চারদিক-শতবর্ষের উলানিয়া হাইস্কুল by মিজান শাজাহান

হাঁটি হাঁটি পা পা করে বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলাধীন ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত উলানিয়া করোনেশন হাইস্কুল শতবর্ষে পদার্পণ করল। বিশাল সবুজ মাঠ, পাশে খাল-দিঘি, পেছনে সবুজ বাগান—সব মিলিয়ে যেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা একটি চিত্র।


এ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’-এর রচয়িতা প্রখ্যাত কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি আসাদ চৌধুরী, মাই টিভির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রব, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাবেক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, ঢাকার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা নুরুর রহমান জাহাঙ্গীর, সাবেক সচিব গোলাম মোস্তফা তালুকদার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ওমর ফারুক প্রমুখ।
এই ঐতিহ্যবাহী স্কুলের অগণিত প্রাক্তন শিক্ষার্থী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। ‘উলানিয়া’ চার বর্ণের এই ছোট্ট শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাজার আবেগ। কবি আসাদ চৌধুরী জানিয়েছেন, প্রচুর উলুবন থাকার কারণে এ অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছে উলানিয়া। এখানে প্রচুর নলের আখড়া থাকায় নলের হাবেলী নামেও পরিচিত ছিল। ৩০০ বছর আগে নয়া রাজা চৌধুরী, কালা রাজা চৌধুরী ও হাসান রাজা চৌধুরী—এই তিন সহোদর লবণের ব্যবসায়ের জন্য উলানিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। ব্রিটিশ আমল থেকেই উলানিয়ায় কলকাতা থেকে পত্রিকা যেত। উলানিয়ার রাস্তায় কেরোসিন জ্বালিত ল্যাম্পপোস্ট ছিল, যা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর শৈশবে দেখেছেন। ছবির মতো দেখতে উলানিয়ার ১৫০ বছরের পুরোনো নয়নাভিরাম জামে মসজিদে চামড়া দিয়ে তৈরি বিশাল ‘নাগড়া’ ছিল। রমজান মাসে সেহির ও ইফতারির সংকেত প্রদানের জন্য এবং এলাকায় ডাকাত এলে এ নাগড়া পেটানো হতো, যা আমিও শৈশবে দেখেছি।
অথচ সেই উলানিয়ায় ১৯১২ সালের আগ পর্যন্ত কোনো স্কুল ছিল না। জমিদারবাড়ির সন্তানেরা ঢাকা, কলকাতা ও বরিশাল শহরে লেখাপড়া করত। জমিদারদের ধারণা ছিল, সাধারণ প্রজাদের সন্তানেরা শিক্ষিত হলে তাঁদের সম্মান করবে না। কিন্তু তাঁদের এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। ১৯১১ সালে কলকাতার গড়ের মাঠে সমগ্র বাংলার জমিদারদের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীসহ অন্য রাষ্ট্রীয় অতিথিরা মঞ্চে বসা। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদের সচিব। শত শত জমিদার দর্শকসারিতে বসা। হঠাৎ অনুষ্ঠানের পরিচালক মাইকে ঘোষণা করলেন, আমি বরিশালের উলানিয়ার এক গরিব প্রজার সন্তান। যেই মহানুভব জমিদারের আর্থিক সহায়তায় লেখাপড়া করতে পেরেছি, উলানিয়ার সেই জমিদার ইসহাক চৌধুরী দর্শকসারিতে বসা থাকবেন আর আমি মঞ্চে, এমনটা হতে পারে না। তাই আমি ইসহাক চৌধুরীকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো সমাবেশস্থল। বিষয়টি চৌধুরীর হূদয়ে দাগ কাটে। তিনি ভাবলেন, যেখানে শত শত জমিদার দর্শকসারিতে, সেখানে শিক্ষার জোরে এ গরিব প্রজার সন্তান অতিথির আসনে। তাই আমি যদি উলানিয়ায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করি, তাহলে উলানিয়ার সন্তানেরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হবে। তাই উলানিয়ায় ফিরে বিশাল সুপারি বাগান কেটে নির্মাণ করেন একটি শণের ঘর। সেখান থেকেই ১৯১২ সালে উলানিয়া স্কুলের পথচলা শুরু হয়। ইসহাক চৌধুরীর ছেলে সোহরাব-রুস্তম কাব্যের রচয়িতা মৌ. ফজলুর রহিম চৌধুরী বিয়ে করেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কন্যাকে।
উলানিয়া করোনেশন হাইস্কুলের শতবর্ষপূর্তি উদ্যাপিত হবে ১৩-১৪ এপ্রিল। স্কুলের ক্যাম্পাসে ওই দুই দিন ১০ হাজার প্রাক্তন ছাত্রের মিলনমেলা বসতে যাচ্ছে। প্রকাশিত হবে একটি মনোরম ম্যাগাজিন। নামীদামি শিল্পীদের গান আর নৃত্যে মেতে উঠবেন নবীন ও প্রবীণেরা। অনুষ্ঠানটির মিডিয়া পার্টনার মাই টিভি।
কবি আসাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে উদ্যাপন কমিটি দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু স্কুলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বনাশা মেঘনা নদী। সাত বছর আগে উলানিয়া স্কুল থেকে মেঘনার দূরত্ব ছিল ছয় কিলোমিটার। এখন তা দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তাই এখন প্রশ্ন, নাট্যকার আতিকুল হক চৌধুরী, মরহুম বিচারপতি আব্দুর রহমান চৌধুরী, তাঁর ছেলে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, ভাষাসৈনিক বাহাউদ্দিন চৌধুরীর উলানিয়া কি হারিয়ে যাবে?
মিজান শাজাহান

No comments

Powered by Blogger.