যখন ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ শেষের দিকে, একটি দায়মুক্তি অধ্যাদেশের মাধ্যমে। ‘যৌথ বাহিনী দায়মুক্তি অধ্যাদেশ, ২০০৩’-এর মধ্য দিয়ে ২০০২ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০০৩-এর ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের অভিযান চলাকালে হতাহতের ঘটনা, আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এখনকার র‌্যাবের নাম, ২০০৩ সালের জুন মাসে পরিবর্তনের আগে ছিল র‌্যাট। দুর্নীতি, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, অদক্ষতা—এ রকম নানা অভিযোগের কারণে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কেবিনেট তখন র‌্যাবকে আইনগত বৈধতা দিতে ‘আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অর্ডিন্যান্স-১৯৭৯’ সংশোধন করে ‘আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০৩’ পাস করে। এর পর থেকেই সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে র‌্যাব গড়ে ওঠে একটি ‘এলিট ফোর্স’ হিসেবে। তাদের কাজের মধ্যে চলে আসে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, অপরাধের তদন্ত, অবৈধ অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার, সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী তদন্ত, সন্ত্রাসী বাহিনীর অনুসন্ধান এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা দেওয়া। ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’-এর মতো এখানেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অনেক। ‘ক্রসফায়ার’, ‘এনকাউন্টার’ এবং ‘নিখোঁজ’—এ রকম কয়েকটি শব্দের আড়ালে মানুষ হত্যার ঘটনা চলছে বিকারহীন। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ রকম মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৭ সালে ১৮০ জন, ২০০৮ সালে ১৭৫ জন, ২০০৯ সালে ২২৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১০ সালে ৬৮ জনকে র‌্যাব, ৪৩ জনকে পুলিশ, নয়জনকে যৌথভাবে র‌্যাব ও পুলিশ, তিনজনকে কোস্টগার্ড ও র‌্যাব, একজনকে বিডিআর হত্যা করেছে। এদেরও কি ‘দায়মুক্তি’ হবে?
লিমন যে ঘটনার শিকার, সেই ঘটনার প্রধান নায়ক একটি লাল রঙের কাপড়। পত্রিকা পড়ে জানতে পারছি, র‌্যাবের সোর্স জানিয়েছিল সন্ত্রাসী মোরশেদের গায়ে লাল গেঞ্জি আছে। ব্যস, গুলিভরা বন্দুক হাতে লাল গেঞ্জি খোঁজা শুরু হলো। লিমন গায়ে দিয়েছিল লাল শার্ট। এ যেন স্পেনের ষাঁড়ের লড়াইয়ের মঞ্চ। খুঁচিয়ে তোলা বুনো ষাঁড়ের সামনে লাল কাপড় দুলিয়ে দুলিয়ে নানা কসরত দেখাচ্ছেন ম্যাটাডোর। গ্যালারিভরা মানুষের পাশবিক উল্লাস! ষাঁড় ছুটছে। ছুটে আসছে ধুলোর ঝড় তুলে। বেঁচে থাকতে হলে একজনকে হারতেই হবে। কে জিতবে? ষাঁড় নাকি ম্যাটাডোর? আহত ম্যাটাডোর লিমনের জন্য এখন একটা ক্রাচ দরকার। দরকার আমাদের বিবেকের জন্যও। মহামান্য রাষ্ট্র, একটা ক্রাচ দেবেন?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
che21c@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.