বিঝু থেকে বৈসাবি by মান কুমারী

এই মুহূর্তে পাহাড়ে পাহাড়ে বইছে আনন্দের হাওয়া। চারদিকে সাজ সাজ রব, উৎসবের আমেজ। হবেই বা না কেন, আর দুদিন পরে যে বিঝু! পার্বত্য আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় উৎসব বিঝু। বিভিন্ন সম্প্রদায় উৎসবটিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকে। চাকমারা বলে বিঝু, মারমারা সাংগ্রাই আর ত্রিপুরারা বলে বৈসু।


অন্য আদিবাসীদের কাছেও এ উৎসবের নিজস্ব নাম রয়েছে। সম্প্রদায়ভেদে এর আয়োজনে বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা দেখা যায়। এখন নাগরিক সমাজে অবশ্য উৎসবটি ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ ও চাকমাদের ‘বিঝু’— তিনটি নামের আদ্যোক্ষর ‘বৈ-সা-বি’ নামে পরিচিত।
বৈসাবি উপলক্ষে সেদিন বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে চন্দ্রিমা উদ্যোনের এক আড্ডায় পাওয়া গেল মিমোসা দেওয়ানকে। সুদূর আকাশপানে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী। বিঝু উৎসবের কথা জিজ্ঞেস করতেই তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। বললেন, ‘আমি অনেক আগে বাড়ি যাওয়ার অগ্রিম টিকিট কেটে রেখিছি। এখন শুধু পরীক্ষাটা শেষ হলেই বাঁচি। তারপর সোজা খাগড়াছড়ির পথে রওনা দেব।’ আড্ডায় আরও ছিলেন মিমোসার বন্ধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী নিধি চাকমা, ক্যাজচাই মারমা ও আলোরিকা চাকমা। নিধির মন খারাপ, পরীক্ষার জন্য বিঝুতে
বাড়ি যাওয়া হবে না, তাই। ওদের সঙ্গে এ আড্ডায় গাজীপুর থেকে যোগ দিলেন বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উখেং চিং মারমা।
আলোরিকার কাছে জানতে চাইলাম উৎসব সম্পর্কে। তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘আমরা চাকমা জনগোষ্ঠী তিন দিন ধরে বিঝু উৎসব পালন করে থাকি। চৈত্র মাসের শেষ দুই দিনকে ফুল বিঝু আর মূল বিঝু বলা হয়। আর নববর্ষের পয়লা দিনকে বলা হয় ‘গজ্যোপজ্যে’ দিন। ফুল বিঝুর দিন আমরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে নদীতে ফুল ভাসিয়ে দিই। এরপর নিজেদের ঘর-বাড়ি ফুল দিয়ে সাজিয়ে থাকি।’
মিমোসা যোগ করেন, বিজু উপলক্ষে সবার বাড়িতে ‘পাজন’ নামে ঐতিহ্যবাহী এক ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। এই খাবারে কমপক্ষে পাঁচ ধরনের সবজি মিশ্রিত করা হয়। তবে কোনো কোনো বাড়িতে এ সংখ্যা ৩২ ছাড়িয়ে যায়।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর মুখ খুললেন ক্যাজচাই মারমা। নিজ থেকেই বললেন, ‘মারমা সম্প্রদায় ‘সাংগ্রাই’ উৎসব পালন করে চৈত্র মাসের শেষ দিন থেকে। নববর্ষের প্রথম দিন আমাদের মূল উৎসব শুরু হয়। ‘ফাসোং’ নামে চাকমাদের মতো মারমারাও বিশেষ তরকারি রান্না করে।
উৎসবে বাড়ি যাওয়া হচ্ছে কি না জানতে চাইলে উখেং চিং মারমা বলেন, ‘যাব না মানে, অবশ্যই যাব। সাংগ্রাইয়ের কদিন আগেই যাওয়ার চেষ্টা করব। বন্ধুদের সঙ্গে অনেক মজা করব আর যাব দাদুবাড়ি।’
জানতে চাইলাম সাংগ্রাই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ সম্পর্কে। জানালেন, সবটুকু উৎসবজুড়ে থাকে আনন্দ। তবে জলকেলি উৎসবটা অনেক মজার। কেননা, এখানে তরুণ-তরুণীরা একে অপরকে পানি ছিটানোর মাধ্যমে খুঁজে নিতে পারে পছন্দের জীবনসঙ্গীকে। এখন হয়তো এমনটা হয় না। কিন্তু মজাটা রয়ে গেছে ঠিকই।
এবারের বৈসাবি উৎসবে ঢাকার বেশির ভাগ আদিবাসী শিক্ষার্থী বাড়ি ফিরবে নাড়ির টানে বহুদিনের চেনা গ্রামে। পাহাড়ে হাজারো অশান্তির মাঝে এক পশলা বৃষ্টির মতো শান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে প্রাণের উৎসব বৈসাবি।
আলোরিকা চাকমা একটা ছড়া কাটে ‘বিঝু পেকেখা দগরে বিঝু বিঝু/হাত্তোল পেগকেখা দাগে হাত্তোল পাগোক/কুহ্যুয়ে পেকেখা দগরে গরবা এত্তোক গরবা এত্তোক...।’ চাকমা আদিবাসীদের এই গানের অর্থ হলো—বিঝু পাখি ডাকে বিঝু বিঝু, পাখি ডাকে কাঁঠাল পাকুক, কোকিল ডাকে মেহমান আসুক মেহমান আসুক...

No comments

Powered by Blogger.