অপহরণের পর স্কুলছাত্র হত্যা, লাশ ইটভাটায়

বগুড়ার কাহালু উপজেলায় নাইমুল ইসলাম (১৩) নামের এক স্কুল ছাত্রকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ ইটভাটায় পুড়িয়েছে দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। উদ্ধার করা হয়েছে নাইমুলের ব্যাগ, বই, টিফিন বক্স ও পানির বোতল।


শাহাদত হোসেন (১৮) নামের এক আসামি গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সামনে স্বীকার করেছেন, পাঁচ লাখ টাকার লোভে তাঁরা নাইমুলকে অপহরণ করেন। পরে নাইমুল তাঁদের চিনে ফেলায় লাশ গুম করতে ইটভাটায় পোড়ানো হয়।
নিহত নাইমুল কাহালুর রোস্তম চাপড় গ্রামের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামের ছেলে। পড়ত কাহালু পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে। সহপাঠীরা জানিয়েছে, নাইমুল পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল।
নাইমুলের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে গতকাল কাহালু পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও রোস্তম চাপড় গ্রামের বাসিন্দারা বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ করেছে।
গ্রেপ্তার হওয়া শাহাদত ও আবদুল মান্নানকে (৫০) গতকাল জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে (ডিবি) সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। শাহাদত কাহালু ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ও উলট মধ্যপাড়া গ্রামের শাজাহানের ছেলে। মান্নান কাহালুর চারমাথার বাসিন্দা ও কাহালুর পূর্ব পাড়ায় অবস্থিত একটি ইটভাটার মালিক।
শাহাদত অবলীলায় নাইমুলকে হত্যার কথা স্বীকার করে সাংবাদিকদের জানান, কাহালু পৌরসভার চারমাথা এলাকার জাকারিয়া (গ্রেপ্তার হওয়া আবদুল মান্নানের ছেলে), ডালিম ও জামাল নামের তিন যুবক তাঁকে বলেছিল, তাঁদের সঙ্গে একটি কাজ করলে জীবনে আর টাকাপয়সার জন্য কোনো কাজ করতে হবে না। বড়লোক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তিনি এ হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেন।
শাহাদতের ভাষ্যমতে, ৫ এপ্রিল সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে কাহালুর অবজেকটিভ কোচিং সেন্টারের উদ্দেশে বের হয় নাইমুল। ওই সময় তাকে কোচিংয়ের প্রশ্ন দেওয়ার কথা বলে কাহালু চারমাথা এলাকায় জাকারিয়ার দোকানঘরে নিয়ে আসা হয়। এরপর নাইমুলের মুখে স্কচটেপ পেঁচিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। এ সময় নাইমুলের মুঠোফোন নিয়ে তাঁরা বগুড়া শহরের দিকে চলে যান এবং নাইমুলের বাবার কাছে মুক্তিপণ বাবদ পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন। ওই দিন বিকেলে শাহাদতকে জাকারিয়া জানান, নাইমুল তাঁদের দুজনকে চিনে ফেলেছে। তাই তাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। এ কথা বলে তাঁকে (শাহাদত) ও শাকিল নামের একজনকে ওই দোকানে যেতে বলেন।
শাহাদতের বর্ণনা অনুযায়ী, ওই দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে নাইমুলের চোখ বেঁধে জাকারিয়া, ডালিম ও জামাল তাকে প্রথমে চাকু দিয়ে ভয় দেখায়। পরে গলায় রশি দিয়ে দুই পাশ থেকে টান মেরে শ্বাসরোধে নাইমুলকে হত্যা করা হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে একটি মোটরসাইকেলের মধ্যে মৃত নাইমুলকে বসিয়ে মান্নানের ইটভাটায় নিয়ে যান জাকারিয়া ও ডালিম। পরে ভাটার শ্রমিক মতির সামনে নাইমুলকে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়। গভীর রাতে জাকারিয়া শাহাদতকে ফোন করে ইটভাটায় পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা বর্ণনা করে জানান, ‘এখন আর কোনো সমস্যা নেই।’
প্রেস ব্রিফিংয়ে বগুড়ার সহকারী পুলিশ সুপার মো. আরিফুর রহমান মণ্ডল ও গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মিজানুর রহমান জানান, অপহরণের ঘটনায় কাহালু থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন নাইমুলের বাবা রফিকুল ইসলাম। একযোগে মাঠে নামে পুলিশ। এদিকে অপহরণকারীরা নাইমুলকে ৫ এপ্রিল হত্যা করলেও তা গোপন রাখে এবং গত সোমবার সকালে নাইমুলের বাবা রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে মুক্তিপণ বাবদ পাঁচ লাখ টাকা আদায় করে। ওই টাকা দিয়ে জাকারিয়া একটি নতুন মোটরসাইকেল কেনেন।
শাহাদত সাংবাদিকদের জানান, মুক্তিপণের পাঁচ লাখ টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় কাহালু রেলস্টেশনের কাছে জাকারিয়া, ডালিম ও জামালের সঙ্গে কথা বলার সময় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় অন্যরা পালিয়ে যান।
শাহাদতের তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ জাকারিয়ার দোকানঘর থেকে নাইমুলের স্কুলব্যাগ উদ্ধার করে। ব্যাগে নাইমুলের বই-খাতা, টিফিন বক্স ও পানির বোতল পাওয়া যায়। এ সময় দোকানঘর থেকে একটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এরপর ইটভাটার মালিক জাকারিয়ার বাবা আবদুল মান্নানকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে মান্নান সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, তিনি ও তাঁর ছেলে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে জাকারিয়া মোটরসাইকেলে কিনেছে।
ওই সময় শাহাদত বলেন, মান্নানের ছেলে জাকারিয়াই এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা।
আবদুল মান্নান নিজেকে উপজেলা বিএনপির উপদেষ্টা বলে পরিচয় দেন। তবে কাহালু উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদুর রহমান জানান, মান্নান বিএনপির সঙ্গে যুক্ত নন। গত পৌরসভার নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন।
গতকাল দুপুরে কাহালুর পূর্ব পাড়া এলাকায় ওই ইটভাটায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। এদিকে নাইমুলের নৃশংস মৃত্যুর খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা শোকে ভেঙে পড়েছে। কথা বলতে পারেননি শোকার্ত বাবা রফিকুল ইসলাম।
হত্যাকারীদের শাস্তির দাবি: এদিকে নাইমুল হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে কাহালু সদরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে কাহালু পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যালয়ে শোকসভা, প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল। পরে তারা হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে কাহালু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে সঞ্চারকলিপি দেয়। এদিকে একই দাবিতে প্রায় একই সময়ে বগুড়া-নওগাঁ সড়কের কালিয়াপুকুর স্থানে এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রোস্তম চাপড়া গ্রামবাসী।

No comments

Powered by Blogger.