চরাচর-একাত্তরের এই দিনে কেরানীগঞ্জ গণহত্যা by স্বপন কুমার দাস

ঢাকা মহানগরীর উপকণ্ঠে বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ কোলঘেঁষে গড়ে উঠেছে আজকের বর্ধিষ্ণু জনপদ কেরানীগঞ্জ। এককালে এ স্থানটি ছিল গাছগাছালিতে ভরপুর, ছায়া সুনিবিড় গ্রামীণ জনপদ। ছিল ছবির মতোই সুন্দর। জীবনযাপনও ছিল সহজ-সরল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে এ জনপদটিও রক্ষা পায়নি।


সেদিন ২ এপ্রিল এখানে সংঘটিত হয়েছিল ভয়াবহ গণহত্যা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে সেদিন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় এখানকার নিভৃতপল্লী। মারা যায় হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ। ধ্বংস হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ। গৃহহীন হয় লাখ লাখ মানুষ।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা কারফিউ জারি করে ঢাকার বিভিন্ন লক্ষ্যস্থলে যে হামলা শুরু করে, তা ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত বিরামহীনভাবে চলে। সেদিন সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়। এ স্বল্প সময়ের মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত লাখ লাখ মানুষ একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যে যেদিকে পারে ছুটে যায়। বিপুলসংখ্যক নর-নারী কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেয়। আশ্রয়প্রার্থীর মধ্যে শাঁখারিবাজার, তাঁতীবাজার, বাংলাবাজারসহ ঢাকার বিভিন্ন মহল্লা থেকে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের অসংখ্য নর-নারীও ছিল। সেদিন কেরানীগঞ্জবাসী আত্মীয়ের মতোই সবার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিজগৃহে। আর এসব অসহায় মানুষকে আশ্রয় প্রদানই কাল হয়ে দাঁড়ায় কেরানীগঞ্জবাসীর। ৩০ মার্চ থেকে এখানকার পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। মিলিটারি আসার ভয় ঢুকে যায় সবার মধ্যে। বাড়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। কেউ কেউ কেরানীগঞ্জ ছেড়ে আরো ভেতরে চলে যায়। এদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ২ এপ্রিল রাতে আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে বড় বড় স্টিমার ও গানবোটে করে এসে কেরানীগঞ্জের জিনজিরা থেকে ঘোলামোড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সকালের আলো স্পষ্ট হওয়ার আগেই তারা গ্রামগুলোর ওপর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গুলি আর বোমার আওয়াজে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। পাকিস্তানি সৈন্যদের এমন আচমকা ও ভয়াবহ হামলায় মানুষ এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে থাকে। একদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি, অপরদিকে বিপন্ন নর-নারী ও শিশুর আর্তচিৎকারে এক অবর্ণনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সেদিন কেরানীগঞ্জে আশ্রিত লোকজনের পথঘাট চেনা না থাকায় তারা সৈন্যদের সামনে পড়ে বেঘোরে প্রাণ হারায়।
পাকিস্তানি সৈন্যরা সেদিন কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, শুভাঢ্যা, রঘুনাথপুর, আগানগর, কালিন্দী, মীরেরবাগ, আমিরাবাগ, খাগাইল, মান্দাইল, কালীগঞ্জ, ঘোলামোড়া প্রভৃতি গ্রামে আক্রমণ করে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। বাড়িঘরে আগুন দেওয়ায় গৃহহীন হয় অসংখ্য মানুষ। কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়। ব্যাপক লুটপাট হয় ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। সেদিন মধ্যদুপুর পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা হামলা চালায়।
আজ সেই ভয়াল ২ এপ্রিল। আজ কেরানীগঞ্জবাসী শুধু নয়, সারা দেশ গভীর সমবেদনায় এ দিনটি স্মরণ করবে। সেদিন যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের আত্মীয়স্বজনও দিনটিকে স্মরণ করবেন অশ্রু নয়নে।
স্বপন কুমার দাস

No comments

Powered by Blogger.